তালেবানের অর্থের উৎস- অনুদান, মাদক, খনিজ সম্পদ, নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের রাজস্ব

দু’দশক ধরে বিশ্বের শীর্ষ পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রসহ মিত্রদের সঙ্গে লড়াই শেষে ফের আফগানিস্তানের ক্ষমতায় এসেছে তালেবান। বিশ্বের বিত্তশালী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে তারা একটি। কিন্তু তালেবানের অর্থ আসে কোথা থেকে? সেই উৎস খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।

১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের শেষ সময় পর্যন্ত আফগানিস্তান শাসন করেছে তালেবান। পরে মার্কিন আগ্রাসনে তারা উৎখাত হয়েছেন।

২০ বছরের লড়াই ও হাজার হাজার তালেবান সদস্যের প্রাণহানি সত্ত্বেও তাদের ভূখণ্ডগত নিয়ন্ত্রণ ও সামরিক শক্তি আগের চেয়ে বেড়েছে। চলতি বছরের মাঝামাঝিতে তাদের ৭০ থেকে এক লাখের মতো সেনা ছিল। এক দশক আগে তাদের সেনার সংখ্যা ছিল মাত্রা ত্রিশ হাজার।

মার্কিন বাহিনী ও যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ জারি রাখার পাশাপাশি আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ ও দেশের বাইরের উৎস থেকে বিপুল তহবিল সংগ্রহে সক্ষম হয়েছে তালেবান।

জাতিসংঘের তথ্যানুসারে, ২০১১ সালের পর থেকে তালেবানের বার্ষিক আয় দাঁড়িয়েছে ৪০ কোটি মার্কিন ডলার।

বিবিসির অনুসন্ধান বলছে, ২০১৮ সালের পর সেই আয় আরও বেড়েছে। এখন তালেবানের আয় বছরে দেড়শ’ কোটি মার্কিন ডলার।

আফগানিস্তানের ভিতরে ও বাইরে বিভিন্ন মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছে বিবিসি। এতে আভাস পাওয়া গেছে, তালেবান একটি অত্যাধুনিক অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক ও রাজস্ব ব্যবস্থা পরিচালনা করছে। তাদের বহু আয়ের উৎস রয়েছে।

বিদেশি অনুদান
পাকিস্তান, ইরান ও রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ তালেবানকে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে বলে আফগান ও মার্কিন কর্মকর্তারা অভিযোগ করে আসছিলেন। যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করছে দেশগুলো।

সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারসহ উপসাগরীয় দেশের নাগরিকেরা বড় ধরনের আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে তালেবানকে। এসব উৎস থেকে তালেবান বড় ধরনের রাজস্ব পায় বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনুদানের অংক হবে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার।

মাদক কারবারি
বিদ্রোহীদের অভিযান পরিচালনা করতে দীর্ঘদিন ধরে একটি রাজস্ব ব্যবস্থা চালিয়ে আসছে তালেবান। বিশ্বের শীর্ষ আফিম উৎপাদনকারী দেশ আফগানিস্তান। আফিম এমন একটি মাদক, যা পরিশোধন করে হেরোইন তৈরি করা যায়।

আফগানিস্তানে মাদক রপ্তানি মূল্য দেড়শ’ থেকে তিনশ’ কোটি মার্কিন ডলার হবে। আফিমের বাজার অনেক বড়। বিশ্বের হেরোইনের বড় অংশটি আফগানিস্তান থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে। আফগান সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, আফিম চাষীদের কাছ থেকে ১০ শতাংশ আবাদ কর সংগ্রহ করা হচ্ছে।

আফিমকে হেরোইনে রূপান্তরিত করার গবেষণাগার থেকেও কর আদায় করা হয়। যারা অবৈধভাবে মাদক কারবারি করেন, তাদের কাছ থেকেও রাজস্ব নিচ্ছে তালেবান।

আফগান পুনর্গঠন বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ মহাপরিদর্শক মার্কিন কমান্ডার জেনারেল জন নিকলসন বলেন, তালেবানের বার্ষিক রাজস্বের ৬০ শতাংশ আসে মাদক কারবারিদের কাছ থেকে। তবে কেউ কেউ বলছেন, এই অংকটা বাড়িয়ে বলা হচ্ছে।

তবে মাদক কারবারির সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে তালেবান। ২০০০ সালে ক্ষমতায় থাকাকালে আফিম-পপি চাষ নিষিদ্ধ করেছিল তালেবান।

বিস্তারিত অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ

আফিম কারবারির বাইরেও তালেবানের অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক প্রসারিত। ২০১৮ সালে এক খোলা চিঠিতে ব্যবসায়ীদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে জ্বালানি ও অবকাঠানো নির্মাণ সামগ্রীসহ বিভিন্ন পণ্যের কর দিতে বলেছে বিদ্রোহীরা। তালেবান নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল দিয়ে চলাচল করতে এই কর দিতে হতো ব্যবসায়ীদের।

আফগান সরকারকে উৎখাতের পর সীমান্ত ক্রসিংসহ দেশের সব বড় বড় বাণিজ্য পথগুলো তালেবানের নিয়ন্ত্রণে। এতে আমদানি-রফতানি খাত থেকে বিপুল রাজস্ব পাচ্ছে তালেবান।

গত দু’দশক ধরে পশ্চিমাদের বড় অংকের অর্থ তালেবানের পকেটে চলে গেছে। যা তাদের পাওয়ার কথা ছিল না। প্রথমত, সড়ক, স্কুল, ক্লিনিকসহ পশ্চিমা তহবিলে গড়ে তোলা অবকাঠামো ও উন্নয়ন প্রকল্প থেকে কর আদায় করছে তালেবান। দ্বিতীয়ত, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আন্তর্জাতিক বাহিনীর ঘাঁটিগুলোতে রসদ সরবরাহ করা ট্রাক থেকে বার্ষিক হাজার হাজার ডলার রাজস্ব আদায় করছে তালেবান।

এছাড়া আফগান সরকার যেসব সেবা দেয়, সেখান থেকেও বড় অংকের অর্থ আদায় করছে তারা বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২০১৮ সালে আফগানিস্তানের বিদ্যুৎ কোম্পানি বলছে, দেশের বিভিন্ন অংশে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের ওপর কর বসিয়ে ২০ লাখ মার্কিন ডলার আয় করে তালেবান।

এছাড়া যুদ্ধ থেকে তাদের আয় একেবারে কম হয় না। প্রতিবার তালেবান একটি সামরিক ঘাঁটি ও শহরের কেন্দ্র দখল করে এবং অস্ত্র, গাড়ি ও সামরিক যানবাহনের পাশাপাশি শহর এলাকার সরকারি ট্রেজারিও জব্দ করে। তাদের ভাষায়, সেগুলো গনিমতের মাল।

খনি ও খনিজ সম্পদ

আফগানিস্তান খনিজ ও দামি পাথরে সমৃদ্ধ একটি দেশ। বছরের পর বছর যুদ্ধ চলার কারণে এসব সম্পদের অপব্যবহার হয়ে আসছে। দেশটি থেকে বার্ষিক ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের খনিজ সম্পদ উত্তোলন করা সম্ভব। কিন্তু এসব খনিজ সম্পদ উত্তোলন করা হয় স্বল্পমাত্রায় এবং অবৈধভাবে।

তালেবান খনিজ এলাকাগুলোর নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। সেখানকার বৈধ ও অবৈধ খনিজ উত্তোলন কেন্দ্র থেকে তারা রাজস্ব আদায় করে আসছে। দক্ষিণাঞ্চলীয় হেলমান্দ প্রদেশের ২৫ থেকে ৩০টি অবৈধ খনিজ উত্তোলন কেন্দ্র থেকে তালেবান এক কোটি মার্কিন ডলারের রাজস্ব আদায় করছে।