বিশ্ব এখন ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে: প্রধানমন্ত্রী

করোনা মহামারির ধকল কাটিয়ে ওঠার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিশ্ব এখন ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেছেন, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম বাড়ছে। ভোজ্য ও জ্বালানি তেল ছাড়াও বিদ্যুৎ, সার, গমসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। ডিজেলের ওপর আমাদের আমদানি নির্ভরতা রয়েছে। আগামী দিনে ডিজেলের দাম আরও বাড়তে পারে। ভবিষ্যত ফাইন্যান্সিয়াল মেকানিজম কী হবে, এটার উত্তর কেউ দিতে পারছে না।

শেখ হাসিনা বলেন, সবকিছুর দাম এমনভাবে বেড়ে গেছে যে এখন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সচল রাখতে আমাদের নিজস্ব সীমিত গ্যাসের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এমনকি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সচল রাখাটাই একটা কষ্টকর ব্যাপার হয়ে গেছে। এটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

বুধবার (৬ জুলাই) গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) আইটি বিজনেস ইনকিউবেটরের উদ্বোধনকালে তিনি এসব কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, কৃষিতে আমাদের ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, বিদ্যুতে ভর্তুকি দিচ্ছি। তারপরও আমরা সাধারণ মানুষকে নগদ অর্থ দিচ্ছি। উপকারভোগীদের কার্ড করে দিচ্ছি, রেশন কার্ডের মতো পারিবারিক কার্ড দিচ্ছি। যেখানে স্বল্পমূল্যে প্রায় এক কোটি মানুষের জন্য কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। যেন তারা কম দামে খাদ্যপণ্য কিনতে পারে। মানুষের কল্যাণে যা যা করার সব ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি।

তিনি বলেন, আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি, বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়িয়েছি। বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছি। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যে যুদ্ধ পরিস্থিতি একটা বিশ্ব সংকট তৈরি করেছে। যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আমেরিকা ও ইউরোপের রাশিয়ার ওপর দেওয়া বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার ফলাফলটা এমন দাঁড়িয়েছে, এখন তেলের দাম বেড়ে যাচ্ছে, ডিজেলের দাম বেড়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকটা জিনিসের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এলএনজির দাম বেড়ে যাচ্ছে।

শেখ হাসিনা বলেন, ফার্নেস অয়েলের দাম ছিল মাত্র ৭০৮ টাকা। সেটা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর হয়ে গেছে ১ হাজার ৮০ টাকা। অর্থাৎ ৩৩২ টাকা বা ৫২ শতাংশ বেড়ে গেছে। এলএনজি যেটা মাত্র ১০ মার্কিন ডলারে কেনা যেতো, সেটা এখন ৩৮ মার্কিন ডলার; ২৮০ শতাংশ দাম বেড়েছে। আমাদের কয়লার দামও ছিল ১৮৭ মার্কিন ডলার, যা এখন ২৭৮ মার্কিন ডলার, প্রায় ৬১ শতাংশ দাম বেড়েছে। ডিজেল ছিল ৮০ মার্কিন ডলার, এখন ১৩০ এ চলে এসেছে। শোনা যাচ্ছে ৩০০ ডলার পর্যন্ত দাম বাড়তে পারে। অর্থাৎ, সারা বিশ্ব এখন একটা ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। আমরা অনেক নির্ভরশীল ডিজেলের ওপর। সেই ডিজেলের দাম আরও বাড়বে।

তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞা না থাকলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও চলতো এবং একইসঙ্গে তেল, গ্যাস, সার, গম এগুলোর সরবরাহ ঠিক থাকতো। যদিও জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্যোগে একটা চ্যাম্পিয়ন গ্রুপ হয়েছে। সেখানে আমি সদস্য হিসেবে আছি। সেখানে আলোচনা হয়েছে- সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য এবং সার যেন আনতে দেয়া হয় সে বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে এবং সুইফট বন্ধ করার কারণে আমরা ডলার দিয়ে রাশিয়া বা ইউক্রেন থেকে পণ্য কিনতে পারছি না। কাজেই ফাইন্যান্সিয়াল মেকানিজম যে কী হবে, এটার উত্তর কেউ দিতে পারছে না।

তিনি আরও বলেন, ইউরোপেরও খুবই দুরবস্থা, যদিও তারা রুবল দিয়ে কিনে নিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের সে বিষয়ে খুবই সীমিত সুযোগ আছে। তবুও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা সবার ঘরে বিদ্যুৎ দিয়েছি ঠিক, কিন্তু বর্তমানে আমাদের লোডশেডিং করতেই হবে এবং উৎপাদনও সীমিত রাখতে হবে। যেন আমাদের বড় কোনো ভর্তুকি দিতে না হয়। ভর্তুকির ব্যাপারে আমি আপনাদের জানাতে চাই, বিদ্যুতে মোট ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ২৮ হাজার কোটি টাকা। গ্যাসের চাহিদা পূরণের জন্য এবং ইন্ডাস্ট্রি চালু রাখা এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখার জন্য যে এলএনজি আমদানি করছি, সেক্ষেত্রে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ২৫ হাজার কোটি টাকা। প্রতি কিউবেক মিটার এলএনজি কিনতে সরকারের ব্যয় হচ্ছে ৫৯ দশমিক ৬০ টাকা। কিন্তু আমরা সেটা গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করছিলাম মাত্র ৯ দশমিক ৬৯ টাকায়। যেটা সম্প্রতি ১১টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। তারপরও বিশাল অংকের ভর্তুকি রয়ে গেছে সেখানে।

তিনি বলেন, এই যে বিশাল অংকের ভর্তুকি আমরা দিচ্ছি, এটা কতদিন দিতে পারবো। কারণ, আমাদের মানুষকে খাদ্য দিতে হবে, চিকিৎসা দিতে হবে। গৃহহীনদের ঘর দিতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের মানুষের প্রতি নজর দিতে হবে।

সরকারপ্রধান বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ৮৪ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বাজেট ধরা হয়েছে। কিন্তু আমরা যদি ভর্তুকি না কমাই সরকারের টাকা আসবে কোত্থেকে। তার মানে যুদ্ধের কারণে আমাদের সবকিছুই এখন…। বিদেশেও সব পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। যেগুলো আমাদের কিনে আনতে হয়। ভোজ্যতেলও আমাদের বাড়তি দামে কিনে আনতে হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক্ষেত্রে সবাইকে আহ্বান করেছি, প্রত্যেককে নিজ নিজ সঞ্চয়টা বাড়াতে হবে। খরচের ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হতে হবে। যতটুকু পারা যায় বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হতে হবে। বিদ্যুতের ব্যবহার কমাতে হবে। আমাদের এখন একটাই উপায় কখন কোন এলাকায় লোডশেডিং হবে সেটার একটা রুটিন তৈরি করা। যেন মানুষ প্রস্তুত থাকতে পারে। মানুষের কষ্টটা যেন আমরা লাঘব করতে পারি। সে বিষয়ে আমাদের এখন নজর দিতে হবে। আমি আশা করি, দেশবাসী আমাদের সহযোগিতা করবেন।