সিরিয়া থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার কি শান্তি ফিরিয়ে আনবে?

ডিসেম্বর মাসের শেষ কয়টা দিন সিরিয়ায় অনেক নাটকীয়তার জন্ম দিল। ১৪ ডিসেম্বর ফোনালাপ হচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল ট্রাম্প আর তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগানের মধ্যে।

এরদোগান ট্রাম্পকে সিরিয়া থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য তাগাদা দিচ্ছিলেন। জবাবে ট্রাম্প এরদোগানকে জিজ্ঞেস করেন, আমরা যদি সৈন্য প্রত্যাহার করি আপনি কি আইএসআইএসকে নির্মূল করতে পারবেন?

উত্তরে এরদোগান বলেন যে তুরস্কের সামরিক শক্তিই আইএসআইএসকে নির্মূলে যথেষ্ট। তারপর ট্রাম্প হুট করেই ঘোষণা দিলেন তিনি সিরিয়া থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন।

সংবাদটি যুদ্ধবিদ্ধস্ত মধ্যপ্রাচ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।

একদিকে যেমন কিছু দেশ সিদ্ধান্তটিকে স্বাগত জানিয়েছে অন্যদিকে এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়েছে অনেক দেশ ।

এই সিদ্ধান্তে রাশিয়া, ইরান এবং তুরস্ক খুব বেশি খুশি হয়েছে। অন্যদিকে ইসরাইল, ফ্রান্স আর উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত কুর্দি বাহিনী ও ওয়াইপিজি এ সিদ্ধান্তে হতভম্ব হয়েছে।

রাশিয়া এবং ইরান সিরীয়া যুদ্ধের শুরু থেকেই প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। আর তুরস্ক ঘোর আসাদ বিরোধী।

ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি হতাশ হয়েছে ওয়াইপিজি বা কুর্দি গেরিলা গ্রুপ যাদেরকে তুরস্ক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে। আমেরিকান সেনাবাহিনী ওয়াইপিজিকে আইএসআইএস সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করতো। আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পেন্টাগন ওয়াইপিজিকে সামরিক প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে ট্যাঙ্ক ধ্বংসের যন্ত্র পর্যন্ত প্রচুর ভারি অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করে।

২২ হাজার ট্রাক অস্ত্র সরবরাহ

তুরস্কের সরকারি হিসাব অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ পর্যন্ত ২২ হাজার ট্রাক অস্ত্র আর ৫ হাজার মালবাহী বিমান ভর্তি সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে এ গ্রুপটিকে।

তুরস্ক এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই ওয়াইপিজি কে পিকেকে সিরিয়ার শাখা হিসেবে দেখে। তুরস্ক উভয় বাহিনীকেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মনে করলেও আমেরিকা শুধু পিকেকে সন্ত্রাসী সংগঠনের আওতায় ধরে ওয়াইপিজিকে এর বাইরে রাখছে এবং এই বাহিনীর সঙ্গে দহরম মহরম সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে।

পেন্টাগনের গোয়ার্তুমির কারণে আমেরিকা -ওয়াইপিজি সম্পর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে একসময় মনে হয়েছিল আমেরিকান সৈন্যরা ওয়াইপিজি রক্ষা করার জন্য হয়তো ন্যাটো NATO জোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তি তুর্কি সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হবে।

কিন্তু ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের কারণে ওয়াইপিজি আমেরিকার উপর এতোটাই ক্ষুব্ধ যে তাদের কাছে বন্দি আইএসআইএস সন্ত্রাসীদের আমেরিকায় হামলা করার জন্য লেলিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছে।

এর পরে আছে ইসরাইল। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তের পেছনে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগানকে দায়ী করছেন।

তিনি এতটাই ক্ষিপ্ত যে এরদোগানকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেও ক্ষান্ত হননি।

তবে এই সিদ্ধান্তের পেছনে এরদোগান যে মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন তা এখন অনেকটাই স্পষ্ট।

ট্রাম্প নিজেই স্বীকার করেছেন যে তিনি এই সিদ্ধান্ত তুর্কি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেই নিয়েছেন।

তিনি আরো বলেন, ন্যাটোর দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক শক্তির অধিকারী দেশ তুরস্কের সিরিয়াতে আইএসআইএসের বাকি যেটুকুটু অবশিষ্ট আছে তা শেষ করতে সক্ষম।

ট্রাম্প সিরিয়া থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ইচ্ছা প্রায় এক বছর আগেই জানিয়েছিলেন। কিন্তু পেন্টাগনে তার সামরিক কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে বার বার পিছিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন।

যদিও এটা এখনো স্পষ্ট নয় ট্রাম্প কেন হুট করে এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিলেন। এর পিছনে তুরস্কের কাছ থেকে কি ধরণের সুযোগ সুবিধা নিবেন।

যদি সত্যি সত্যিই সিরিয়া থেকে মার্কিন সৈন্য উঠিয়ে নেওয়া হয় তবে সেটা তুর্কি নেতা এরদোগানের মধ্যপ্রাচ্যে কৌশলগত বিজয় হিসেবে ধরে নেওয়া হবে। এর প্রভাব আগামী মার্চের তুরস্কের স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও পড়বে।

সিরিয়াতে এখন সবাই নতুন করে ছক সাজানোর চেষ্টায় ব্যাস্ত। রাশিয়া সিরিয়ায় একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। রাশিয়া এখন মূল খেলোয়াড়ের ভূমিকায়।

ওয়াইপিজি রাশিয়া এবং সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার-আল-আসাদ এর সঙ্গে ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করছে। তুরস্কের সম্ভব্য সামরিক হামলা থেকে নিজেদের পিঠ বাঁচানোর জন্য কুর্দি গেরিলা বাহিনীর অন্য কোনো বিকল্প নেই।

ট্রাম্প মাঠ খালি করার কারণে একই সঙ্গে তুরস্ক, রাশিয়া, ইরান এবং আসাদ সরকার সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নিজেদের ভিত মজবুত করতে উঠে পরে লেগেছে। তুর্কি তো ওই এলাকায় সামরিক অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েই দিছে।

তুরস্ক এর আগেও সিরিয়াতে দুইবার সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে। একবার আইএসআইএস এর বিরুদ্ধে আরেকবার ওয়াইপিজি এর বিরুদ্ধে। দুটি অভিযানেই নিজের সামরিক শক্তিমত্তার প্রকাশ ঘটিয়েছে।

এই দুই অভিযানে রাশিয়া বা আমেরিকা যুক্ত না থাকলেও উভয় পরাশক্তির নীরব সমর্থন ছিল।

তবে আঙ্কারা এবার যে সামরিক অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা করছে, তাতে আমেরিকা, রাশিয়া ছাড়াও আসাদ সরকার আর ইরানের নীরব সমর্থনের দরকার হবে।

ওয়াইপিজি এক্ষেত্রে কার আঁচলের তলে আশ্রয় নেয় সেটাই দেখার বিষয়। রাশিয়া এবং আসাদ সরকার কুর্দি বাহিনীকে অনেক আগে থেকেই তলে তলে সমর্থন দিয়ে আসছে। মস্কো দীর্ঘদিন ধরে ওয়াইপিজি -আমেরিকার সুখের ঘরে ভাঙ্গন ধরিয়ে কুর্দি বাহিনীকে নিজের কোলে বসানোর চেষ্টায় ছিল। এখন সেই মোক্ষম সময়। রাশিয়া কি এই সুযোগ হাতছাড়া করবে?

ওয়াইপিজি বড় কোনো দেশের সহায়তা ছাড়া তুর্কির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবেনা এটা যেমন সত্য, তুর্কিও উপরল্লেখিত দেশগুলোর সরাসরি বা নীরব সমর্থন ছাড়া সিরিয়াতে নতুন কোনো অভিযান চালাবেনা।

আঙ্কারা এখন মস্কো ও ওয়াশিংটনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত। তুরস্কের গোয়েন্দাপ্রধান ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী গত সপ্তাহে মস্কো সফর করেছেন। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্মকর্তারা কয়েক দিনের মধ্যে তুরস্কে আসছেন।

তুরস্কের সেনাবাহিনী প্রতিদিনই সিরিয় সীমান্তে সামরিক যানবাহন, গোলাবারুদ এবং সেনাদের উপস্থিতি বৃদ্ধি করছে।

মস্কো এবং ওয়াশিংটন থেকে সবুজ সংকেত পেলেই শুরু হবে তুরস্কের আরেকটি সামরিক অভিযান।

তবে রাশিয়া যদি তুরস্কের পরিবর্তে কুর্দি বাহিনী ওয়াইপিজিকে সমর্থন দেয় তবে সিরিয়াতে শুরু হবে নতুন মেরুকরণ। মার্কিন যুক্তরাষ্টের মদ্ধপ্রাচ্য নীতি আরো বেশি হুমকির মুখে পড়বে।

লেখক : সারওয়ার আলম, ডেপুটি চিফ রিপোর্টার-নিউজ পাবলিশার, আনাদলু এজেন্সি, তুরস্ক