ড. ইউনূসের স্বার্থরক্ষার্থে বিদেশিদের খোলার চিঠির প্রতিক্রিয়া

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী শিক্ষক সমাজের বিবৃতি

বিভিন্ন দেশের ১৬০ জন রাজনৈতিক ও নোবেলবিজয়ীসহ কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে খোলা চিঠিতে ড.মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের শ্রম আদালতে চলমান বিচারিক প্রক্রিয়া স্থগিতের দাবি জানালে এ দাবি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বিচারিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ বলে বিবৃতি দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী শিক্ষক সমাজ।

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের স্বার্থরক্ষার্থে দেওয়া বিবৃতিটিতে ‘বাংলাদেশে মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের ওপর আক্রমণ চলছে’ বলে যে দাবি করা হয়েছে তা অমূলক ও ভিত্তিহীন। দেশের প্রচলিত আইনে চলমান একটি মামলা নিয়ে এ ধরনের বক্তব্য আইনের শাসন ও মানবাধিকারের পরিপন্থি। এটি আন্তর্জাতিক আইন, রীতিনীতি ও শিষ্টাচার বিবর্জিত এবং একটি রাষ্ট্রের স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও সার্বভৌমত্বকে অসম্মান প্রদর্শনের শামিল। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা এবং সার্বভৌমত্বের ওপর এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।

জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণা, ফরাসি বিপ্লবের প্রেক্ষাপট, ব্রিটিশ বিল অব রাইটস, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সংবিধান প্রণয়নসহ পৃথিবীর সকল ঐতিহাসিক পরিবর্তনের মৌলিক দর্শন হলো নাগরিকদের আইনি সমতা নিশ্চিত করা। বিবৃতিদাতারাও নিজ নিজ দেশের আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও নীতিনিষ্ঠ নাগরিক হিসেবে পরিচিত। ফলে এ ধরনের পক্ষপাতমূলতক বক্তব্যের মাধ্যমে নিজেদের নীতি ও আদর্শকেই তাঁরা অস্বীকার করেছেন।

উল্লেখ্য যে, অতি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও গ্রেফতার হয়ে বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন। অথচ বাংলাদেশের বিষয়ে তাঁদের অবস্থান আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ব্যাপারে বৈপরীত্য নির্দেশ করে।

বিবৃতিতে বলা হয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা এবং তৎপরবর্তী দায়মুক্তি অধ্যাদেশ জারির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির সূচনা হয়েছিল। দুই দশকের বেশি সময় এ ধারা অব্যাহত ছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার শাসনকালে জাতীয় আন্তর্জাতিক নানা হুমকি ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে আইন যে তার স্বনিয়মে পরিচালিত হয়, সেই স্বাভাবিক বিষয়টিকে বিবেচনায় না নিয়ে নিরপেক্ষ বিচারকদের একটি প্যানেল দ্বারা অভিযোগের পর্যালোচনা করা হলে নিশ্চিতভাবে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে করা দুর্নীতি বিরোধী এবং শ্রম আইনের মামলাগুলো হতে তিনি খালাস পাবেন বলে বিবৃতিদাতাগণ যে দাবি করেছেন, তার মধ্য দিয়ে চলমান বিচারিক কার্যক্রম প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে এবং ন্যায়বিচারকে ব্যাহত করবে। প্রচলিত রাষ্ট্রীয় আইন ও বিচারিক নীতিমালাকে লঙ্ঘন করে একজন ব্যক্তির স্বার্থরক্ষার এ ধরনের প্রচেষ্টা নজিরবিহীন ও পক্ষপাতিত্বমূলক। তথাপি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচারপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা পর্যবেক্ষণের জন্য তাঁদের প্রতিনিধি প্রেরণের আহ্বান জানিয়েছেন।

প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য যে, এর আগেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নোবেলজয়ীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় কোনো কোনো নোবেলজয়ী দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন। যেমন, বেলারুশের আদালত শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অ্যালেস বিয়ালিয়াৎস্কিকে দশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেছে। ফিলিপাইনে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী সাংবাদিক মারিয়া রেসা-র বিরুদ্ধে দায়েরকৃত কর ফাঁকির মামলায় তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন। এ সকল নোবেল বিজয়ী আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে আদালতের রায় মেনে নিয়েছেন। বিচার প্রক্রিয়া থেকে রক্ষা পেতে তাঁরা কারও দ্বারস্থ হননি।

বিবৃতিতে আরোও বলা হয়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা বিচারাধীন। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে ৬০ বছরে অবসরে যাওয়ার আইন অমান্য করে ৭০ বছর বয়সেও উক্ত পদ ছাড়তে সম্মত ছিলেন না। এ সংক্রান্ত মামলায় তিনি বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আইনি লড়াইয়ে হেরে যাওয়ার পরে গ্রামীণ ব্যাংকের পদ ফিরে পেতে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রভাবশালী দেশে লবিং করেছেন। এছাড়াও তাঁর বিরুদ্ধে রাজস্ব ফাঁকি, দাতা তহবিলের অর্থ বেআইনিভাবে হস্তান্তর, শ্রম আইন লঙ্ঘন ও ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা ধরনের অভিযোগ আছে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা কর ফাঁকির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে এবং তিনি আদালতের রায় মেনে নিয়ে ধার্যকৃত কর পরিশোধ করেছেন।

আমরা আশা করি ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতিদাতা সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ বাংলাদেশের আইন-কানুন ও রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন এবং আইনগত ও সাংবিধানিক বিধি-বিধান অনুধাবন করবেন। অযাচিত ও অনভিপ্রেত বিবৃতি দিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের বিচারিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকতে শিক্ষক সমাজ সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছে।