জেএসসি : এক সিদ্ধান্তেই কমেছে লক্ষাধিক জিপিএ–৫

একটি সিদ্ধান্তেই জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় সেরা মেধাবীর সংখ্যা লক্ষাধিক কমে গেছে। এ বছর থেকে চতুর্থ বিষয় তুলে দেওয়ার প্রভাব পড়েছে জিপিএ–৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যার ওপর। একই সঙ্গে ‘গোল্ডেন জিপিএ’ বলে মুখে মুখে মেধার যে স্বীকৃতি চালু হয়েছিল, তা–ও আর থাকছে না।

এ বছর আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে জিপিএ–৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম, ৬৬ হাজার ১০৮। অথচ গত বছরও এই সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৮৪ হাজার ৩৯৭। তার আগে ২০১৬ সালে জিপিএ–৫ পেয়েছিল ২ লাখ ৩৫ হাজার ৫৯ শিক্ষার্থী।

এবার পাসের হার প্রায় ২ শতাংশ বাড়লেও জিপিএ–৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যায় ধস নামায় অভিভাবকদের একাংশ ক্ষুব্ধ। এর একটিই কারণ, চতুর্থ বিষয় পুরোপুরি তুলে দেওয়া।

গত বছর পর্যন্ত জেএসসিতে বিষয় ছিল ১০টি, নম্বর ছিল ৯৫০। এবার জেএসসিতে সাতটি বিষয়ে পরীক্ষা হয়েছে, মোট নম্বর ছিল ৬৫০। শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে চাপ কমাতে বাংলা দুই বিষয়ের পরিবর্তে এক বিষয় এবং ইংরেজি দুটি বিষয়ের পরিবর্তে একটি বিষয় করা হয়। এ ছাড়া চতুর্থ বিষয় তুলে দেওয়া হয়।

এত দিন জিপিএ–৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখে এসেছিল চতুর্থ বিষয়। কোনো পরীক্ষার্থী একটি বিষয়ে ৮০ শতাংশের কম নম্বর পেলে চতুর্থ বিষয়ের নম্বর যুক্ত হয়ে সে জিপিএ–৫ পেত। গ্রেডিং পদ্ধতিতে চতুর্থ বিষয়ের জন্য পাঁচ নম্বরের দুই বাদ যেত। বাকি দুই বা তিন যুক্ত হতো মোট জিপিএর সঙ্গে, যা একজন পরীক্ষার্থীকে জিপিএ–৫ পেতে সহায়তা করত।

এই পরিপ্রেক্ষিতে জিপিএ–৫ নিয়ে দুই ধরনের স্বীকৃতি মুখে মুখে চালু হয়। একটি গোল্ডেন জিপিএ এবং আরেকটি সাধারণ জিপিএ–৫। যারা চতুর্থ বিষয় ছাড়াই সব বিষয়ে ৮০ শতাংশের বেশি নম্বর পেত, গোল্ডেন জিপিএ হিসেবে তাদের মূল্যায়ন করা হতো। আর যারা একটি বা দুটি বিষয়ে ৮০ নম্বরের কম নম্বর পেত তারা চতুর্থ বিষয়ের নম্বর নিয়ে সাধারণ জিপিএ–৫ পাওয়ার সুযোগ পেত। যদিও শিক্ষা কর্তৃপক্ষ ‘গোল্ডেন জিপিএ’ নামে কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু এ বছর চতুর্থ বিষয় না থাকায় জিপিএ–৫–এর মধ্যে আর কোনো বিভাজন থাকছে না।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, আগে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের চতুর্থ বিষয়ের নম্বর ধরেই ফলাফল হিসাব করা হতো। মূল্যায়নপদ্ধতির ধারাবাহিক পরিবর্তনের অংশ হিসেবে এবার তা করা হয়নি। এ কারণেই জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে গেছে।

তবে একাধিক অভিভাবক বলেন, নিয়ম পরিবর্তন হওয়ায় জিপিএ–৫ কমেছে, এর শিকার হয়েছে তাঁদের সন্তানেরা। আর গত বছর ঢাকা বোর্ডে জিপিএ–৫ পেয়েছিল ৭৬ হাজার ৮৮৪ জন। এবার ঢাকা বোর্ডে সেই সংখ্যা কমে হয়েছে ২২ হাজার ৩৩৪। এই পরিবর্তন যৌক্তিক নয়।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার বলেন, অভিভাবকদের কেউ কেউ সাময়িক অসন্তুষ্ট হলেও এটা ঠিক হয়ে যাবে, আগামী বছর সবাই অভ্যস্ত হবে। তা ছাড়া চতুর্থ বিষয় বাদ দেওয়ায় প্রকৃত মেধাবী চিহ্নিত করা সহজ হবে।

পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আরও জানান, তিনটি বিষয় কমে যাওয়ায় এবার শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ অনেকটাই কমে গেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চালু করা এই নিয়ম সহসা পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। কারণ বই, পাঠ্যক্রম, নম্বর বিভাজন—সবকিছু এই পরিকল্পনার অংশ।

যদিও শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন নম্বর কমালেই শুধু হবে না, পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি আরও ছোট করতে হবে।

জানতে চাইলে যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আমিরুল আলম খান বলেন, মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির এই পরীক্ষার যুক্তি আছে বলে তিনি মনে করেন না। চাপ কমাতে চাইলে এসব পরীক্ষা আগে বন্ধ করতে হবে। এরপর চাপ কমাতে চাইলে নম্বর কমানোর আগে বই ছোট করতে হবে। তাঁর মতে, এখনো জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবির) বইয়ে পাঠ্যসূচি ও নম্বরে অসংগতি আছে। আর এনসিটিবির বইয়ের বাইরে বিভিন্ন স্কুলে নানা রকম বই পড়তে বাধ্য করা হয়, যা বন্ধে সরকারের উদ্যোগ নেই বললেই চলে।

অষ্টম শ্রেণির জেএসসি পরীক্ষার এই ফল গতকাল সোমবার প্রকাশ হয়। গত ১ থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের ২২ লাখ ১৬ হাজার ৯৬১ জন শিক্ষার্থী জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। তাদের মধ্যে পাস করেছে ১৮ লাখ ৯০ হাজার ৫১৮ জন।

এ বছর পাসের গড় হার প্রায় ২ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৮৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০১৭ সালে পাসের গড় হার ছিল ৮৩ দশমিক ১০, আর ২০১৬ সালে পাসের এই হার ছিল ৯২ দশমিক ৮৯। এবার বরিশাল বোর্ডে পাসের হার সবচেয়ে বেশি, ৯৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আর সিলেট বোর্ডে পাসের হার সবচেয়ে কম ৭৯ দশমিক ৮২ শতাংশ। অন্যান্য বোর্ডে পাসের হার বিবেচনায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম বোর্ডে পাসের হার কম, যথাক্রমে ৮৩ দশমিক ১৯ ও ৮১ দশমিক ৮২ শতাংশ। সুযোগ–সুবিধা ও লেখাপড়ার পরিবেশ বিবেচনায় এই দুটি বোর্ডে পাসের হার বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক প্রত্যাশা।-প্রথম আলো’র সৌজন্যে প্রকাশিত।