রোহিঙ্গাদের কারণে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন স্থানীয়রা

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কারণে কক্সবাজারের স্থানীয়রা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে আন্তর্জাতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালেও স্থানীয়রা অস্বাভাবিক এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন৷

‘২০১৯ গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস’ নামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ‘গ্লোবাল নেটওয়ার্ক অ্যাগেনস্ট ফুড ক্রাইসিস’ সংস্থা৷ জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থা, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই সংস্থার সদস্য৷

এই প্রতিবেদন বলছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কারণে কক্সবাজারের স্থানীয় মানুষের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা চরম আকার ধারণ করেছে৷ মঙ্গলবার প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়৷ প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশসহ মিয়ানমার, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের প্রায় ১ কোটি ৪৭ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছেন৷

কক্সবাজারের ১৫ লাখ মানুষের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন জানাচ্ছে, সেখানে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকা মানুষের সংখ্যা ১৩ লাখ৷ এদের মধ্যে স্থানীয় ও রোহিঙ্গা উভয় জনগোষ্ঠীর সদস্যরাই আছেন৷ তবে শরণার্থীদের ক্ষেত্রে এ সংকটের তীব্রতা বেশি৷

প্রতিবেদনে বলা হয়, কক্সবাজারে অনেকেই আবাদী জমি ও মৎস্যক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন৷ তাদের অনেকেই দিনমজুর হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন৷ সস্তায় শরণার্থী পাওয়া যায় বলে স্থানীয়দের কাজের সুযোগ কমেছে, মজুরিও কমে গেছে৷

‘অস্বাভাবিক পরিস্থিতি’

কক্সবাজারের কুতুপালং এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আব্দুস সালাম বলেন, ‘‘অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের পাশাপাশি মাছের সংকটও দেখা দিয়েছে৷ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও বেড়ে গেছে৷ বিপরীতে স্থানীয় মানুষের কাজের সুযোগ কমে যাচ্ছে৷ স্থানীয় দিনমজুররা কাজ পাচ্ছেন না, কারণ রোহিঙ্গারা কম মজুরিতে কাজ করেন৷ ফলে এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷”

তিনি বলেন, ‘‘রোহিঙ্গারা ত্রাণ সহায়তা পেলেও স্থানীয় দরিদ্র মানুষরা তা পাচ্ছেনা৷ আবার ত্রাণ বিতরণে আছে অব্যস্থাপনা৷ কেউ কেউ উদ্বৃত্ত ত্রাণ বাজারে বিক্রিও করে দিচ্ছে৷ তারা স্থানীয়দের ছোট খাট ব্যবসায়ও ভাগ বসিয়েছে৷”

টেকনাফের আরেকজন স্থানীয় বাসিন্দা জিয়াউল করিম জানান, ‘‘রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরেও আছেন৷ ক্যাম্প এলাকার আশপাশ ছাড়াও আরো অনেক এলাকার কৃষি জমি দখল হয়ে গেছে, বনভূমিও উজার হচ্ছে৷ ফলে কৃষি ও শাকসবজি উৎপাদন কম হচ্ছে৷ সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, এখানে এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অন্য এলাকার চেয়ে অনেক বেশি৷ রোহিঙ্গারাতো সরকারি সহায়তা পায়, স্থানীয়রাতো পায়না৷ স্থানীয় অনেকের থাকার জায়গাও নাই৷ ফলে ভারসাম্যহীন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে৷”

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘রোহিঙ্গাদের এখানে থাকার ও খাবার নিশ্চয়তা আছে৷ যে কাজের দাম ৫০০ টাকা সেটা তারা ৩০০ টাকায় করতে পারে৷ ফলে স্থানীয় শ্রমিকরা মার খাচ্ছে৷”

জিয়াউল করিম আরো বলেন, ‘‘এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে কক্সবাজার এলাকায় তীব্র খাদ্য ও কাজের সংকট তৈরি হবে, যা প্রধানত স্থানীয় বাসিন্দাদের বিপাকে ফেলবে৷”

কক্সবাজারের কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা শরণার্থী সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘‘আমরা ত্রাণ পাচ্ছি৷ তবে বাইরে খাদ্যের দাম অনেক বেশি৷ আর এখন যেহেতু সব মিলিয়ে মানুষ বেশি, তাই খাবারের টানতো থাকবেই৷”

বিশেষজ্ঞ মত

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিআইডিএস এর অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘‘বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা যখন থেকে আসা শুরু করেছে তখনই খাদ্য নিরাপত্তার ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক করা হয়েছে৷ আর আমরা তখন থেকেই বলেছিলাম খাদ্য কিন্তু অর্থ থাকলেও কেনা যায়না৷ খাদ্যের সংস্থান থাকতে হয়৷ আমরা গত ১০-১২ বছর ধরে খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণ৷ আমরা যে কিছু চাল আমদানি করি তা কিন্তু চালের ঘাটতির কারণে নয়৷ বিশেষ ধরণের কিছু চাল বিশেষ প্রয়োজনে আমদানি করা হয়৷ এখন যে ১৩ লাখ অতিরক্ত মানুষের (রোহিঙ্গা) চাপ নিতে হচ্ছে, তাদের খাওয়াতে হচ্ছে, তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে৷ কারণ আমাদের উদ্বৃত্ত এত বেশি না যে আমরা তাদের বছরের পর বছর খাওয়াতে পরি৷ ফলে এখন আমরা খাদ্য নিরাপত্তাহীন দেশের তালিকায় চলে গেছি৷”

তিনি বলেন, ‘‘রোহিঙ্গাদের খাদ্য চাহিদা স্থানীয় উৎপাদন বা বাজার থেকে মেটালে এখানে খাদ্যের দাম বেড়ে যাবে৷ সারাদেশেই তার প্রভাব পড়বে৷ তাই খাদ্য আমদানি করে তাদের চাহিদা মেটাতে হবে৷ নয়তো বাজারের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে৷ সরকারকে এখনই ঠিক করতে হবে রোহিঙ্গাদের জন্য কোথা থেকে চাল আমদানি করা হবে৷ অর্থের সংস্থান কীভাবে হবে৷”

তাঁর মতে, ‘‘স্থানীয় পর্যায়ে সংকট আরো বেশি হবে৷ সঠিক পরিকল্পনা না নিলে খাদ্যের সংকট ছাড়াও সামাজিক, নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, স্যানিটেশন এগুলোর সংকট আরো বাড়বে৷”