খাগড়াছড়ির পানছড়িতে আওয়ামীলীগ নেতার ৩টি কালভাটের রড লুটের অভিযোগ

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পানছড়ি উপজেলাতে আওয়ামীলীগ নেতার ৩টি কালভার্টের রড লুটের অভিযোগ, অডিও ফাঁস হয়েছে। সেতুর রড চুরি, নির্দোষ ব্যক্তিকে ফাঁসানোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

জেলার পানছড়ির সীমান্ত সড়কে দিনের আলোতে সরকারি অর্থায়নে নির্মিত তিনটি কালভার্ট ও ব্রিজের রড লুটের ঘটনার নতুন মোড় নিয়েছে। ইতোমধ্যে জেলার আলোচিত ঘটনাটির একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

এ ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনার মূল নায়ক খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ন সাধারন সম্পাদক ও ঠিকাদার উত্তম কুমার দেব।

ঘটনায় স্বপ্রণোদিত হয়ে আদালতের নির্দেশে মামলাটির তদন্ত করছে ডিবি পুলিশ। অডিওটি এই মামলায় ‘ডকুমেন্ট’ হিসেবে যুক্ত করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

৫মিনিট ৫২সেকেন্ডের অডিওতে চারজনের কথোপকথন শোনা যায়। অডিওতে রড চুরির ঘটনায় নাজমুল নামের এক ব্যক্তিকে পুলিশের কাছে মিথ্যা তথ্য দিতে বলা হয়। এর জন্য তাকে ২০লাখ টাকা দেওয়াসহ পালিয়ে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে জয়নাথ দেব নামের স্থানীয় এক আওয়ামীলীগ নেতাকে ফাঁসানোর বিষয়টি ওঠে আসে।

জয়নাথ দেব জেলা আওয়ামীলীগের সদস্য। চারজনের কথোপকথনের মধ্যে নাজমুল ছাড়া অপর দুইজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন, পানছড়ি উপজেলা আওয়ামীলীগ যুগ্ন সম্পাদক ও ঠিকাদার উত্তম কুমার দেব ও পানছড়ি ৫নং নম্বর ওয়ার্ড সদস্য জব্বার হোসেন। মিথ্যা তথ্য দিয়ে ফাঁসাতে চাওয়া নাজমুল পেশায় অটোরিকশা চালক বলে জানা গেছে।

ফাঁস হওয়া অডিওর শুরুতে এক ব্যক্তি নাজমুলের সঙ্গে জব্বার হোসেনের কথা বলিয়ে দেন। তখন জব্বার হোসেন নাজমুলকে শিখিয়ে দেন পুলিশকে তিনি যেন বলেন, জয়নাথ দেব তার কাছে চুরি যাওয়া রডগুলো ৪০টাকা দরে বিক্রি করেছেন। তিনি জয়নাথ দেবের তালুকদার পাড়া বাসা থেকে অটোতে করে রডগুলো নিয়ে আসেন। কোনোভাবে উত্তমের নাম বলতে বারণ করেন। নাজমুলের জন্য প্রয়োজনে ২০লাখ খরচ করবেন এবং তিনি গ্রেপ্তার হবেন না জানিয়ে অভয় দেন। যদি পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে, তবে হাইকোর্ট থেকে জামিন করা হবে।

অডিওতে উত্তম কুমার দেবও নাজমুলের সঙ্গে কথা বলেন। নাজমুলকে অভয় দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে বলেন। তার মোবাইল বন্ধ করে রাখতে বলেন। তাকে ফোন না দিয়ে জব্বার এবং জনৈক হানিফের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। এ সময় নাজমুল নিজের ভয়ের কথা বলতে শোনা যায়।

এরপর জব্বার-নাজমুলের ফের কথোপকথনে জব্বার নাজমুলকে ৪/৫দিন বাইরে থাকতে বলেন। জনৈক হানিফ খরচের জন্য পাঁচ হাজার টাকা পাঠাবে। এছাড়া ব্যবহৃত সিম খুলে ফেলে নতুন সিম ব্যবহার করতে বলা হয় ওই অডিওতে।

এই বিষয়ে আওয়ামীলীগ নেতা ও সাংবাদিক জয়নাথ দেব বলেন, এসব অপরাধের মূলোৎপাটনে সচেষ্ঠ থাকি বলে অপরাধীরা ক্ষুব্ধ হয়ে আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন। এ সময় তিনি এই ঘটনায় সঠিক তদন্তের দাবি জানান।

তবে উত্তম কুমার দেবের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। অপর দিকে জব্বার হোসেনের মোবাইলে সংযোগ পাওয়া যায়নি।
ডিবি পুলিশ পরিদর্শক মো: শামসুজ্জামান বলেন, ফাঁস হওয়া অডিও মামলায় নথিভুক্ত করা হবে। এছাড়া ঘটনা তদন্তে উত্তম কুমার দেবসহ যার নাম আসবে তার নাম উল্লেখ করা হবে। আদালতের দেওয়া সময়সীমা ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত হলেও তিনি আরও ১৫দিন সময় বাড়ানোর আবেদন করেছেন বলেও জানিয়েছেন। তবে নাজমুল অভিযোগ করেন, ডিবি পুলিশ তার বক্তব্য নিচ্ছে না উল্টো তাকে মামলার আসামী করার হুমকি দিচ্ছে।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের মার্চ মাসের প্রথম দিকে প্রকাশ্য দিবালোকে খাগড়াছড়ির পানছড়ির সীমান্ত সড়কে সরকারি অর্থায়নে নির্মিত ৩টি পাকা কালভার্ট ভেঙ্গে রড খুলে দুর্বৃত্তরা। টানা সাতদিন ধরে একদল যুবক কালভার্টগুলো ভেঙ্গে গাড়িতে করে রড নিয়ে যায়। বিষয়টি সাংবাদিকদের নজরে আসলে প্রশাসনও নড়েচড়ে বসে।
অবশেষে পানছড়ির উপজেলা ভারপ্রাপ্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা(পিআইও) আব্দুস সালাম গত ৯ই মার্চ পানছড়ি থানায় একটি জিডি করলেও সেখানে জড়িতদের নাম উল্লেখ করেননি।

এ ছাড়া জিডিতে রডগুলো রাতে চুরির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে প্রত্যক্ষদর্শী এলাকাবাসী জানিয়েছে, রাতে নয়, দিনের বেলায় টানা পাঁচ দিন কালভার্ট ভেঙে গাড়ীতে করে রড নিয়ে গেছে।

এ নিয়ে গত ২৫শে মার্চ বিভিন্ন প্রত্রিকা “খাগড়াছড়ি সীমান্ত সড়কে কালভার্ট ভেঙ্গে রড নিয়ে গেলো দুর্বৃত্তরা” শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় এবং ডিজিটাল মিডিয়াতে ভিডিও নিউজ প্রকাশিত হয়। গণমাধ্যমে সংবাদটি প্রকাশ ও প্রচার হলে বিষয়টি নজরে আসে আদালতের। এদিকে গণমাধ্যমে সংবাদটি প্রকাশ ও প্রচার হলে বিষয়টি নজড়ে আসে আদালতের।

গত ২৯শে মার্চ খাগড়াছড়ির আমলি আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জিএম ফারহান ইসতিয়াক বাদী হয়ে মিস মামলা(মামলা নং ২/২০২৩) করে একটি আদেশ দেন। আদেশে তিনি খাগড়াছড়ির জেলা গোয়েন্দা শাখার(ডিবি) পুলিশ পরিদর্শককে অতিসত্বর ঘটনার সরেজমিন পরিদর্শন করে আলামত সংগ্রহসহ ঘটনার সাথে জড়িত সকলের বিরুদ্ধে বিস্তারিত তদন্তপূর্বক আগামী ৩০শে এপ্রিলের মধ্যে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেন।

এ ছাড়া চাঞ্চল্যকর ও সংবেদনশীল ঘটনায় পানছড়ি থানার ওসি মো: হারুনুর রশিদের দায়িত্বশলীতার অভাব ছিল বলেও উল্লেখ করে তাকে সশরীরে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতেও নির্দেশ দেন আদালত।
উল্লেখ্য, খাগড়াছড়ির পানছড়িতে স্থানীয় বাসিন্দাদের যাতায়াতের জন্য ২০১৬/১৭অর্থ বছরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার আওতায় পানছড়ির পিআইও কার্যালয় লোগাং ইউনিয়নের ছনখোলা রাস্তার মাঝখানে এবং একই ইউনিয়নের দূর্গামনি পাড়া যাওয়ার রাস্তায় ৪০ফুট দৈর্ঘ্যরে দুটি সেতু নির্মাণ করা হয়। এছাড়া হারুবিল-কচুছড়ি এলাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের নির্মিত একটি কালভার্টের রডও চুরি হয়ে যায়। এই ঘটনায় প্রথমে থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। ঘটনার জন্য শুরু থেকে উত্তম কুমার দেবকে দায়ী করা হচ্ছিল।

যদিও গত ২৬শে এপ্রিল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পানছড়ির টিঅ্যান্ডটি এলাকার নাজমুলের বসত ঘরের পেছন থেকে চুরি হওয়া বিভিন্ন সাইজের ৫৮পিস রড উদ্ধার করে ডিবি পুলিশ। যার ওজন প্রায় ৭৫৫কেজি।