১৫ মিনিটেই যেভাবে জলদস্যুদের দখলে যায় জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ

চট্টগ্রাম ভিত্তিক শিল্প গ্রুপ কবির স্টিলসের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন ‘এমভি আবদুল্লাহ’ জাহাজ।
বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার (১২ই মার্চ) দুপুর দেড়টার দিকে ভারত মহাসাগরে অবস্থান করা জাহাজটির ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ চট্টগ্রামের এসআর শিপিংয়ের কর্মকর্তাদের জানান, জলদস্যুরা তাদের জাহাজে আক্রমণ করছে। ওই সময় কর্মকর্তারা সেই আক্রমণ যেকোনো মূল্যে ঠেকানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু এর ১৫ মিনিট পরই ক্যাপ্টেনের একটি ই-মেইল বার্তা আসে চট্টগ্রামে। সেখানে তিনি জানান, জলদস্যুরা জাহাজের দখল নিয়ে ফেলেছে।

মঙ্গলবার রাতে কবির স্টিলস এর পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে এভাবে বিষয়টি জানানো হয়।
সন্ধ্যা ৭টার দিকে নাবিকদের সঙ্গে সর্বশেষ যোগাযোগ হয় শিপিং কর্তৃপক্ষের।

জানা যায়, ভারত মহাসাগরে এমডি আব্দুল্লাহ জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর ২৩ নাবিককে একটি কেবিনে আটকে রাখে জলদস্যুরা। বিকাল পাঁচটার পর বন্ধ করে দেয়া হয়েছে জাহাজের ইন্টারনেট সংযোগও। ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে নাবিকদের কাছে থাকা ডলারও। ৪৫০ নটিক্যাল মাইল দূরের সোমালিয়া উপকূলে জাহাজটির যেতে সময় লাগবে প্রায় তিন দিন। সেখানে পৌঁছার পর জলদস্যু দলের নেতাদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে জাহাজ ও তার নাবিকদের ভাগ্য।

এদিকে জলদস্যুদের হাতে জাহাজের নিয়ন্ত্রণ যাওয়ার পর প্রধান কর্মকর্তা আতিক উল্লাহ খান চট্টগ্রামে মালিকপক্ষের কাছে একটি অডিও বার্তা পাঠান।

সেখানে কীভাবে জাহাজটি দস্যুদের কবলে পড়ে তার বর্ণনা দেন তিনি।

আতিকুল্লাহ বলেন, জাহাজে তখন সকাল সাড়ে ১০টা। গ্রিনিচ মান সময় ৭টা ৩০ মিনিট (বাংলাদেশ সময় বেলা দেড়টা)। ওই সময় একটা হাই স্পিডবোট আমাদের দিকে আসতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে আল্যার্ম দিই। আমরা সবাই ব্রিজে গেলাম। ক্যাপ্টেন স্যার আর জাহাজের দ্বিতীয় কর্মকর্তা ব্রিজে ছিলেন তখন। আমরা এসওএস (জীবন বাঁচানোর জরুরি বার্তা) করলাম। ইউকে এমটিওতে (যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশন) যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। তারা ফোন রিসিভ করেনি। এরপর ওরা চলে এল। তারা ক্যাপ্টেন স্যার ও দ্বিতীয় কর্মকর্তাকে ঘিরে ফেলল। আমাদের ডাকল। আমরা সবাই এলাম। এ সময় কিছু গোলাগুলি করল। সবাই ভয় পেয়েছিলাম। সবাই ব্রিজে বসে ছিল। তবে কারও গায়ে হাত দেয়নি।

তিনি আরও বলেন, এ সময় একটা স্পিডবোটে আরও কয়েকজন চলে এল। এভাবে ১৫-২০ জন এল জাহাজটিতে। কতক্ষণ পর একটি বড় ফিশিং ভেসেল এল। ওটা ছিল ইরানের মালিকানাধীন মাছ ধরার জাহাজ, যেটিকে এক মাস আগে তারা জিম্মি করেছিল। মাছ ধরার জাহাজটি দিয়ে তারা সাগরে জাহাজ খুঁজছিল। এখন ওই মাছ ধরার জাহাজ ছেড়ে দেবে। তবে সেটির জ্বালানি ফুরিয়ে গেছে। এখন আমাদের থেকে ডিজেল নিচ্ছে। আমাদের জাহাজটি থামিয়েছে তারা। জাহাজের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। আমাদেরও কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আমাদের পরিবারকে একটু দেখবেন। সান্ত্বনা জানাবেন।

এদিকে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি জাহাজটির নাবিক ও ক্রুদের পরিচয় মিলেছে। তাদের মধ্যে ১১ জন চট্টগ্রামের বাসিন্দা। আর নাবিকদের মধ্যে ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ছাড়াও রয়েছেন বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির সাতজন সাবেক ক্যাডেট। এরা হলেন চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসাইন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এএসএম সাইদুজ্জামান, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিন এবং ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান।

জাহাজটিতে আরও রয়েছেন সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ এবং ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহিম খলিল উল্লাহ। এছাড়া ক্রু হিসেবে রয়েছেন এবি আনোয়ারুল হক, আসিফুর রহমান ও সাজ্জাদ হোসেন, ওএস জয় মাহমুদ, নাজমুল হক ও আইনুল হক, অয়েলার মোহাম্মদ শামসুদ্দিন ও আলী হোসেন, ফায়ারম্যান মোশাররফ হোসেন শাকিল, চিফ কুক শফিকুল ইসলাম, জিএস নূর উদ্দিন এবং ফিটার সালেহ আহমেদ।

কবির স্টিল সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন মেরিটাইম সূত্র ব্যবহার করে দস্যুদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে মঙ্গলবার শেষ পর্যন্ত তাদের সঙ্গে কোন কথা বলার সুযোগ হয়নি। দস্যুরা নাবিকদের কাছ থেকে সব ডিভাইস নিয়ে নেয়ায় তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে ধারণা করা হচ্ছে, সোমালিয়া উপকূলে পৌঁছার পর মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে জলদস্যুরা।

জানা যায়, এসআর শিপিং কর্তৃপক্ষ এখনও পর্যন্ত মধ্যস্থতাকারী কোনো মাধ্যম খুঁজে পায়নি। জলদস্যুরাও এখন পর্যন্ত কোনো বার্তা পাঠায়নি। তবে আগেও যেহেতু এসআর শিপিং এই রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবারও তারা পরিস্থিতি সামাল দেয়ার আশা রাখছে।

কবির গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান কেএসআরএম’র মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, সর্বশেষ মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টার দিকে নাবিকদের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। সব ক্রুকে একটি কেবিনে আটকে রেখেছে জলদস্যুরা। জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সবাই নিরাপদে আছেন।

তিনি আরও বলেন, এস আর শিপিং এর আগেও একবার এমন পরিস্থিতিতে পড়েছিল। ফলে আমরা এবারও পরিস্থিতি ভালোভাবে সামাল দিতে পারবো আশা করছি। জলদস্যুদের সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা চলছে। তবে আমরা এখনও মধ্যস্থতাকারী কোনো মাধ্যম খুঁজে পাইনি।

প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম ভিত্তিক শিল্প গ্রুপ কবির স্টিলসের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এস আর শিপিং। প্রতিষ্ঠানটির অধীনে থাকা ২৩টি জাহাজের মধ্যে সর্বশেষ সংযোজন এমডি আব্দুল্লাহ। ২০১৬ সালে তৈরি এই বাল্ক কেরিয়ারটির দৈর্ঘ্য ১৮৯ দশমিক ৯৩ মিটার এবং প্রস্থ ৩২ দশমিক ২৬ মিটার। গত বছর জাহাজটি এসআর শিপিং কিনে নেয়। এর আগে এটির নাম ছিল গোল্ডেন হক।

২০১০ সালের এই কবির গ্রুপের মালিকানাধীন ‘জাহান মণি’ নামে একটি জাহাজ আরব সাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল। দস্যুরা তখন জাহাজের ২৫ জন নাবিকসহ মোট ২৬ জনকে জিম্মি করে। প্রায় ৩ মাস পর ২৮ লাখ ডলার মুক্তিপণের বিনিময়ে তারা দস্যুদের হাত থেকে ছাড়া পান।