রাঙামাটির কলমপতি গণহত্যা দিবসে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

পার্বত্য জেলার রাঙামাটি কাউখালী উপজেলা কলমপতিতে গণহত্যা দিবসে আলোচনা সভায় ৪৩বছরেও হয়নি বিচার ব্যবস্থা। ‘‘পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সকল গণহত্যার বিচার করুন” শ্লোগানে রাঙামাটির কাউখালীতে কলমপতি গণহত্যার ৪৩বছর উপলক্ষে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

শনিবার (২৫ মার্চ) ইউপিডিএফ’র কাউখালী ইউনিট এ আলোচনা সভার আয়োজন করে। সভায় ইউপিডিএফ সংগঠক অমিয় চাকমার সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন হিল উইমেন্স ফেডারেশন রাঙামাটি জেলা শাখার সভাপতি রিপনা চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের কাউখালী শাখার সভাপতি শান্তনা চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের রাঙামাটি জেলা শাখার সম্পাদক থুইনুমং মার্মা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কাউখালী শাখার সভাপতি সুমন চাকমা, বিশিষ্ট মুরুব্বী সাবেক প্রধান শিক্ষক সুনীল কান্তি তালুকদার, মেম্বার মুনীন্দ্র তালুকদার, সুকুমার কার্বারী এবং সমাজ সেবক দীপেন্দু চাকমা।

সভা শুরুতে কলমপতি গণহত্যাসহ সংঘটিত সকল গণহত্যায় যারা নিহত হয়েছেন এবং আন্দোলন সংগ্রামে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
সভায় বক্তারা বলেন, ১৯৮০সালে ২৫শে মার্চ কাউখালীর কলমপতিতে সংঘটিত গণহত্যাটি সেনা বাহিনী কর্তৃক পূর্ব পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছিল। সেনা সদস্যরা বিহার উন্নয়ন ও নির্মাণের কথা বলে মিটিং–এর নামে পোয়াপাড়া, কচুখালী, রাঙ্গীপাড়া, ডুলু, মাগ্যামাছড়া, হেডম্যানপাড়া, নীচপাড়া, মিতিঙ্গ্যাছড়ি, বেতছড়িসহ বিভিন্ন গ্রামের লোকজনকে স্থানীয় পোয়াপাড়া বিহারে জড়ো করে। সেনাদের কথায় বিশ্বাস করে সহজ সরল জনগণ সংশ্লিষ্ট গ্রামের মুরুব্বীদের সাথে নিয়ে সভায় উপস্থিত হয়। তারপর সমবেত লোকজনকে সারিবব্ধভাবে লাইনে দাঁড় করিয়ে সেনারা নির্বিচারে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। এতে কাউখালী বাজার চৌধুরী কুমুদ বিকাশ চাকমা, পোয়া পাড়া স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি কাশীদেব চাকমাসহ তিন শতাধিক নিরীহ লোক হত্যার শিকার হন।

বক্তারা বলেন, কলমপতির গণহত্যাটি বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত প্রথম গণহত্যা। তারপর থেকে একে একে মাটিরাঙ্গার বেলছড়ি, পানছড়ি, লংগদু, লোগাং, নাচিয়ারচরসহ বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন সময়ে ডজনের অধিক গণহত্যাসহ অসংখ্য সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে। কিন্তু কোন অপরাধের জন্য দোষীরা বিচারের মুখোমুখি হয়নি। এমনকি বিভিন্ন ঘটনার জন্য তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও সেসবের প্রতিবেদন জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি।

বক্তারা আরো বলেন, যতদিন পার্বত্য চট্টগ্রামের লোকজন পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকবেন ততদিন সকল গণহত্যার বিচারের জন্য দাবি জানিয়ে যাবেন। কোন অবস্থাতেই পার্বত্য চট্টগ্রামের লোজনকে দাবিয়ে রাখা যাবে না। ইউপিডিএফ-এর নেতৃত্বে পার্বত্যবাসী লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন।

কাউখালী গণহত্যা দিবসে ৪৩ বছরেও হয়নি বিচার: ২৫শে মার্চ কাউখালী(কলমপতি) গণহত্যা দিবস। ১৯৮০সালের আজকের এই দিনে রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার কলমপতি ইউনিয়নে রাষ্ট্রীয় মদদে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আর সেটেলার বাঙালি দ্বারা এক বর্বরতম গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিলো। এদিন সেনা কর্মকর্তারা বৌদ্ধ বিহার সংস্কারের জন্য পাহাড়িদের ডেকে এনে নৃশংসভাবে ব্রাশ ফায়ার করে এবং সেটলারদের লেলিয়ে দেয়। সেনা ও সেটলারের হামলায় এ হত্যাকান্ডে ৩০০এর অধিক নিরীহ পাহাড়ি প্রাণ হারায়। নিকটস্থ বৌদ্ধ বিহারে হামলা করে ভিক্ষুকেও গুরুতর জখম করে এবং পুরো এলাকা তান্ডব-লুটপাট চালায়। এ হত্যাকান্ড ১৯৭১-এ পাক হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের সাথে তুলনীয়।

স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় মদদে সংঘটিত তৎকালিন জিয়াউর রহমান সরকারের এ গণহত্যার আজ ৪৩বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু আজো বিচার হযনি এ বর্বর গণহত্যার। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন আওয়ামীলীগ সরকার ৭১সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা নিয়ে সরব হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত এই গণহত্যার ব্যাপারে একেবারে নিশ্চুপ।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, যেদিন এই বর্বর গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিল সেদিন ছিল সাপ্তাহিক হাটবার। স্থানীয় সেনা ইউনিটের কমান্ডার হাটে ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা দেয় যে পোয়া পাড়া বৌদ্ধ মন্দির মেরামত কর হবে। তাই পাহাড়িরা যাতে বৌদ্ধ মন্দির প্রাঙ্গনে অনতিবিলম্বে হাজির হয়। পাহাড়িরা মন্দির মেরামতের কাজ করার জন্য সেখানে উপস্থিত হলে সেনা কমান্ডার সবাইকে লাইনে দাঁড় করিযে গুলি করার নির্দেশ দেয়। গুলিতে নিমিষেই প্রাণ হারায় শতাধিক পাহাড়ি। নিহতের মধ্যে বাজার চৌধুরী কুমুদ বিকাশ তালুকদার, স্থানীয় ইস্কুল কমিটির সেক্রেটারী কাশীদেব চাকমাও রয়েছেন। এ হত্যাকান্ডের পরও সেনাবাহিনী ক্ষন্ত হয়নি। তারা সেটলারদের নিয়ে পাহাড়ি অধ্যুষিত কাউখালী মুখ পাড়া, পোয়াপাড়া, কাউখালী বাজার, তোং পাড়া এবং হেডম্যান পাড়া আক্রমণ করে। সেনাবাহিনী গ্রামের চারিপাশে ঘিরে থাকে যাতে কেউ বেরুতে না পারে। আর সেটলাররা দা, কুড়াল ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে পাহাড়িদের কুপিযে হত্যা করে ও ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দেয। মুখপাড়া বৌদ্ধ মন্দির, তোং পাড়া আনন্দ মোহন বৌদ্ধ মন্দির, পোয়া পাড়া বৌদ্ধ মন্দির, কাউখালী বৌদ্ধ মন্দির এবং হেডম্যান পাড়া বৌদ্ধমন্দিরও এদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। মারধর করে জখম করা হয় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের।

ঘটনার প্রায় একমাস পর ২২শে এপ্রিল(১৯৮০) তৎকালীন বিরোধী দলীয় তিন সংসদ সদস্য শাহজাহান সিরাজ(জাসদ), উপেন্দ্র লাল চাকমা(জাসদ) ও রাশেদ খান মেনন(ওয়ার্কাস পার্টি) ঘটনা সরেজমিন তদন্ত করতে কলমপতি যান। ঢাকায় ফিরে ২৫শে এপ্রিল(১৯৮০) তারা এক সংবাদ সম্মেলন আহবান করেন। এতে তারা জানান, “নৃংশস ঘটনাবলীর খবর সম্পূর্ণ সত্য। ২৫শে মার্চ সংঘটিত হত্যাকান্ডে তিনশ পাহাড়ি নিহত ও সহস্রাধিক নিঁখোজ হয়েছে। এ হত্যাকান্ডকে একাত্তরের পঁচিশে মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের সাথে তুলনা করে তারা বলেন-এই হত্যাকান্ড বাঙালি জাতির জন্য লজ্জা।”

সংবাদ সম্মেলনে তারা কলমপতি ইউনিয়নে সংঘটিত হত্যাকান্ড ও অন্যান্য ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত, বিচার ও শ্বেতপত্র প্রকাশ, দুঃস্থ পাহাড়ি পরিবারগুলোর যথাযথ নিরাপত্তা সহকারে পুনর্বাসন, বিধ্বস্ত বৌদ্ধ মন্দির পুনর্গঠন, বিভিন্ন জেলা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে শরণার্থী(সেটলার) পুনর্বাসন বন্ধ করা, সেটলারদের অনতিবিলম্বে ফিরিযে নেওয়াসহ ছয় দফা দাবি জানান।

এ হত্যাকান্ডের পর এক হাজারের অধিক পাহাড়ি শরনার্থি(রিফিউজি) হিসেবে ভারতের ত্রিপুরায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। বর্তমানে ঐ জায়গাগুলো সেটলাররা বেদখল করেছে, বৌদ্ধ মন্দিরের জায়গায় মসজিদ বানানো হয়েছে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধু কাউখালী গণহত্যা নয়, এ যাবত ডজনের অধিক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু এই রাষ্ট্র কোন গণহত্যারই বিচারের উদ্যোগ নেয়নি। উপরন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে পাহাড়িদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার লক্ষ্যে নানা চক্রান্ত জারি অব্যাহত রেখেছে।