বিনা খরচে উৎপাদিত কাশ খড় বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে গাইবান্ধার চরাঞ্চলের মানুষ

সূর্য ওঠে সোনার বরণ রূপ নিয়ে। নির্মল আলোয় ভরে যায় চারদিক। আর যমুনার ওপর ঢেউ খেলে যায় উদাসী হাওয়া। আদিগন্ত সবুজের সমারোহ। যমুনার চরে বয়ে যাওয়া নদীর রুপালি ধারায় সূর্যের আলো ঝলমল করে। নদীর তীরে কাশবনের সাদা কাশফুল কখনো হাতছানি দিয়ে ডাকে। তবুও নীল আকাশে মেঘের ভেলা শুভ্রতায় মোড়ানো কাশফুল অপরূপ সৌন্দর্য ছড়ায়। প্রতিদিনই কাশবনে সৌন্দর্য পিপাসুরা ভিড় জমান প্রকৃতির স্নিগ্ধতার পরশ নিতে। সাদা কেশর দুলিয়ে শরতের কাশফুল শুধু যে সৌন্দর্যের দ্যুতি ছড়ায় তা নয়, চরাঞ্চলে কাশফুল জীবিকার খোরাকও বটে। কাশফুলের খড়, ছন আর ঝাটিতে আর্থিকভাবে আসে সচ্ছলতাও।

যমুনাবেষ্টিত গাইবান্ধার ফুলছড়ির চরাঞ্চলে কাশখড় (শুকনো কাশফুলের গাছ) বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন স্থানীয় মানুষ। কাশখড়ের বাণিজ্যিক ব্যবহারে আর্থিক সচ্ছলতাও ফিরে পেয়েছেন অনেকে। এসব কাশখড় যাচ্ছে সিরাজগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, দিনাজপুর, বরিশাল, বরগুনা, ঝালকাঠি, কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।

ফুলছড়ি উপজেলার এরেন্ডাবাড়ি, ফজলুপুর, গজারিয়া, উড়িয়া, কঞ্চিপাড়া ও ফুলছড়ি ইউনিয়নের চরগুলোর মাটিতে প্রাকৃতিকভাবে বেশি জন্ম নেয় কাশফুলের গাছ। এর জন্য চাষবাসের প্রয়োজন নেই, নেই কোনো যত্নআত্তির বালাই। শরতে নদীর ধার কিংবা বিস্তীর্ণ বালুচরে অবহেলায় ফোটে এই কাশফুল। দেশের প্রায় সব এলাকাতেই কাশফুল দেখা যায়। বিশেষ করে চরাঞ্চলগুলোতে কাশের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।

চরে জন্মানো কাশখড় ব্যবসায়ী কফিল উদ্দিন বুলবুলির চরসহ বিভিন্ন চর-দ্বীপচর থেকে শুকনো কাশফুলের গাছ ‘কাশখড়’ কিনে তিস্তামুখ ঘাটে নিয়ে আসেন। পরে এখান থেকেই পাঠান দেশের বিভিন্ন স্থানে। ঘাট খরচ, শ্রমিকের মজুরি এবং ক্রেতার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত পরিবহন ব্যয় ধরে ১০ মুঠির প্রতিটি আঁটি ১০ থেকে ১২ টাকা দরে বিক্রি করছেন। এ বছর উৎপাদন বেশি হওয়ায় দাম কিছুটা কম। দুই বিঘা চরের জমি থেকে তিনি সাত হাজার আঁটি ‘কাশখড়’ কিনেছেন। প্রতি আঁটি পাঁচ টাকা দরে কিনে ১২ টাকা দরে বিক্রি করে পেয়েছেন ৮৫ হাজার টাকা।

তিনি জানান, কাশফুল নদীর চরে এমনিতেই জন্মায়। এটি চাষ করতে হয় না। সার বা কীটনাশক কিছুই প্রয়োজন হয় না। শুধু লাগে চর থেকে কাশফুলের গাছ কেটে আনতে পরিবহন ও শ্রমিক খরচ। দুই বিঘা জমিতে এ বাবদ তার খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা। চরের কৃষকদের কাছ থেকে কাশখড় কিনে রাজশাহী, দিনাজপুর, বরিশাল, বরগুনা, ঝালকাঠি, কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পানচাষিদের কাছে বিক্রি করেন। পাঁচ টাকায় কেনা আঁটি বিক্রি হয় ১০ থেকে ১২ টাকা দরে। এভাবে জেলার ২৬০টি দ্বীপচরের প্রায় সব কৃষকই বিনা চাষের কাশখড় থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।

জেলার সুন্দরগঞ্জ ও পলাশবাড়ী উপজেলার পানচাষিরা জানান, কাশবনে দু’ধরনের গাছ জন্মায়। চিকন আকারের ছোট গাছগুলো খড় হিসেবে ব্যবহূত হয়। আর বড় এবং মোটা আকারের গাছগুলোকে ঝাঁটি বলে। কাশবন থেকে পাওয়া খড় ও ঝাঁটি পানের বরজের জন্য প্রয়োজন। খড় দিয়ে পানের বরজে ছাউনি দেওয়া হয় এবং পান গাছ বাঁশের শলাকার সঙ্গে বেঁধে উপরে তুলতে হয়। সুতলি বা অন্য কিছু দিয়ে বাঁধলে বৃষ্টির পানিতে ভিজে অল্প দিনের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়। খড় দিয়ে বাঁধলে দীর্ঘদিন ভালো থাকে, নষ্ট হয় না। এ কারণে বরজে খড় ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে ঝাঁটি বরজের ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ঘরের ছাউনি দিতেও ব্যবহূত হয় এ খড়।

গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (শস্য) মো. কামরুজ্জামান বলেন, কাশফুল চাষের জন্য কোনো বীজ কিংবা চারা নেই। এটি প্রাকৃতিকভাবে বর্ষাকালে নদীর চরে গজায়। প্রতি বছর বর্ষায় জুন থেকে অক্টোবরের মধ্যে কাশফুলের গাছ প্রাকৃতিকভাবে জন্মায়। কাশ কাটা হয় মধ্য নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর গাইবান্ধার উপপরিচালক মো. বেলাল উদ্দিন বলেন, কাশফুলের আবাদের চিন্তা কখনও করা হয়নি। তবে ‘উদ্ভাবনী ফসল’ হিসেবে কাশফুল চাষের জন্য চাষিদের উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। এতে চাষিরা লাভবান হবেন।