২৩ বছর আগে শ্রীলঙ্কাকেই প্রথম অলআউট করেছিল বাংলাদেশ

সত্যিই কি অবাক করা ঘটনা! ১৯৯৫ সালে যে দেশে, যে দলের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে জয়ের স্বপ্ন দেখছিল বাংলাদেশ, ২৩ বছর পর সেই আরব আমিরাতের দুবাইতে সেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই ধরা দিল অন্যরকম এক জয়।

একদিনের ক্রিকেটে বাংলাদেশ তখন মাত্র শিশু; সবে হাটা শিখছিল। ক্রিকেটের বিশ্ব ও পরাশক্তিগুলোর সাথে তখনকার টাইগারদের শক্তি, সামর্থ্য ও অভিজ্ঞতার ছিল বিস্তর ফারাক।

তখন অস্ট্রেলিয়া, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডের সাথে খেলা মানেই চরমভাবে পর্যদুস্ত হওয়া। জয় ছিল ‘সোনার হরিণ’ বড় দলগুলোর সাথে জয় ছিল আকাশকুসুম কল্পনা। ধরা হতো হারই স্বাভাবিক পরিণতি। সেই হারের ব্যবধানও ছিল বড় বড়; ১০০ প্লাস রান ও ৮-৯ উইকেটে।

তখন সম্মানজনক পরাজয়ই থাকতো মূল লক্ষ্য। টার্গেট ছিল দুটি। ব্যাটিংয়ে সব উইকেট না হারানো, মানে অলআউট না হওয়া। আর প্রতিপক্ষের যত বেশি সম্ভব উইকেটের পতন ঘটানো। কারণ, প্রতিপক্ষকে অলআউট করাও ছিল অনেক কঠিন।

ইতিহাস জানাচ্ছে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা প্রথম ১০ ওয়ানডের কোনো ম্যাচে বাংলাদেশ প্রতিপক্ষকে অলআউট করতে পারেনি। এমনকি ইনিংসের অর্ধেকটার পতনও ঘটানো সম্ভব হয়নি। সর্বোচ্চ ৪ উইকেটের পতন ঘটাতে পেরেছিলেন বাংলাদেশের বোলাররা।

কাকতালীয়ভাবে বাংলাদেশের বোলাররা প্রথম কোন টেস্ট খেলুড়ে দলকে ওয়ানডেতে অলআউট করার কৃতিত্ব দেখায় ১৯৯৫ সালে। আরও উল্লেখ করার মত খবর হলো, এখন যে দেশে এশিয়া কাপ হচ্ছে সেই আরব আমিরাতের মাটিতেই আজ থেকে ২৩ বছর আগে প্রথমবার কোন বড় দলকে অলআউট করেছিল টাইগাররা। ভেন্যু ছিল শারজা। দিনটি ছিল ১৯৯৫ সালের ৬ এপ্রিল।

তখনকার সময়ের উদ্বোধনী বোলার সাইফুল ইসলামের ধারালো সুইংয়ের মুখে ২৩৩ রানে (৪৯.৪ ওভারে) শেষ হয়ে গিয়েছিল অর্জুনা রানাতুঙ্গার লঙ্কান বাহিনীর ইনিংস। মিডিয়াম পেসার সাইফুল ৩৬ রানে পতন ঘটিয়েছিলেন ৪ উইকেটের। স্পিনার মোহাম্মদ রফিক পান দুই উইকেট। পেসার হাসিবুল হোসেন শান্ত আর স্লো মিডিয়াম মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর ঝুলিতে জমা পড়ে একটি করে উইকেট।

ওই ম্যাচে যে চারজন ছিলেন বাংলাদেশের মূল স্তম্ভ- অধিনায়ক আকরাম খান, ওপেনার আতহার আলি খান, দুই মিডল অর্ডার মিনহাজুল আবেদিন নান্নু ও আমিনুল ইসলাম বুলবুল মাঠে বসেই গতকাল (শনিবার) পরবর্তী প্রজন্মের অসাধারণ জয় প্রতক্ষ্য করেছেন।

শ্রীলঙ্কার তখন কি দারুণ ব্যাটিং লাইন আপ; ১৯৯৬ সালে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে প্রথমবার বিশ্বকাপ জেতা দলের বড় অংশই ছিল বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ লঙ্কান একাদশে। অশাঙ্কা গুরুসিংহে, সনাৎ জয়াসুরিয়া, রোশান মহানামা, অরভিন্দ ডি সিলভা, অর্জুনা রানাতুঙ্গা আর হাসান তিলকারাত্নেদের নিয়ে গড়া শক্তিশালী লঙ্কান ব্যাটিং লাইন আপ।

সেই দলকে ২৩৩ রানে থামিয়ে জয়ের স্বপ্ন দেখছিল আকরাম খানের বাংলাদেশ। যেখানে আগের ১০ ম্যাচের প্রতিপক্ষ ইনিংসের ৫ উইকেটের পতন ঘটানো যায়নি, সেখানে আড়াইশ’র নিচে ২৩০-এর ঘরে শ্রীলঙ্কার মত বড় দলকে বেঁধে ফেলে, জয়ের চিন্তা মাথায় আসতেই পারে। বাংলাদেশও সে ম্যাচে অমন জয়ের আশায় ছিল।

কিন্তু সব সময়ের সফলতম অফ স্পিনার মুত্তিয়া মুরালিধরনের (৪/২৩) স্পিন ঘূর্ণিতে সে স্বপ্ন ভেঙে চূরমার হয়ে যায়। জিততে চেয়ে উল্টো ১০৭ রানের বড় ব্যবধানে হেরে যায় বাংলাদেশ।

ইতিহাস শুধু আপনা আপনি ঘুরেই আসে না, বদলও হয়। এবার সেই আরব আমিরাতের দুবাইতে লঙ্কানদের বিপক্ষে ধরা দিল ১৩৭ রানের বিশাল জয়। তখনকার আন্ডারডগ বাংলাদেশ পারেনি; কিন্তু এখন ফেবারিটের তকমা গায়ে নিয়েই সেই আরব আমিরাতের মাটিতে এবার শ্রীলঙ্কাকে হারালো মাশরাফির দল।

বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রায় দুই যুগে শ্রীলঙ্কাকে গুনে গুনে আরও পাঁচবার হারানোর রেকর্ড আছে টাইগারদের। কিন্তু আরব আমিরাতের মাটিতে হারানোর রেকর্ড ছিল না। কি করে থাকবে? ঐ মাটিতে যে আর লঙ্কানদের সাথে টাইগারদের দেখাই হয়নি!

২৩ বছর আগে যার বারুদ ঝরানো বোলিংয়ে শ্রীলঙ্কাকে ২৩৩ রানে অলআউট করেছিল বাংলাদেশ, সেই পেসার সাইফুল ইসলামের মনে আানন্দ আর ধরে না। কাল (শনিবার) বারবার সেই ম্যাচের কথা মনে হয়েছে ময়মনসিংহের ওই পেসারের। ম্যাচ দেখতে বসে ১৯৯৫ সালের ৬ এপ্রিল শারজার ম্যাচের কথা বারবার মনে হচ্ছিলো বর্তমানে বিসিবির বয়স ভিত্তিক কোচিং প্রোগ্রামের কোচ সাইফুলের।

ওই ম্যাচ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সাইফুল বলে ওঠেন, ‘আসলে আমাদের তখন টার্গেট থাকতো অলআউট না হওয়া। প্রতিপক্ষের যত বেশি সম্ভব উইকেটের পতন ঘটানো আর সম্মানজনক পরাজয়। জয়ের ইচ্ছে থাকলেও আসলে শক্তি ও সামর্থ্য ছিল কম। অভিজ্ঞতাও ছিল না একদমই। বড় দলকে হারানোর যে মানসিক দৃঢ়তা, তার অভাব ছিল যথেষ্ঠই।’

‘তারপরও আমার পরিষ্কার মনে আছে, আমরা যখন শারজার মাঠে অর্জুনা রানাতুঙ্গা, অরভিন্দ ডি সিলভা আর সনাৎ জয়াসুরিয়ার দলকে ২৩৩ রানে অলআউট করলাম, তখন প্রথম বারের মত সবার মনে জয়ের ইচ্ছে জেগেছিল।’

বলার অপেক্ষা রাখে না, সাইফুল ওই ম্যাচে শুধু সমীহ জাগানো বোলিংই করেননি। ওই সময় লঙ্কান ব্যাটিংয়ের তিন স্তম্ভ অশাঙ্কা গুরুসিংহে (০), জয়াসুরিয়া (৫১) আর অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গার (৭১) পাশাপাশি চামিন্দা ভাসের উইকেটও দখল করেছিলেন।

আগের ম্যাচগুলোয় টিম প্ল্যান আর রুলস ছিল ৫০ ওভার পুরো খেলা এবং অলআউট না হওয়া। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওই ম্যাচে ড্রেসিংরুমে প্রথম জয়ের চিন্তাভাবনার উদ্রেক ঘটে। টিম মিটিংয়ে বলা হলো, লঙ্কানদের রানটা নাগালের ভিতরে আছে। আমরা মনে হয় জিততেও পারি। ব্যাটসম্যানরা দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের কাজটা দক্ষতার সাথে সম্পাদন করতে পারলে হয়ত ওই রান টপকে জেতা সম্ভব।

কিন্তু সে লক্ষ্য পূরণ হয়নি। লঙ্কান বোলিং ছিল অনেক ধারালো। আামাদের ব্যাটিংটাও এখনকার মত সাজানো গোছানো ছিল না। মানসিক দৃঢ়তার অভাব ছিল। এখন তামিম, মুশফিক, সাকিব ও মাহমুদউল্লাহরা আগের যে কোন সময়ের অনেক বেশি সাহসী। কিভাবে খেললে, ব্যাটিংটা কেমন হলে দল জেতানো যাবে? তা ওরা অনেক ভালই জানে। জয়ের বাসনা প্রবল হবার পাশাপাশি অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সামর্থ্য বেড়েছে বহুগুণে। তাই তো শনিবারের ম্যাচে সেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ওভারে ১ রানে ২ উইকেট হারিয়ে আর তামিম ইকবালের মত ব্যাটিং স্তম্ভ আহত হয়ে সাজঘরে ফেরার পরও সাহস হারায়নি। মুশফিক-মিঠুনরা প্রানপণ লড়ে স্কোরকে ২৬০’র ঘরে নিয়ে গেছে। যা শেষ পর্যন্ত জয়ের জন্য যথেষ্ঠ বলেই প্রমাণ হয়।

‘সত্যি নিজ দেশের, জাতীয় দলের এই এগিয়ে যাওয়া যে কত ভাল লাগার, কত আনন্দের? তা বলে বোঝাতে পারবোনা। খুশিতে-আনন্দে চোখে পানি চলে এসেছে। আর বার বার মনে হয়েছে ২৩ বছর আগে আমরা সম্ভাবনা জাগিয়েও যা পারিনি, বর্তমান প্রজন্ম মাশরাফির নেতৃত্বে কাল সেই না পারার দুঃখ ভুলিয়ে দিল।’ সৌজন্যে : জাগোনিউজ