জোটের রাজনীতিতে যে কারণে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন এরশাদ

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে চার দলীয় জোট গঠনের রূপরেখা নিয়ে আসেন। এরপর থেকে দেশে জোটের রাজনীতির মুল রুপ রেখা শুরু। বদলে যায় দেশে রাজনীতি।

মুলত, ’৯০-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে ওঠেন এরশাদ। তাকে ঘিরে ভিন্নমাত্রা পায় জোট-মহাজোটের রাজনীতি। নির্বাচনী রাজনীতিতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হয়ে ওঠেন ‘হট কেক’। তাকে জোটে পেতে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রতিযোগিতায় নামে। গত ৩০ বছর ধরে বাংলাদেশের জোটের রাজনীতিতে এরশাদ ছিলেন ফ্যাক্টর।

নব্বইয়ের দশকের পর জোট গঠনের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরশাদকে নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে টানাটানি। ১৯৯১-র বিএনপির শাসনকালের শেষ দিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নতুন একটি জোট গড়ে ওঠে। ওই জোটে এরশাদের জাতীয় পার্টিও যোগ দেয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হলে জাসদ (রব) ও জাতীয় পার্টি সরকারে যোগ দেয়।

কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ঐকমত্যের সরকার থেকে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি বেরিয়ে যায়। পরে বিএনপির সঙ্গে চারদলীয় জোট করে। বিএনপি-জাতীয় পার্টি ছাড়া চার দলের বাকি দল দুটি হচ্ছে- জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোট। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদ চারদলীয় জোট থেকে বেরিয়ে যান। তখন জাতীয় পার্টিতে আরেক দফা ভাঙন দেখা দেয়। নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে একটি অংশ বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে থেকে যায়। চারদলীয় জোট সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে রাজনীতিকে নতুন মেরুকরণ হয়। তখনও এরশাদকে পক্ষে নিয়ে দুই প্রধান দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নানা চেষ্টা চালায়।

চারদলীয় জোটের বিপরীতে গঠিত হওয়া ৮ দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগ যোগ দিয়ে ১১-দলীয় জোটে পরিণত করে। ওই জোট গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন বর্তমানের ঐক্যফ্রন্টের নেতা গণফোরামের ড. কামাল হোসেন। ১১ দল পরে ১৪ দল হয়ে মহাজোটে রূপ লাভ করে। ওই জোটে যোগ দেন এরশাদ। চারদলীয় জোট সরকারের শেষ দিকে বিএনপি এরশাদকে জোটে ভেড়ানোর জন্য চেষ্টা করলেও একপর্যায়ে এরশাদ পল্টনের মহাজোটের মঞ্চে উপস্থিত হয়ে মহাজোটের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। ওই মঞ্চে বিকল্পধারার বি. চৌধুরী, এলডিপির কর্নেল (অব.) অলি আহমেদও যোগ দেন। কিন্তু নির্বাচন করেন পৃথকভাবে।

আর জোটের রাজনীতির সুফল বুঝতে পেরে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে আওয়ামী লীগ মহাজোট গঠন করে এবং সরকার গঠনে সক্ষম হয়। একইভাবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি-জামায়াত বর্জন করলেও জাতীয় পার্টি অংশ নেয়। ১৫৩টি আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পায় আওয়ামী লীগ ও এর শরিক দলগুলো। জাতীয় পার্টি পায় ৩৪টি আসন। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় সংসদে বিরোধী দল হয় এরশাদের জাতীয় পার্টি। সংসদ নেতা নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। বিরোধী দলের নেতা হন রওশন এরশাদ। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত হন এরশাদ।

এরপর সর্বশেষ একাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিকে পাশে পেতে নানা কৌশল নেয়। অন্যদিকে বিএনপি থেকেও এরশাদকে পাশে পেতে নানা কৌশল অবলম্বন করা হয়। শেষমেষ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটেই যোগ দেয় এরশাদের জাতীয় পার্টি।

পরবর্তীতে বাংলাদেশে জোটের রাজনীতিতে সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন নতুন এ জোটটির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দল। দুই জোট মিলে অংশ নেয় একাদশ সংসদ নির্বাচনে। কিন্তু ভোটের লড়াইয়ে মাত্র ৮টি আসন পায় বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট জোট। নির্বাচনে আবার টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। নির্বাচনে পরই জাতীয় পার্টি সরকারে থাকবে না বিরোধী দলে থাকবে এ নিয়ে শুরু হয় নানান জল্পনা-কল্পনা। অবশেষে বিরোধী দলের ভূমিকা থাকার বিষয়েই সিদ্ধান্ত নেয় এরশাদের জাতীয় পার্টি।

এর আগে ১৯৮২ সালে সেনাপতি থেকে রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সেনাবাহিনীর প্রধান থেকে রাষ্ট্রনায়ক হয়ে পেয়েছিলেন পল্লীবন্ধু উপাধি। টানা ৯ বছর ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। এর পর ১৯৯০ সালে ক্ষমতা ছেড়ে দেন এরশাদ। সামরিক শাসনকাল বাদে কেবল ১৯৭০ ও ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগ ও ১৯৯১ সালে বিএনপি এককভাবে নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। এর বাইরে প্রতিবারই রাজনৈতিক দলগুলো জোটবদ্ধ হয়ে আন্দোলন ও নির্বাচন করেছে এবং নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকারও গঠন করেছে। জোট করতে গিয়ে কখনও কখনও আদর্শের সঙ্গেও সমঝোতা করতে হয়েছে।