ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রস্তাব কি গ্রহণযোগ্য হবে?

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা জারেড কুশনার জানিয়েছেন, তিনি মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছেন। ফিলিস্তিনের নেতা মাহমুদ আব্বাস যদি সে প্রস্তাবে সম্মত না হন, তাহলে তাঁর সমর্থন ছাড়াই প্রস্তাবটি প্রকাশ করা হবে। কুশনারের দৃঢ়বিশ্বাস, প্রস্তাবটি এত চমৎকার যে ফিলিস্তিনিরা তা লুফে নেবে। আর তখন বিপদে পড়বেন আব্বাস নিজে।

গত সপ্তাহে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ সফর শেষে একটি ফিলিস্তিনি পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে কুশনার এ কথা বলেন। জানা গেছে, শুধু ফিলিস্তিন প্রশাসন নয়, মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশ আব্বাসের সম্মতি ছাড়া এই প্রস্তাব প্রকাশ না করার বিপক্ষে। ইসরায়েলি দৈনিক হা’রেৎস জানিয়েছে, আরব নেতারা মনে করেন, এই প্রস্তাব প্রকাশিত হলে তা এই অঞ্চলের অস্থিরতা আরও বাড়াবে।

উল্লেখ্য, ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ কুশনারকে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দিতে দায়িত্ব দেন। তিনি নিজে বিশ্বাস করেন, গত ৭০ বছরে বারবার চেষ্টা সত্ত্বেও অন্য সব মার্কিন প্রেসিডেন্ট যা পারেননি, তিনি তা করে দেখাবেন। এটি হবে তাঁর ভাষায়, ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি,’ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি।

চুক্তির বিষয়বস্তু কুশনার জানাননি। তবে অন্যান্য মাধ্যমে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে উদ্বিগ্ন মাহমুদ আব্বাস গত ডিসেম্বরে সলাপরামর্শের জন্য সৌদি আরবে ছুটে যান। ইরানকে ঠেকানোর লক্ষ্যে সৌদি আরব ইতিমধ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে নিরাপত্তা প্রশ্নে এক অলিখিত চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। এই কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সৌদি বাদশাহর ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমান। নিউইয়র্ক টাইমস-এর তথ্য অনুসারে, বিন সালমান আব্বাসকে জানান যে একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হবে, কিন্তু পরস্পরের লাগোয়া নয় এমন ভূমির ওপর। ইতিমধ্যে অধিকৃত আরব ভূমির ওপর যে বিপুলসংখ্যক অবৈধ ইহুদি বসতি গড়ে উঠেছে, তার অধিকাংশই রয়ে যাবে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে। আর তাদের পাশ কাটিয়ে নতুন রাষ্ট্রটি গঠিত হবে। কোথায় এই রাষ্ট্রের রাজধানী হবে সে কথা অজ্ঞাত। তবে পূর্ব জেরুজালেমে হবে না, সে কথা বিন সালমান আব্বাসকে জানিয়েছেন। ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের নিজ দেশে ফিরে আসার দাবিও এই পরিকল্পনায় নেই বলে জানা গেছে। এই খবর প্রকাশের পর হোয়াইট হাউস থেকে অবশ্য দাবি করা হয়েছিল খবরটি সঠিক নয়, পরিকল্পনা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

কুশনারের পরিকল্পনার খবর জানাজানি হলে আব্বাস এতটা ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন যে তিনি সব মার্কিন প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন। তাঁর অভিযোগ, ট্রাম্প প্রশাসন খোলামেলাভাবে ইসরায়েলের পক্ষ গ্রহণ করেছে। ফলে নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কোনো ভূমিকা পালনের যোগ্যতা তাঁরা হারিয়েছেন। সে কথা যে মোটেই বাহুল্য নয়, তার প্রমাণ হিসেবে সম্প্রতি হোয়াইট হাউস সব আন্তর্জাতিক আইনের বিরোধিতা করে পশ্চিম জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর সম্পন্ন করে।

অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মনে করেন, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সম্মতি ছাড়া কোনো শান্তি পরিকল্পনা প্রকাশ বড় ধরনের ভুল হবে। সেন্টার ফর নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির সিনিয়র ফেলো ইলান গোল্ডেনবার্গ মনে করেন, কোনো অসম্পূর্ণ প্রস্তাব পেশের বদলে এখন অনেক জরুরি হলো গাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা। গত মাসে ইসরায়েলের বোমা হামলার পর অঞ্চলটি চূড়ান্ত অস্থিরতায় ভুগছে, পরিস্থিতি যেকোনো সময়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

গোল্ডেনবার্গ ফরেইন অ্যাফেয়ার্স পত্রিকায় লিখেছেন, কুশনার যে প্রস্তাব রেখেছেন, তা ইসরায়েলের স্বার্থ রক্ষা করেই বানানো হয়েছে। এই পরিকল্পনা অনুসারে পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা ঘোষিত হলেও সেখানে অনির্দিষ্টকালের জন্য ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী অবস্থান করবে। তা ছাড়া ফিলিস্তিনের জন্য নির্ধারিত ভূমির ৬০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করবে ইসরায়েল। পশ্চিম তীরের বদলে এই নতুন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের কেন্দ্র হবে গাজা। ইসরায়েল এই প্রস্তাবে আহ্লাদিত হলেও ফিলিস্তিনিদের কাছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না বলে মনে করেন গোল্ডেনবার্গ।

আটলান্টিক পত্রিকাতে প্রকাশিত লেখায় এমন সিদ্ধান্তেই পৌঁছেছেন দুই মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ফিলিপ গর্ডন ও প্রেম কুমার। তাঁরা কুশনারের পরিকল্পনাকে ‘বিপর্যয়’ বলে অভিহিত করে বলেছেন, ট্রাম্প হোয়াইট হাউস কল্পনার স্বর্গে বাস করছে। আব্বাসকে এড়িয়ে এই পরিকল্পনা সরাসরি ফিলিস্তিনি জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়ার যে হুমকি কুশনার দিয়েছেন, তা বাস্তবায়িত হলে হিতে বিপরীত হবে। আব্বাস জনপ্রিয় নন—এ কথা ঠিক, কিন্তু যে প্রস্তাবে তাঁদের আইনসম্মত জমির ৬০ শতাংশ ইসরায়েলের অধিগ্রহণে থাকবে তা তাঁরা সমর্থন করবেন, সে কথা ভাবার কোনো কারণই নেই। বস্তুত, এই দুই বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, ৫৭ শতাংশ ফিলিস্তিনি মনে করেন, অবৈধ ইসরায়েলি বসতির কারণে ‘দুই-রাষ্ট্র পরিকল্পনা’ আর বাস্তবসম্মত নয়।

১৮ মাস ধরে কুশনার ও তাঁর পরামর্শদাতারা মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় প্রকৃত বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। সৌদি আরবের কাছ থেকে উৎসাহ পেলেও জর্ডান বা মিসরের কাছ থেকে কোনো সরাসরি সমর্থন তিনি পেয়েছেন, তা মনে হয় না। তারপরও কুশনার ও ট্রাম্প কেন এই প্রস্তাব নিয়ে পীড়াপীড়ি করছে?

বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, ট্রাম্প প্রমাণ করতে চান শান্তি প্রতিষ্ঠায় তিনি চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের অনাগ্রহের কারণে সে চেষ্টা সফল হয়নি। ব্যর্থতার দায়ভার তাঁর নয়, ফিলিস্তিনিদের। সে যুক্তির প্রাথমিক ক্ষেত্র ইতিমধ্যে প্রস্তুত করে রেখেছেন কুশনার। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, আব্বাসের লক্ষ্য শান্তি নয়, নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব।