পরকীয়া ভয়ঙ্কর এক ব্যাধি

সমাজের মুলমন্ত্র পরিবার। পরিবার গঠনে বিবাহ হল প্রত্যেক ধর্মের পবিত্র বন্ধন। সে জন্য বিবাহ বহির্ভূত নারী-পুরুষের সম্পর্ক সকল ধর্মেই নিষিদ্ধ। বিবাহের মত পবিত্র বন্ধনের মাধ্যমে যে সম্পর্কের সূচনা হয় তা বর্তমানে অনায়াসে ভেঙ্গে যাচ্ছে ভয়ঙ্কর পরকীয়া ব্যাধির কারণে। এর প্রাদুর্ভাব সমাজ কে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। বর্তমান সময়ে আলোচিত ব্যাধি পরকীয়া। পরকীয়া একটি অমানবিক বিকৃত মানসিকতার কাজ। শরিয়তের পরিভাষায় পরকীয়া বলা হয় বিবাহ-পরবর্তী কারো সঙ্গে কোনো ধরনের প্রেম-ভালোবাসাকে। ইসলামে এটা’কে সম্পূর্ণরুপে হারাম করে দিয়েছে।
পরকীয়া মানবতাবিরোধী একটি ভয়ঙ্কর অপরাধ। এই জঘণ্য কাজটি বর্তমানে লাগামহীন পাগলা ঘোড়ার ন্যায় ছুটে চলেছে। যার প্রচন্ড খুরের আঘাতে সমাজ ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার উপক্রম। ইসলাম সর্বশ্রেষ্ঠ একটি মানবিক ধর্ম। কোনো মানবিক গর্হিত কাজকে ইসলাম অনুমোদন দেয়নি। সুস্থা মস্তিষ্কের কোনো নারী-পুরুষ পরকীয়ায় লিপ্ত হতে পারে না। পরকীয়া সম্পর্কে যেমন সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্ট হয়, তেমনি পারিবারিক সম্পর্কে ফাটল ধরে। পরকীয়া নামের অসামাজিক ইসলাম বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের অশুভ থাবায় বিপর্যয়ের মুখে সংসার ও পরিবার। সমাজের নিম্ন স্তর থেকে উ”চ স্তরের সকল শ্রেণি পেশার মানুষের মাঝে এই ঘৃণ্য স্বভাব বিদ্যমান। ফলে স্বামী -স্ত্রীর দুই পরিবারে সম্পর্কের টানাপোড়নের সাথে সাথে তৃতীয় আরেকটি পরিবারেও অশান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। সমাজে ব্যাপক বিস্তরনশীল এই ব্যাধির জন্য দায়ী কে? শুধুই কি ব্যক্তি? হ্যাঁ ব্যক্তির নোংরা মানসিকতার দায়বদ্ধতা অবশ্যই আছে। যার ফলশ্রুতিতে জঘন্য হত্যাকা-ও সংঘটিত হচ্ছে। অনেকে অশান্তি সহ্য করতে না পেরে নিজেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। কিন্তু কেন? তার একটাই উত্তর ভয়ঙ্কর ব্যাধি পরকীয়া। বিভিন্ন কারণে পরকীয়া সংঘটিত হয়। যেমন একসঙ্গে না থাকা, পরনারী বা পুরুষের প্রতি আকর্ষণ বোধ করা, ধৈর্য ধারণ না করা, অশ্লীল বিনোদন দেখা, অতিরিক্ত বাইরে যাওয়া, ধর্মীয় জ্ঞান না থাকা। বিশেষ করে পশ্চিমা নষ্ট সংস্কৃতির অন্ধানুসারণ, ভারতীয় বাংলা-হিন্দি সিনেমা এবং সিরিয়ালের ব্যাপক বিস্তরন, ফেইজবুক এবং ইলেক্ট্রনিক প্রিন্ট মিডিয়ার অপব্যবহারের দরুন স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সম্মানবোধ, ভালোবাসা, আত্মোবিশ্বাস উঠে গেছে। নগ্ন নারী-পুরুষ মডেলের কামুক আবেদনময়ী সৌন্দর্য যখন স্বামী অথবা স্ত্রী দেখছে তখন নিজের স্ত্রী/স্বামীর সৌন্দর্য আর তাকে তৃপ্তি দিতে পারছে না। ঠিক তখনই এরা পরকীয়ার মতো ভয়ঙ্কর সমাজবিরোধী পথ বেছে নিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন পরিবার ধ্বংস হয়ে যাবে। আর পরিবার ধ্বংস হলে সমাজ ধ্বংস হবে এবং সমাজ ধ্বংস হলে রাষ্ট্রের অস্তিত্য থাকবে না। পরকীয়ার এই ভয়ঙ্কর ব্যাধি ঠেকাতে হলে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব বাড়ানোর পাশাপাশি বিশ্বস্ত সঙ্গীর সঙ্গ নিতে হবে। ইরশাদ হচ্ছে- ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও।’( সুরা তাওবা-১১৯)।
আমাদের দেশে ভয়ঙ্কর ব্যাধি পরকীয়ার জন্য ভাঙছে সামাজিক ও পারিবারিক জীবন। পরকীয়ার ফাঁদে আটকা পড়ে বলি হচ্ছেন নিরপরাধ সন্তান, স্বামী অথবা স্ত্রী। পরকীয়ার পথে বাধাঁ হওয়ায় নিজ সন্তানকেও নির্মমভাবে হত্যা করছেন তার মমতাময়ী মা। আবার কেউ বা পুঁতে রেখেছেন বাড়ির আঙিনায় কিংবা খাটের নিচে। পত্রিকার পাতা খুলতেই চোখে পড়ে এমন সব খবর। ইসলাম হলো নীতি ও আদর্শের ধর্ম। ইসলামে পরকীয়া ও অবৈধ সম্পর্ক থেকে বিরত থাকার জন্য নারী-পুরুষকে কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে। নিতান্তই প্রয়োজন ছাড়া পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলা যাবে না। ইরশাদ হচ্ছে- “হে নবী পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মত নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে পরপুরুষের সাথে কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না, এতে করে সেই ব্যক্তি কুবাসনা করে, যার অন্তরে ব্যাধি রয়েছে; তোমরা সঙ্গত কথাবার্তা বলবে।” (সুরা আহজাব-৩২,৩৩)। শুধু নারীদেরই নয়, পুরুষদের দৃষ্টি সংযত রাখার নির্দেশ দিয়ে ইরশাদ হচ্ছে- মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গর হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন। ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌন অঙ্গের হেফাযত করে। তারা যেন যা সাধারণতঃ প্রকাশমান, তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষ দেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো কাছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর সামনে তওবা কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। (সুরা আন নুর-৩০,৩১)। অপাত্রে সৌন্দর্য প্রদর্শনকে হারাম করে সবটুকু সৌন্দর্য স্বামীর জন্য নিবেদনে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। কারণ, স্বামী তার স্ত্রীর সৌন্দর্যে মোহিত হলে সংসারের শান্তিই বাড়বে। পক্ষান্তরে স্ত্রীর সৌন্দর্য দিয়ে অন্যকে মোহিত করার পথ অবারিত করলে তা কেবল বিপদই ডেকে আনবে। পুরুষ-নারী সবাইকে চরিত্র সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। ইরশাদ হচ্ছে- ‘তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হোয়ো না। এটা অশ্লীল কাজ এবং নিকৃষ্ট আচরণ।’ (সুরা বনি ইসরাইল-৩২)।
ব্যভিচার তথা পরকীয়ার মতো ভয়ঙ্কর শাস্তি সর্ম্পকে রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেন- ‘হে মুসলমানরা! তোমরা ব্যভিচার পরিত্যাগ করো। কেননা, এর ছয়টি শাস্তি রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি দুনিয়ায় ও তিনটি আখেরাতে প্রকাশ পাবে। যে তিনটি শাস্তি দুনিয়ায় হয় তা হচ্ছে- তার চেহারার ঔজ্জ্বল্য বিনষ্ট হয়ে যাবে, তার আয়ুষ্কাল সংকীর্ণ হয়ে যাবে এবং তার দারিদ্র্য চিরস্থাায়ী হবে। বাকি তিনটি শাস্তি আখেরাতে প্রকাশ পাবে তা হচ্ছে- সে আল্লাহর অসন্তোষ, কঠিন হিসাব ও জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে’ (বায়হাকি)। অন্যত্রে উকবা ইবনে আমের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) ইরশাদ করেন- ‘সাবধান! তোমরা নির্জনে নারীদের কাছেও যেও না।’ এক আনসার সাহাবি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল (সাঃ), দেবর সম্পর্কে আপনার নির্দেশ কী? উত্তরে রাসুল (সাঃ) বললেন, ‘দেবর তো মৃত্যুর সমতুল্য। (এখানে ‘মৃত্যু’ বলতে হাদিস গবেষকেরা হারামের কথা বলেছেন) (মুসলিম)। সাহল ইবনে সাদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মুখ ও লজ্জাস্থাানের হেফাজতের জামিনদার হবে, আমি তার বেহেশতের জামিনদার হব।’ (বুখারি)।
ইসলাম সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনবিধান। কোনো গর্হিত কাজকে ইসলাম অনুমোদন করেনি। বরং পরকীয়া নামক ভয়ঙ্কর ব্যাধি থেকে বিরত থাকতে বলেছে। পরকীয়ার বিপরীতে কঠিন শাস্তির বিধান রেখেছে। ধর্মীয় অনুশাসন পালনের সাথে পারিবারিক অনুশাসন ও প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অপসংস্কৃতি দমন করতে হবে। আল্লাহ আমাদের সব বিষয়ে অবগত। তাই আল্লাহর বিধান পরিপূর্ণ অনুসরণ আমাদের জীবনকে করবে সহজ ও সাবলীল। রাব্বে কারিম আমাদের’কে ইসলামি দিকনির্দেশনা মেনে চলার তাওফিক দান করুন। (আমিন)।
লেখকঃ
প্রাবন্ধিক ও মুদ্রণ ব্যবস্থাপক
দৈনিক সিলেটের ডাক