রোহিঙ্গা ইস্যু : ভেঙে পড়ার মুখে মিয়ানমারের অর্থনীতি

রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যা চালানোয় বর্হিবিশ্বে ব্যাপক সমালোচনায় পড়েয়েছে মিয়ানমার সরকার। রাষ্ট্রীয়ভাবে কয়েকটি দেশ মিয়ানমারকে সমর্থন দিলেও ব্যবসায়ী এবং মোটা অর্থের বিনিয়োগকারীরা মুখ সরিয়ে নিচ্ছে দেশটি থেকে। পশ্চিমা বিশ্বের বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলো পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছে, তারা আর মিয়ানমারে বিনিয়োগ করবে না।

পর্যটন থেকে বড় আয় হলেও রোহিঙ্গা সংকটে তা শূণ্যের ঘরে নেমেছে। বর্তমানে মিয়ানমারে পর্যটকরা যাচ্ছেন না। মিয়ানমারে বিনিয়োগ করলে কোম্পানির সুনাম নষ্ট হবে ভেবে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না বিশ্বের নামি-দামি প্রতিষ্ঠানগুলো। সীমান্ত লাগোয়া ভারত, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের সঙ্গ বাণিজ্য কমে গিয়েছে মিয়ানমারের।

যা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ইতিমধ্যেই ভাবিয়ে তুলেছে।

এদিকে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়া বাতিল করেছে যুক্তরাজ্য। মিয়ানমারের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে মালদ্বীপ।

রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তারা নতুন বিনিয়োগে যাবে না আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো। তারা আশঙ্কা করছেন, উগ্রপন্থী এ সরকার যে কেনো সময়ে ঝুঁকিতে পড়বে। তখন বিনিয়োগ উঠিয়ে আনা যাবে না। আর নৈতিকভাবেও গণহত্যার সঙ্গে জড়িত কোনো নেতৃত্বের প্রতি সহানুভব থাকা উচিত নয় বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

প্রাথমিক ইঙ্গিত পেয়ে বিদেশি বিনিয়োগ টানতে গত জুন মাসে মিয়ানমার সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী ইউরোপের কয়েকটি দেশ সফর করেছিলেন। কিন্তু মিয়ানমারে ফিরে মন্ত্রীরা জানিয়েছেন, বিনিয়োগকারীরা জানতে চেয়েছেন, রোহিঙ্গা বিষয়ে। মিয়ানমারের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর জোর দিয়েছেন তারা।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সরকারের মন্ত্রীদের কথা গ্রহণযোগ্য হয়নি ব্যবসায়ীদের কাছে। ফলে ইউরোপ থেকে তাদের খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। দেশটির অর্থনীতিবিদ ও গণমাধ্যমগুলো এ বিষয়ে প্রশ্ন করলেও সঠিক জবাব পায়নি তারা।

সব মিলিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সমালোচনা ও চাপের মুখে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর রাখাইন রাজ্যসহ মিয়ানমারের অর্থনীতির বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে। সামরিক শাসন অবসানের পর দেশটিতে ব্যাপক বিদেশি বিনিয়োগের প্রত্যাশা করেছিল সরকার।

তবে রাখাইনে রোহিঙ্গা সংকটের কারণে এরই মধ্যে বেশি কিছু পশ্চিমা কোম্পানি নিজেদের বিনিয়োগ স্থগিত করেছে ও পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংকট তৈরি হয়েছে দেশটির পর্যটন খাতে। এছাড়া রাখাইনের রাজ্য সরকার ও কেন্দ্র সরকারের মধ্যে বড় বড় প্রকল্পগুলো নিয়েও টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে।

গত সপ্তাহে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা সংকটে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের ইঙ্গিত দেয়। জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে সংস্থাটির মহাসচিব রাখাইনে অবিলম্বে সেনা অভিযান বন্ধের আহ্বান জানান। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করার আহ্বান জানানো হয়।

এর আগে ‘চলমান সহিংসতা এখনই বন্ধ’ করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে আঞ্চলিক ও আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো। ক্ষতিগ্রস্ত সব সম্প্রদায়ের মানুষের কাছেই মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেয়া প্রয়োজন বলেও সংস্থাটির সদস্যদের মধ্যে মতৈক্য হয়েছে। যুক্তরাজ্য দেশটির সামরিক বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেয়া বাতিল করেছে।

মিয়ানমারের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে মালদ্বীপ।

ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কথিত গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিপুল আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের আশা করেছিল মিয়ানমার। বিদেশি কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিনিয়োগের আগ্রহও দেখা গিয়েছিল।

তবে রাখাইন রাজ্যে শোচনীয় মানবাধিকার পরিস্থিতির কারণে অনেক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানই পিছু হটছে। মিয়ানমারে বিনিয়োগ করলে সুনাম ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা করছে এসব আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো।

রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুসারে, এসব বিদেশি কোম্পানির মধ্যে রয়েছে মার্কিন ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানি, বহুজাতিক জ্বলানি কোম্পানি শেভরন ও নরওয়েভিত্তিক টেলিকম কোম্পানি টেলিনর।

ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট কমিটি অন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড-র প্রধান বার্নড লানগে বলেন, গত সপ্তাহে তার প্রতিনিধি দল মিয়ানমারে অনির্দিষ্টকালের জন্য একটি সফর স্থগিত করেছে। কেননা, বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতির কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন-মিয়ানমার-র সম্ভাব্য বিনিয়োগ চুক্তি নিয়ে একটি ফলপ্রসূ আলোচনা করা যাচ্ছে না।

মিয়ানমার ট্যুরিজম ফেডারেশনের ভাইস চেয়ারম্যান খিন অং তুন ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, যেসব আন্তর্জাতিক ফার্ম মিয়ানমারে সম্মেলন করতে চেয়েছিল তারা এখন স্থান পরিবর্তনের কথা ভাবছে।

সু চি’র সরকার সমর্থক সংবাদমাধ্যম মিয়ানমার টাইমস এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ভৌগলিকভাবে প্রাণকেন্দ্র না হলেও দেশটির অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাখাইন। সুপরিচিত নাগাপালি সৈকত ছাড়াও রাখাইনে রয়েছে বেশ কয়েকটি তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস। এছাড়া বঙ্গোপসাগরে রয়েছে ব্যাপক পরিমাণে সামুদ্রিক সম্পদ।

রাখাইনের অর্থনীতি সংকট ও প্রতিবন্ধকতার মুখে রয়েছে উল্লেখ করে মিয়ানমার টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সর্বশেষ সহিংসতার পর সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ‘সঠিক’ তথ্য তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে।

রাখাইনের ইয়েথেটাউং শহরের এমপি ইউ উও থান নাইং জানান, ১৯ সেপ্টেম্বর ভাষণে সু চি ভুল তথ্য উন্মোচন করলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।

মিয়ানমারের অর্থনৈতিক কলাম লেখক ইউ খিন মাউং নিয়ো উদ্বেগ প্রকাশ করে জানান, রাখাইনের সহিংসতা নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপের কারণে অঞ্চলটির স্থিতিশীলতা নিয়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা চিন্তিত হতে পারে। যা রাখাইনের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে ব্যহত করতে পারে।

রাখাইনের মৎস্য বিভাগের পরিচালক ড. নাইয়ুন্থ ওয়াই মাউং জানান, আঞ্চলিক সংঘাতের কারণে মংডু অঞ্চলের সামুদ্রিক খাদ্য পণ্যের কারখানাগুলো প্রভাবিত হচ্ছে। সংঘাত শুরুর পর উৎপাদন কমে গেছে।

২২ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার টাইমস আরেকটি প্রতিবেদনে দেশটির পর্যটন শিল্প হুমকির মুখে পড়েছে বলে উল্লেখ করেছে। রোহিঙ্গা সংকটের কারণে অনেক পর্যটন কোম্পানি তাদের নির্ধারিত সফর ও হোটেল বুকিং বাতিল করেছে।

ইউনিয়ন অব মিয়ানমার ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ইউ থেট জানান, নগাপালি ও ম্রাউকে পর্যটকদের বুকিং বাতিলের সংখ্যা অনেক বেড়েছে।

ইয়াঙ্গুন, নগাপালি সৈকত ও বাগান অঞ্চলের হোটেল সংশ্লিষ্টদের মতে, গত বছরের তুলনায় এই বছর একই সময়ে অনেক কম হোটেল বুকিং হচ্ছে। মিয়ানমার টুরিজম মার্কেটিং কমিটির চেয়ারম্যান ও চাত্রিয়াম হোটেলের মহাব্যবস্থাপক ডাউ মিয়াত মন উইন বলেন, এই মুহূর্তে বুকিংয়ের হার কমেছে।

মিয়ানমারের সরকার পরিচালিত সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমার-এ দেশটির অর্থনীতিবিদ খিন মাউং নিয়ো-র একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। মিয়ানমারের উন্নয়নের জন্য বিদেশি বিনিয়োগ অবশ্যই প্রয়োজন বলে তাতে উল্লেখ করা হয়েছে।

২১ সেপ্টেম্বর নিক্কেই এশিয়া রিভিউতে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে অং সান সু চি নিজেও স্বীকার করেছেন রাখাইনের সহিংসতায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক।

উল্লেখ্য, ২৫ আগস্ট ৩০টি পুলিশ ফাঁড়িতে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) হামলার জবাবে রাখাইনে সামরিক অভিযান জোরদার করে মিয়ানমার। সামরিক অভিযানের মুখে ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ ও গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। জাতিসংঘ সেনাবাহিনীর অভিযানকে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা রাখাইনে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘঠিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে।