ফুঁসে উঠেছে পদ্মা : বন্যা আতঙ্কে চরাঞ্চলের মানুষ

উজান থেকে নেমে আসা ঢলে রাজশাহীতে হঠাৎ করেই ফুঁসে উঠেছে কীর্তিনাশা পদ্মা। পদ্মার পানি এখন বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। দখিনা স্রোতের ছোবলে এখনই হুমকিতে পড়েছে শহর রক্ষা বাঁধ। সময় যত গড়াচ্ছে পরিস্থিতি ততই যেন ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। এতে আতঙ্কের দিন কাটাচ্ছে রাজশাহীর বিভিন্ন চরাঞ্চলের মানুষ। এর সঙ্গে পদ্মার ভাঙনে ভাঙছে চর এলাকার মানুষের হাজারো স্বপ্ন। যদিও নদীর পানি এখনও বিপদসীমা অতিক্রম করেনি।

তবে এভাবে পানি বাড়তে থাকলে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে বলে ধারণা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।

রাজশাহী পবা উপজেলা হরিয়ান মধ্যচরে বসবাস করে ১০০টির মত পরিবার। চরখিদিরপুর ও খানপুরে রয়েছে প্রায় ৪০০টি পরিবার। প্রতিবারই মধ্যচর ডুবে আর চরখিদিরপুরে ভাঙ্গে পাড়। এতে পদ্মার নদীগর্ভে বিলিন হয় ক্ষেত, গাছপালা ও বাড়িঘর। এবারো তার ব্যতিক্রম হয়নি। বৃষ্টিপাত না হলেও উজানের পাহাড়ি ঢলে ভাঙ্গতে শুরু করেছে পদ্মা নদীর পাড়া। বিশেষ করে পদ্মার নদীর ওপারে চরখিদিরপুর, খানপুর ও চরমাঝারদিয়াড়ে পাড় ভাঙ্গায় এলাকাবাসির মধ্যে দেখা দিয়েছে অজানা আতংক। এরই মধ্যে নদীতে নেমে গেছে কয়েকশ’ বিঘা আবাদি জমি এবং অনেক গাছপালা। প্রতি মুহূর্তে কাটছে আবাস হারানোর আতঙ্কে।

জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ শুরু হয়েছে। সোমবার (১০ সেপ্টেম্বর) পবা উপজেলার মধ্যচর ও চরখিদিরপুর পরিদর্শন ও ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেছে উপজেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়। পবা উপজেলা নির্বাহী অফিসার জাহিদ নেওয়াজ ৫০ টি পরিবারের মাঝে প্রত্যেককে নগদ দুই হাজার টাকা ও ৩০ কেজি করে চাল বিতরণ করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন হরিয়ান ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মফিদুল ইসলাম বাচ্চু, পবা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা প্রকৌশলী আবু বাশির, ইউপি’র সদস্য কহিনুর বেগম, সমাজসেবক লালচান্দ, আনারুল প্রমুখ।

এদিকে জেলার গোদাগাড়ীতে পদ্মার পানি হঠাৎ বৃদ্ধি পাওয়াতে উপজেলার চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের আমিন পাড়া গ্রামের ৩৫ টি বাড়ী ঘর বিলীন ও ১৫ টির অধিক বাড়ীঘর আংশিক ভাঙ্গনের ফলে বিলন হতে বসেছে। এতে করে ওই গ্রামের বসবাসকারী লোকজন ভাঙনের আতঙ্কে দিনরাত যাপন করছে। গরু, ছাগল, হাস-মুরগীসহ অন্যান্য গবাদি পশু সরাতে পারলেও অন্যত্র খোলা আকাশের নিচে বসবাস করায় চরম দূর্ভোগের শিকার হচ্ছেন তারা।

চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মাসুদ রানা উজ্জ্বল বলেন, গত ১৫ দিনে টানা পদ্মার পানি অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে করে চর বয়ারমারী আমিনপাড়া গ্রামের ৩৫টি বাড়ীঘর পুরোটাই পদ্মায় ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেছে। ১৫ টির অধিকবাড়ী বিলিনের পথে রয়েছে। যে হারে পদ্মার পানি অব্যাহত রয়েছে তাতে করে যে কোন সময় ওই গ্রামটি বিলিন হতে পারে বলে জানান। শুধু বাড়ী ঘর না এই গ্রামের একটি বড় জামে মসজিদ ও প্রায় ৫০ বিঘার আবাদি জমি পদ্মার বুকে চলে গেছে। ফলে গ্রামটির ৫০টির অধিক পরিবারের প্রায় ৩০০ জন লোক চরম আতঙ্গের মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই এলাকার প্রায় লোকজনই দিন মজুর ও কৃষি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার ফলে তাদের আয় রোজগারও বন্ধ হয়ে গেছে। আশে পাশের গ্রামের লোকজনও বন্যা আতঙ্কে দিন পার করছে।

এলাকাবাসী ধারণা, এভাবে পানি বৃদ্ধি পেলে অনেক ক্ষয় ক্ষতি হবে। এই ক্ষতির আগে সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করলে কিছুটা রক্ষা হবে বলে জানান। এছাড়াও গোদাগাড়ী পৌর এলাকার সুলতাগঞ্জ এলাকার পদ্মা ও মহানন্দা নদীর মিলনস্থল এলাকার লোকজন ভাঙন আতঙ্কে দিন পার করছে।

চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ জানান, আমার ইউনিয়নের পদ্মার পানি বৃদ্ধি হয়ে বন্যার কথা গোদাগাড়ী উপজেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। যথাযথ ব্যবস্থাগ্রহণ করব বলে নিবার্হী কর্মকর্তা জানান।

গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিমুল আকতার জানান, চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নে চেয়ারম্যানের মাধ্যমে বন্যার কথা অবগত হয়েছেন। চেয়ারম্যানকে ক্ষতিগ্রস্থদের সঠিক তালিকা করতে বলেছি এবং তাদের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান।

অপরদিকে পদ্মার পানি বৃদ্ধির ফলে চারঘাট উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে হুমকিতে রয়েছে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ কয়েক হাজার বাড়িঘর। যে কোনো সময় তলিয়ে যেতে পারে এসব স্থাপনা। সরজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার টাঙ্গন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাহাপুর মসজিদ, পিরোজপুর ও রাওথা এলাকা রয়েছে সব চেয়ে বেশি হুমকিতে।

উপজেলার ইউসুফপুর ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ্ব শফিউল আলম রতন জানান, দীর্ঘদিন ধরে ইউনিয়নের বেশির ভাগ এলাকা পদ্মার ভাঙনে বিলিন হয়ে গেছে। আবার নতুন করে পদ্মায় পানি বৃদ্ধির ফলে দেখা দিয়েছে ভাঙন। দেখা দিয়েছে ভিটে মাটি হারানোর আশঙ্কা।

তিনি বলেন, গত কয়েক দিন ধরে যেভাবে পদ্মায় পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে টাঙ্গন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সাহাপুর এলাকার একটি মসজিদসহ কয়েক হাজার বাড়িঘর এখন হুমকিতে রয়েছে। এছাড়াও উপজেলার রাওথা এলাকাতেও ভাঙন দেখা দিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে রাওথা এলাকার একটি সংঘবদ্ধদল অবৈধভাবে নদীর তলদেশ থেকে বালু উত্তোলনের ফলে সেখানে দেখা দিয়েছে ভাঙন।

পিরোজপুর এলাকার বাসিন্দা ৯ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আলতাফ হোসেন বলেন, পদ্মার ভাঙ্গনে পিরোজপুরসহ কয়েকটি গ্রামের ভিটে মাটি হারিয়ে আজ তীরবর্তী এলাকার মানুষ অনেকটা অসহায়। তার উপর এবার যেভাবে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে আবারো মানুষের শেষ আশ্রয় টুকুও হয়তো বিলিন হতে পারে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম বলেন, পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু এখনও তেমন বড় ধরনের হুমকির কারণ হয়ে উঠেনি। রাজশাহী পাউবোর গেজ রিডার এনামুল হক জানান, প্রতিদিনই পদ্মার পানি তিন-চার সেন্টিমিটার করে বাড়ছে। শনিবার দুপুর ১২টায় রাজশাহী নগরীর বড়কুঠি পয়েন্টে পদ্মার পানির উচ্চতা পাওয়া গেছে ১৭ দশমিক ৪ মিটার। এটি ভোর ৬ টার চেয়ে এক সেন্টিমিটার বেশি। এর আগে শুক্রবার ভোরে পানি ছিল ১৬ দশমিক ৯৬ মিটার। গতকাল সোমবার বিকালে ছিল ১৭ দশমিক ১৪ মিটার।

রাজশাহী অঞ্চলে পদ্মার পানির বিপদসীমা ১৮ দশমিক ৫০ মিটার। এখন প্রতিদিন পানি বাড়ছে। এভাবে বাড়তে থাকলে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। এখনই পদ্মার বুকের জেগে ওঠা বেশিরভাগ চর তলিয়ে গেছে। পানি বাড়লে আরো চর এলাকা তলিযে যাবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) থেকে জানা গেছে, গত ১৫ বছরে রাজশাহীতে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে মাত্র দু’বার। এর মধ্যে ২০০৪ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত টানা ৯ বছর রাজশাহীতে পদ্মার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেনি। ২০০৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে পদ্মার সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল ১৮ দশমিক ৮৫ মিটার। এরপর ২০১৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে পদ্মা বিপদসীমা অতিক্রম করে। ওই বছর পদ্মার সর্বোচ্চ উচ্চতা ছিল ১৮ দশমিক ৭০ মিটার। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ২৮ আগস্ট রাজশাহীতে পদ্মার পানির প্রবাহ উঠেছিল সর্বোচ্চ ১৮ দশমিক ৪১ মিটার। এতেই বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে শহরে পানি ঢুকতে শুরু করে। নদীতে বিলীনও হয় অনেক এলাকা।