দিনমজুর থেকে জ্বীনহুজুর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কালু!
বছরখানেক আগেও দিনমজুরি করে সংসার চালাতেন আবুল ফয়েজ ওরফে কালু মিয়া। বাড়ির পার্শ্ববর্তী বিলে মাছ ধরাও ছিল তার জীবিকা নির্বাহের অন্যতম উৎস। নুন আনতে যার পান্তা ফুরাতো সেই কালু হঠাৎ করে যেন আলাদীনের চেরাগ পেয়েছেন।
টিনের ছোট্ট ঘরের জায়গায় এখন উঠেছে দালান ঘর। সেই ঘরে রয়েছে দামি ফার্নিচার, এলইডি টেলিভিশন ও রেফ্রিজারেটরসহ নানা আসবাবপত্র। গ্রামে বিদ্যুৎ না থাকলেও কালুর ঘরে লাগানো হয়েছে সাতটি সোলার প্যানেল।
কালু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার পত্তন ইউনিয়নের আদমপুর গ্রামের মৃত আবদুল হাসিমের ছেলে।
কালুর স্ত্রী ময়না বেগমের দাবি, স্বামী-স্ত্রী দুজনই বিদেশে চাকরি করেছেন। বিদেশে থেকেই তারা টাকা-পয়সার মালিক হয়েছেন।
তবে গ্রামবাসী ময়না বেগমের এ দাবি সাঠিক নয় বলে জানিয়েছেন। গ্রামের সব মানুষ যখন দিনমজুর কালুর দিনবদলে হতবাক, তখন নিজেকে জ্বীনহুজুর দাবি করে জ্বীনের মাধ্যমে সম্পদের মালিক হওয়ার ‘কাল্পনিক গল্প’ শুনিয়েছেন কালু।
তার বিরুদ্ধে প্রতিবেশী ৬০ বছরের বৃদ্ধ সতেন্দ্র শীলের কাছ থেকে প্রলোভন দেখিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে গত ৩ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে কালুর বিরুদ্ধে মামলাও ঠুকেছেন ভুক্তভোগী সতেন্দ্র শীল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এক বছরের ব্যাবধানে কালুর আর্থিক স্বচ্ছলতা গ্রামের সবার নজর কাড়ে। গ্রামে কালু প্রচার করেন যে তিনি এক জ্বীনের হদিস পেয়েছেন। সেই জ্বীনই তাকে প্রচুর অর্থ-কড়ির মালিক বানিয়ে দিয়েছেন। কালুর ঘরে ‘জ্বীন’ বসার জন্য একটি বিশাল সোফা আকৃতির চেয়ারও রয়েছে। গ্রামের কেউ কেউ কালুর জ্বীনহুজুরের গল্প বিশ্বাসও করেন।
তেমনি একজন প্রতিবেশী সতেন্দ্র শীল। সতেন্দ্রর বাড়িতে নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল কালুর। নিজেকে জ্বীনহুজুর দাবি করে সতেন্দ্র ও তার ছেলে তপন শীলকে প্রলোভন দেখান এক কোটি টাকা দিলে অল্প দিনে শত কোটি টাকার মালিক বানিয়ে দেয়ার। এ কথা কাউকে না জানানোরও শর্ত দেন কালু। সতেন্দ্র ও তপন সেই প্রলোভনে পড়ে জায়গা-জমি ও স্বর্ণালংকার বিক্রি করে কালুকে কয়েক দফায় এক কোটি টাকা দেন।
সতেন্দ্রর করা মামলার এজহারে বলা হয়েছে, দুই দফা সতেন্দ্রর কাছ থেকে নগদ এক কোটি টাকা ও ১৬ লাখ টাকার স্বর্ণালংকার নেন কালু। প্রথম দফায় গত ২ জুন নগদ এক কোটি টাকা দেন সতেন্দ্র। দ্বিতীয় দফায় গত ১০ আগস্ট তপনকে তার মালিকানাধীন ‘বিষ্ণু স্বর্ণ শিল্পালয়ে’ নিয়ে গিয়ে শত কোটি টাকা চলে এসেছে জানিয়ে দোকানে থাকা সব স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে যান কালু। এ ঘটনার পর থেকে তপনের কোনো খোঁজ মিলেনি।
কালু অসৎ উদ্দেশ্যে তপনকে অপহরণ করেছে উল্লেখ করে এ ঘটনায় কালু ও তার শ্বশুর মাসুম মিয়ার বিরুদ্ধে বিজয়নগর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন সতেন্দ্র।
পরবর্তীতে পুলিশের সঙ্গে আসামি পক্ষের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ‘অপহৃত’ তপন ও হাতিয়ে নেয়া এক কোটি টাকা এবং ১৬ লাখ টাকার স্বর্ণালঙ্কার ফিরিয়ে দেবে তারা। কিন্তু দেবো-দিচ্ছি করতে করতে এক পর্যায়ে তপনকে অপহরণ ও টাকা হাতিয়ে নেয়ার কথা অস্বীকার করে আসামিরা।
ভুক্তভোগী সতেন্দ্র জানান, জ্বীনহুজুর কালু আমাকে বলেছে আমি এক কোটি টাকা দিলে আমাকে কোটি কোটি টাকা দেবে। আমি লোভে পড়ে নিজের সব বিক্রি করে আর আমার মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে কালুকে টাকা এনে দিয়েছি। টাকা দেবে বলে আমার ছেলেকে স্বর্ণালঙ্কারসহ দোকান থেকে নিয়ে গেছে কালু। এখন আমি টাকাও হারিয়েছি, ছেলেও হারিয়েছি। আমি আমার ছেলেকে ফেরতসহ কালুর বিচার চাই।
এ বিষয়ে আদমপুর গ্রামের ইউপি সদস্য আবদুল হাকিম ভূইয়া বলেন, আমরা চেষ্টা করছি বিষয়টি মিমাংসা করার জন্য। তবে মামলা দায়েরের পর থেকে কালু গা ঢাকা দিয়েছে।
এদিকে সতেন্দ্রর দায়ের করা মামলার পর কালুও তার স্ত্রীকে দিয়ে সতেন্দ্র ও তার স্বজনদের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা দায়ের করেছেন। কালুর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে শনিবার দুপুর আদমপুর গ্রামে কালুর বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি।
তবে বাড়িতে থাকা কালুর স্ত্রী ময়না বেগম সাংবাদিকদের বলেন, তার স্বামী কালু কোনো জ্বীনহুজুর নয়। সতেন্দ্র শীল যে মামলা করেছেন কালুর বিরুদ্ধে সেটিও মিথ্যা। কালু সতেন্দ্রর কাছ থেকে কোনো টাকা নেয়নি এবং তার ছেলে তপনকেও অপহরণ করেনি। মামলার কারণে কালু বাড়িছাড়া বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিজয়নগর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নবীর হোসেন বলেন, বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। আসামি কালুকে গ্রেফতারসহ অপহৃত তপনকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন