৭০ হাজার প্রাণের রক্তে লাল হবে চুয়াডাঙ্গা

আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের অনেক উপায় রয়েছে দুনিয়ায়। তারমধ্যে অন্যতম হলো কোনো কিছু ত্যাগ করা। কথায় আছে ভোগে সুখ নাই ত্যাগই প্রকৃত সুখ। আর সেই ত্যাগের মহিমার দিন হলো পবিত্র ঈদুল আজহা। দীর্ঘযুগ ধরে এ দিনটিকে ঘিরে হয়ে আসছে পশু কোরবানীর প্রচলন।

মুসলিম ধর্মের এ পবিত্র দিনে কেউ ছাগল, কেউ গরু বা অন্যান্য পশু কোরবানি দিয়ে আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি লাভ করার কাজে ব্যস্ত থাকে মানুষ। আর সেই পবিত্র ঈদুল আজহার ব্যস্ততম সময় বাকী রয়েছে মাত্র ৪দিন। তারই অংশ হিসেবে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে পশু কোরবানীর প্রচলন। সেই আঙ্গিকে ঈদুল আজহার ২৯, ৩০ জুন ও ১ জুলাই মোট তিনদিনে প্রায় ৭০ হাজার পশুর প্রাণ ঝরবে মোট তিনদিনে। হুজুররা হাতে ভুজালি চাকু নিয়ে ছোটাছুটি করবে রাস্তায় রাস্তায়। যেখানে ডাক দেয়া আছে সেখানে সেখানে পশুর রক্ত ঝরিয়ে পালন করা হবে কোরবানি।

ইতোমধ্যে চুয়াডাঙ্গায় পবিত্র ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর হাট বসেছে চুয়াডাঙ্গার শিয়ালমারী, ডুগডুগি, আলমডাঙ্গা পশুহাটসহ জেলার বিভিন্ন হাটে। দেশের বিভিন্ন অ ল থেকেও কোরবানী দেয়ার লক্ষ্যে বা বিভিন্ন ব্যাপারীরাও পশু কিনতে আসছে চুয়াডাঙ্গায়।
এবারের ঈদুল আজহায় চুয়াডাঙ্গা জেলায় ১ লাখ ৩৮ হাজার ২৫০টি পশু কোরবানী লক্ষ্য রয়েছে। যা চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি রয়েছে।

যার কারণে কোরবানির পশু সংকট হওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই বলে চুয়াডাঙ্গা প্রাণিসম্পদ অধিদফতর থেকে জানা গেছে।

সূত্রটি আরও জানায়, চুয়াডাঙ্গা জেলায় ছোট বড় মিলে মোট ১২ হাজার খামারী রয়েছে। এর মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়েও পশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে অনেকে। যার মধ্যে গরু ও মহিষ ৪৩ হাজার ছাগল ও ভেড়া ৯৩ হাজার পশুর প্রাণ ঝরবে মাত্র ঈদের তিনদিনে।
এদিকে, চুয়াডাঙ্গায় প্রায় ৭০ হাজারের মতো গরু, মহিষ ও ছাগলের চাহিদা রয়েছে। এরমধ্যে গরু ও মহিষ ২০ হাজার এবং ছাগল ৫০ হাজার। উদ্বৃত্ত ২৩ হাজারের মতো গরু, মহিষ ও প্রায় ৫০ হাজার ছাগল ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার চাহিদা মেটাতে পারবে।

তবে, এবার কোরবানির পশু চাহিদার তুলনায় বেশি থাকায় মুখাপেক্ষী হতে হবে না কারো। বরং চুয়াডাঙ্গায় পশুর চাহিদা মিটিয়ে আরও ৭৩ হাজার পশু দেশের বিভিন্ন অ লেও পাঠানো হবে।

ঈদুল আজহা মাত্র ৪দিন বাকী থাকলেও কোরবানির পশু হাটে ক্রেতা বিক্রেতাদের ভিড় থাকলে ক্রেতাদের সংখ্যা তুলনামুলক কম লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলেও জানিয়ে পশু বিক্রেতারা। তারা বলছে, এবার গোখাদ্যসহ বিভিন্ন জিনিসের দাম বাড়ায় এবার পশু দামও একটু বেশি।
ক্রেতারা বলছে, এবার গরুর দাম আগের তুলনায় অনেক বেশি। মাঝারি গরুর দাম ৬৫ থেকে ৮০ হাজার পর্যন্ত গরুর দাম বলা হচ্ছে। যা আগের বছরের তুলনায় ২০-৩০ হাজার টাকা বেশি। এতে করে অনেক ক্রেতারা পশু না কিনে ফিরে আসছে বাড়িতে। আবার অনেকেই বলছেন কোরবানি বলে কথা দাম গত বছরের থেকে বেশি তারপরও কোরবানি তো দিতে হবে। কিন্তু খামারীদের অনেকেই ব্যক্তিগত টাকার পাশাপাশি ঋণ নিয়েও গরু লালন-পালন করেছেন কোরবানি হাটে তোলার জন্য। কিন্তু আশানারুপ দাম না থাকায় দুঃশ্চিন্তায়ও পড়েছে খামারীরা।

আলমডাঙ্গা উপজেলার খামারি শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘কোরবানির ঈদকে টার্গেট করে একবছর ধরে আমরা গরু লালন-পালন করে থাকি। গরু হৃষ্টপুষ্ট ও লালন-পালন করতে নিজেদের ব্যক্তিগতভাবে জমা থাকাসহ বিভিন্ন ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নিতে হয়। প্রস্তুত পশু বিক্রি করে আবার সেসব ঋণ পরিশোধ করা হয়। কিন্তু এ বছরের পরিস্থিতি পুরোটাই ভিন্ন। জেলায় সপ্তাহে চারটি বড় বড় পশুর হাট বসলেও ক্রেতাদের উপস্থিতি কম থাকায় বাধ্য হয়ে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে হচ্ছে গরু।’

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার খামারি মামুন বলেন, কোরবানির এ সময়ে জেলার স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে প্রস্তুতকৃত পশু ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয়। কিন্তু এবার সেসব এলাকায়ও হাটের বাজার খুবই মন্দা। তবে, দাম না পাওয়ায় পশুর হাটে তুলে বাড়তি খরচ করে আবার ফিরিয়ে আনার মতো ঘটনাও ঘটছে অহরহ।’

ডুগডুগি হাটে পশু কিনতে আসা শাহাবুল নামের একজন ক্রেতা বলেন, প্রতিবছর খামার থেকে গরু কিনি। খামার থেকে গরু কিনলে সুবিধা আছে। ঈদ পর্যন্ত গরু খামারে রাখা যায়। বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হয় না। তবে এ বছর গরুর দামটা একটু বেশি।
হাটে গরু কিনতে আসা নাসির উদ্দিন বলেন, কোরবানির জন্য মাঝারি গরু খুঁজছি। এ বছর গরুপ্রতি ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা দাম বেশি মনে হচ্ছে। যেহেতু কোরবানি করতে হবে তাই বেশি দাম দিয়েই গরু কিনতে হবে।
কথা হয় আলমডাঙ্গা পশুহাটের প্রবীণ ব্যাপারী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, কোরবানির সময় জেলার পশুহাটগুলোর মধ্যে আলমডাঙ্গার হাটে সবচেয়ে বেশি গরু আসে। হাটে যে পরিমাণ গরু উঠেছে তার সংখ্যা অনেক বেশি। হাটে ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টাকা দামের গরু রয়েছে। তবে সকাল থেকে চোখে পড়া সবচেয়ে বড় গরুটির মূল্য ধরা হয়েছে ১৭ লাখ টাকা। তবে ক্রেতার সংখ্যা কিছুটা কম।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার সরিষাডাঙ্গা গ্রামের খালেক শাহ জানান, তার খামারে প াশের বেশি ছাগল রয়েছে। তবে তিনি দাম নিয়ে দুঃশ্চিন্তায়স পড়েছে। গতবছরের তুলনায় খরচের সাথে গরু ছাগলের দামও বেড়েছে। এতে করে ক্রেতারা খুব একটা কিনেত খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তাই হাটে নিয়ে ছাগল বিক্রি না করে আবার খামারে ফেরত নিয়ে যাচ্ছি।

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মিহির কান্তি বিশ্বাস জানান, গরু লালন-পালন বাবদ খরচ কমিয়ে আনতে ও স্বাস্থ্যসম্মত গোশত উৎপাদনে দেশীয় পদ্ধতিতে গরু হৃষ্টপুষ্ট করতে খামারিদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। উদ্বৃত্ত পশু বিক্রির জন্য অনলাইন বাজার ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অনলাইনে পশু বেচাকেনার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অনলাইন পশুহাট’ নামে একটি ফেসবুক পেজ খোলা হয়েছে। এখানে জেলার খামারিরা তাদের গরু-ছাগলের ছবি, বর্ণনা, সম্ভাব্য দাম, যোগাযোগের জন্য ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর উল্লেখ করছেন। তবে, ঈদের আগ মুহূর্তে অনলাইনভিত্তিক বেচাবিক্রি বাড়বে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসনের নেজারত ডেপুটি কালেক্টরেট (এনডিসি) সাদাত হোসেন জানান, করোনাকালীন সংক্রমণরোধে ক্রেতা-বিক্রেতাদের পশুর হাটে যেতে নিরুৎসাহিত করা হয়। সেই সময় বিকল্প হিসেবে অনলাইনে পশু বেচাকেনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যেটা এখনো চলমান। তবে প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয়।