পরকীয়ায় মজে ৩২৬ দিনেই সিংহাসন ত্যাগ রাজার

যুগে যুগে ভালোবাসার অনেক নির্দশনই চোখে পড়েছে। লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ এ রকম আরও অনেক উদাহরণ ইতিহাস হয়ে আছে। কেউ কেউ ভালোবাসার জন্য নিজেকে করেছেন দান, আবার কেউ বা হয়েছেন পাগল। তবে এমন এক রাজার কথা বলব, যিনি তার বিশাল রাজত্ব ছেড়েছিলেন ভালোবাসার জন্যই।

ইতিহাসে আভিজাত্যের সঙ্গে প্রেমের সংঘর্ষ নতুন নয়। দুর্দান্ত প্রভাবশালী, নাকউঁচু ব্রিটিশ রাজপরিবার ‘হাউস অব উইন্ডসর’কেও একাধিকবার সংকটে পড়তে হয়েছে শুধু ‘প্রেমের কারণে’। এমনকি সেই প্রেমের আকর্ষণের কাছে নিমেষে ফিকে হয়ে গেছে সিংহাসনের লোভও। রাজা অষ্টম এডওয়ার্ডের জীবন যেন তেমনই এক রূপকথার গল্প। রাজ পরিবারের রক্ত বইছে শরীরে, কিন্তু তাতে কি! সব কিছুকে উপেক্ষা করে তিনি প্রেমে পড়েছিলেন সাধারণ এক গৃহবধূর। রূপে গুণেও কোনো নামডাক ছিল না তার।

১৮৯৪ সালের ২৩ জুন ব্রিটিশ রাজপরিবারে জন্ম হয় এডওয়ার্ডের। রাজা পঞ্চম জর্জ ও রানি মেরির সন্তান রাজপুত্র এডওয়ার্ড ছিলেন সুদর্শন আর অভিজাত। তার সোনালি চুল, নীলাভ চোখ আর মায়াবি চেহারার জাদুতে আকৃষ্ট হত যে কেউ। প্রথম জীবনে প্রচুর নারী এলেও এডওয়ার্ডের জীবনে কেউই পাকাপাকি জায়গা করে নিতে পারেনি। একসময়ের ‘প্লে বয়’ আখ্যা পাওয়া এ এডওয়ার্ডের জীবনকেই এক ধাক্কায় নাড়িয়ে দিয়েছিল মধ্যবয়স্কা এক নারী, যার নাম ওয়ালিস।

১৯৩১ সালের ১০ জানুয়ারি, এক বিকেলে শহর থেকে দূরে উইকএন্ড নৈশভোজে গিয়েছিলেন এডওয়ার্ড। আর সেখানেই অনেক ভিড়ের মাঝেই কেতাদুরস্ত পোশাক, সাজসজ্জা আর এটিকেটে থাকা এক নারীতে চোখ আটকে যায় তার। জন্মসূত্রে মার্কিন এ নারীর নাম বেসি ওয়ালিস ওয়ারফিল্ড, বিবাহসূত্রে বেসি ওয়ালিস সিম্পসন। ছোট বেলা থেকে দাস প্রথা দেখে বড় হওয়ার বেসির জীবনে ছিল নানা উত্থান-পতন।

তবে তার স্বামী আর্নেস্ট সিম্পসনের ছিল জাহাজের চাকরি। সেই চাকরিসূত্রেই ১৯২৮ সালে আমেরিকা থেকে প্রথমবার লন্ডন আসেন ওয়ালিস। লেডি ফারনেসের কান্ট্রিহাউসে বিখ্যাত নৈশভোজেই এসে ওয়ালিসের প্রেমে পড়েন যুবরাজ এডওয়ার্ড। এডওয়ার্ড তখন প্রিন্স অব ওয়েলস। ব্রিটিশ রাজসিংহাসনের ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী, বিপুল ক্ষমতা আর সম্মানের শীর্ষে। অথচ ওয়ালিসের কাছে সেসবের যেন কোনো মূল্যই ছিল না। তার এ পাত্তা না দেওয়ার ব্যাপারটাই এডওয়ার্ডকে আরও বেশি আকৃষ্ট করেছিল। এরপরই মন দেওয়া-নেওয়াতে সময় বেশ লাগেনি। এতে স্বামীর সাথে ওয়ালিসের দূরত্ব বাড়ে।

তখন সমাজের আনাচে-কানাচে ভেসে বেড়াচ্ছে তাদের প্রেমের গুঞ্জন। উদ্দাম ভালোবাসা এমন জায়গায় পৌঁছায় যে সমাজ-সংসারকে ফুঁৎকারে উড়িয়ে একটি দুর্গে সে সময় পুরো এক সপ্তাহ একান্তে কাটান দুজনে। কিন্তু সেই নির্ভীক ভালোবাসাই কাল হয়ে দাঁড়াল। ১৯৩৬ সালে রাজা পঞ্চম জর্জের মৃত্যুর পর প্রথা অনুযায়ী রাজা হন তার ছেলে এডওয়ার্ড। বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী সিংহাসনে বসলেন অষ্টম এডওয়ার্ড। কিন্তু সিংহাসনে মন ছিল না তার। রাজ্যাভিষেকের কিছুদিনের মধ্যেই বোঝা গেল সেটা।
আরও পড়ুন: পানি ধরলেই যার হতে পারে মৃত্যুও!

রাজপরিবারে নিজের ভালোবাসার কথা জানিয়ে বিয়ে করতে চাইলেন ওয়ারিসকে। প্রবল আপত্তি তুলল ব্রিটিশ সরকার ও চার্চ। ওয়ালিসকে বিয়ে করলে পরিণতি কী হতে পারে তা ভালোই বুঝতে পারছিলেন এডওয়ার্ড। সিংহাসন তো হারাবেনই, এমনকি জনরোষে সর্বসমক্ষে অপমানিতও হতে পারেন। ১৯৩৬ সালের ১১ ডিসেম্বরে সেই চরম সিদ্ধান্ত নিলেন এডওয়ার্ড। সিংহাসন ত্যাগ করবেন মনস্থির করেছিলেন আগেই। সেই অনুযায়ী এক কথায় সিদ্ধান্ত নিলেন এবার।

দেরি না করে ১১ তারিখ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নিজের পদত্যাগপত্র জমা দেন। পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে সেদিন রাজা বলেছিলেন, রাজা হিসেবে আমাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তা বহন করা আমার পক্ষে অসম্ভব, যদি না আমি সেই নারীর সমর্থন ও সাহায্য পাই, যাকে আমি ভালোবেসেছি। ইংল্যান্ডসহ সাড়া বিশ্ব হতবাক হয়েছিলেন এডওয়ার্ডের এই ঘোষণায়।

ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে কম মেয়াদি রাজার তালিকার শীর্ষে রয়েছে রাজা অষ্টম এডওয়ার্ডের নাম। বাবা পঞ্চম জর্জের মৃত্যুর পর ১৯৩৬ সালের ২০ জানুয়ারি রাজা হয়েছিলেন এডওয়ার্ড। মাত্র ৩২৬ দিনের মাথায় সিংহাসন ত্যাগ করেন তিনি। পদত্যাগের পরের দিনই ইংল্যান্ড ছেড়ে অস্ট্রিয়ায় চলে যান এডওয়ার্ড। ১৯৩৭ সালের ৩ জুন ফ্রান্সের এক দুর্গে খুব গোপনে সাধারণভাবে বিয়ে সারেন এডওয়ার্ড ও ওয়ালিস। এরপর সারাটা জীবনই প্রেমিকাকে নিজের মতো করে কাছে পেয়েছেন, আগলে রেখেছেন এডওয়ার্ড।