একুশ বছরের বশেমুরবিপ্রবিকে যেভাবে মূল্যায়ন করছেন শিক্ষকবৃন্দ

গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরবিপ্রবি) একুশ পেরিয়ে ২২ বছরে পদার্পণ করেছে। শুক্রবার (৮ জুলাই) ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির কতটুকু পূরণ করতে পেরেছে এই বিদ্যাপীঠ,একুশ বছরের বশেমুরবিপ্রবিকে কিভাবেই বা মূল্যায়ন করছেন শিক্ষকরা, তা জানাচ্ছেন বশেমুরবিপ্রবি প্রতিনিধি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. হাসিবুর রহমান বলেন, ৮ই জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। সে হিসেবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স একেবারে কম নয়। প্রায় ২২বছর।কিন্তু কার্যকরী অর্থে বয়স মাত্র ১১ বছর। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে অনিবার্যভাবে ব্যবধান রয়েছে। কার্যকরী অর্থে বয়স যত বাড়বে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিও তত বাড়বে বৈকি। তবে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সে গন্তব্যে পৌছার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু পূর্বশর্তের উপস্থিতি প্রয়োজন। প্রশ্ন এখানেই সে পূর্বশর্তের যোগান এ বিশ্ববিদ্যালয় ছিল কিনা, এখন আছে কি না?
ভবিষ্যতে থাকবে কি না? আশার কথা হলো শেষ বিশ্লেষণে বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু জ্ঞান উৎপাদন, নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও বিতরণের স্থান, সেহেতু সকল অচলায়তন ভেঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌছবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। কখন সে অচলায়তন ভাঙ্গবে? কে এই অচলায়তন ভাঙ্গার নেতৃত্ব দিবে সে প্রশ্নটিও সামনে নিয়ে আসা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় অংশীজন হলো শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। তারাই সে প্রত্যাশা অর্জনের নেতৃত্ব দিবে এটাই স্বাভাবিক। সর্বশেষে যে কথাটি বলা প্রয়োজন সেটি হলো সময়ের প্রেক্ষিতেই মানুষের নিকট সব কিছু বোধগম্য হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান, সহযোগী অধ্যাপক ড. মোঃ কামরুজ্জামান বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সপ্তম রিজেন্ট বোর্ডের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ৮ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয।২০০১ সালের এই দিনে জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়।সে হিসেবে প্রতিষ্ঠার একুশ বছর পেরিয়ে গেলেও শিক্ষা কার্যক্রমে বারো বছরে পদার্পণ হচ্ছে বশেমুরবিপ্রবির। জাতির জনকের নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই অনেক বাঁধার সম্মুখীন।৫৫ একরের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যার শেষ নেই।তবুও ধীরে ধীরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরসহ সকলের চেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য প্রয়োজন সকলের সম্মিলিত চেষ্টা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা, তাঁদের প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি একসময় দেশসেরা বিদ্যাপীঠ হয়ে উঠবে। বর্তমান প্রশাসন সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। শত সীমাবদ্ধতাকে পেছনে ফেলে শিক্ষক ছাত্র সকলে মিলে একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালযয়ের বাইশ বছর পদার্পণে আমাদের সকলের অঙ্গীকার হোক বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে আমরা আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।

ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বলেন, প্রতিষ্ঠার ২১ বছর পূর্ন হলেও কার্যক্রম শুরুর ১২ বছর।তদুপরি জাতির জনকের পুন্যভূমিতে এবং তারই নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে আমি বলবো যা কিছু প্রাপ্তি তা অনিয়ম ও অপ্রাপ্তিতে ম্লান হয়ে গিয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যার সরকারের সময়েও নীতি নির্ধারক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নে নির্লিপ্ততা দেখিয়েছে এবং দেখাচ্ছে। ৩৪ টি বিভাগ , ১২০০০ শিক্ষার্থীর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রো-ভিসি নেই, ট্রেজারার নেই, রেজিস্টার নেই, প্রকল্প পরিচালক নেই, হিসাব পরিচালক নেই, সিনিয়র শিক্ষক নেই, অপ্রতুল বাজেট, অবকাঠামো সংকট- বলতে গেলে নেই আর নেই।

এভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারেনা, যার দরুন এখানে প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো ঝামেলা বিরাজমান, – ক্লাস রুম নিয়ে সংঘর্ষ, একাডেমিক – প্রসাসনিকে তালা, স্বাভাবিক প্রশাসনিক কাজে স্থবিরতা । একা একজন ভাইস চ্যান্সেলর সব কিছু করতে পারেন না, যদি তা তার পুরো প্রশাসনিক কাঠামো না থাকে। আমার প্রত্যশা থাকবে অতি দ্রুত ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সহ সংশ্লিষ্ট সকলে এই বিষয়গুলো আমলে নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতিকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখবে।

পরিসংখ্যান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাকলী খাতুন বলেন, বঙ্গবন্ধুর পূণ্যভূমিতে তারই নামে নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয়টি ২২ বছরে পদার্পণ করেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় আমার প্রিয় আঙিনা, জ্ঞান চক্ষু উন্মোচনের নতুন দ্বার। শিক্ষার গুনগত মান ও পরিবেশ উন্নয়ন এবং গবেষণা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বশেমুরবিপ্রবিতে সঠিক পরিচালনার অভাববোধ করি। কিন্তু তারপরও প্রায় দুই যুগ ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টি এই অঞ্চলকে যা দিয়েছে তা কোনমতেই অকিঞ্চিতকর নয়। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্য হলো জ্ঞানের সৃষ্টি ও বিতরণ যার উপর নির্ভর করে দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি। এক্ষেত্রে বশেমুরবিপ্রবি সাম্প্রতিক সময়ে বেশ এগিয়েছে। শিক্ষার্থীরা সাফল্য দেখাচ্ছে কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষকরা গবেষণা ও উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে, যা শিক্ষার মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। তবে সমস্যাটা হল এইসব সাফল্য অর্জন করতে শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের বেশ বেগ পেতে হয়। অনেকে চাইলেও সু্যোগ করে উঠতে পারেনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানাবিধ সমস্যার কারনে। শিক্ষকের অপ্রতুলতা ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় একজন শিক্ষার্থীর যতটুকু পরিচর্যা প্রয়োজন সেটুকু হয়ত দেয়া সম্ভব হয় না।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকটগুলোর সমাধান হওয়া সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। বিশেষ করে মানসম্মত গবেষণা বৃদ্ধি, আবাসিক সমস্যার সমাধান, লাইব্রেরি বর্ধিতকরণ হলে বশেমুরবিপ্রবি অগ্রযাত্রায় নতুন মাত্রা লাভ করবে বলে বিশ্বাস করি। বশেমুরবিপ্রবি নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখি। মানুষ তৈরির কারখানা এই প্রতিষ্ঠানটি একদিন জ্ঞান, গবেষণায় অনুকরণীয় হয়ে উঠবে।শিক্ষাদান ও গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষক শিক্ষার্থীর মধ্যে অটুট বন্ধন গড়ে উঠুক। আমাদের শিক্ষার্থীরা অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও সর্বপরি ভাল মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক এই প্রত্যাশা সর্বদা।

কৃষি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এস.এম. আহসান বলেন, ২০১১ সালে কার্যক্রম চালু হয় বশেমুরবিপ্রবির।বাইশ বছরে পদার্পণ করেছে প্রিয় বশেমুরবিপ্রবি। খুব দ্রুততার সাথে অনেক যুগোপযোগী বিভাগ খোলা হলেও এর সাথে তাল মিলিয়ে আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি ছাত্রদের গবেষণাভিত্তিক পড়াশোনা করার জন্য সকল সুযোগ সুবিধা। এর প্রধান কারণ ছাত্রসংখ্যা অপরিকল্পিতভাবে বাড়ানো। শিক্ষার্থীদের সীমিত আবাসিক ব্যবস্থার কথা চিন্তা না করেই আসন সংখ্যা বাড়ানো হয়। প্রায় ৮০ ভাগ শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের বাইরে অবস্থান করে। শিক্ষার্থীদের গবেষণায় অগ্রগামী করতে হলে শিক্ষার্থীদের জন্য গড়ে তোলা প্রয়োজন জার্নাল ক্লাব এবং ইন্টারনেট ভিত্তিক জার্নাল এক্সেস। অথচ এই সুবিধা নিশ্চিত করণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং শিক্ষক সংগঠনগুলোকে কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় কখনই দেখা যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়টির সম্ভাবনা অনেক। পদ্মাসেতুর খুব কাছাকাছি হওয়ায় এই বিশ্ববিদ্যালয়টি হতে পারে দক্ষিণবঙ্গের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যাপীঠ। সেজন্য চাই কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। যেমন, ক্যাম্পাসের মধ্যে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর আবাসিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করন, গবেষণা বরাদ্দ বাড়ানো, লাইব্রেরীতে ভালো বই বাড়ানোর পাশাপাশি সব বড় জার্নালের ইনস্টিটিউশনাল অ্যাক্সেস নিশ্চিত করা সব শিক্ষক ও ছাত্র ছাত্রীদের জন্য। আন্ডারগ্রাজুয়েট থেকে তত্বালোচনা চালু করা, সব বিভাগগুলোকে যুগোপযোগী করা,ডাটা এনালাইসিস এর আপডেট সফটওয়্যার গুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থে কিনে সেগুলো শিক্ষার্থীদের এক্সেস দেওয়া এবং ডাটা এনালাইসিস, এমএস ওয়ার্ড, পাওয়ারপয়েন্ট, গ্রাফিক্সের জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে শিক্ষার্থীদের সরকারি ও বেসরকারি সব ধরনের চাকরি ক্ষেত্রে এগিয়ে নেয়া,অবশ্যই সিলেবাস কমিটিগুলোতে রাখা হোক দেশ সেরা সব ভালো গবেষকদের। শিক্ষকদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক আলোকে নয়।