চাঁদপুরের মতলবে ক্ষীর এর জন্য মানুষের ঢল!

দেশশজুড়ে ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় মিষ্টান্ন প্রেমীদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী দুগ্ধজাত মিষ্টান্ন-ক্ষীর। শত বছরেরও অধিক সময় ধরে খাঁটি দুধে তৈরি এখানকার ক্ষীর গুণে ও মানে এখনো অটুট। ক্ষীর ভোজনরসিকদের প্রিয় রসনা নামে পরিচিত। জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদি’তেও বয়ান করা হয়েছে এই ক্ষীরের সুনাম ও ঐতিহ্যের কথা।

মতলব উপজেলা প্রশাসন সম্পাদিত মতলবের ইতিবৃত্ত বইয়ে এই ক্ষীরের উল্লেখ আছে। ২০১৩ সালে প্রকাশিত ওই বইয়ের ৪৪ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘মতলবের ক্ষীর খুবই প্রসিদ্ধ। সারা দেশে ক্ষীরের ব্যাপক চাহিদা ও কদরের কারণে একসময় অনেক হিন্দু পরিবার ক্ষীর তৈরি এবং ক্ষীরের পাত্র বানানোর কাজে ব্যস্ত থাকত। এখনো এই ঐতিহ্যবাহী দুগ্ধজাত পণ্য ক্ষীরের চাহিদা সর্বত্র।

ইংরেজ শাসনামল থেকে শুরু করে চলমান ২০২১ সালে এসেও এই ক্ষীরের চাহিদা এতটুকুও কমেনি ভোজনরসিকদের কাছে।

বাজার পরিদর্শনের মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন ক্ষীর সম্মন্ধে জানা যায় যে, এ ক্ষীর অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল তথা দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি করা হতো যা এখনও চলমান আছে। এর চাহিদা তুঙ্গে থাকায় মতলব উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে বিক্রেতারা মতলব বাজারে দুধ এনে বিক্রি করতেন আর স্থানীয় ময়রারা সেগুলো সংগ্রহ করতেন। ওই সময় মতলবের ঘোষপাড়া ছিল ক্ষীর, দধি ও খাঁটি ঘি তৈরির আস্তানা।

এই ক্ষীর হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন পূজা-পার্বণ, ঈদ অনুষ্ঠান, বিবাহ, রাজনৈতিক অনুষ্ঠান, সামাজিকতা বা অাপ্যায়নের জন্য সবখানেই নিজ গুনে সমুন্নত। মতলবের ক্ষীর সংগ্রহ করার জন্য দূর দুরান্ত থেকে অনেক মানুষ মতলবে আসে, পরমূহুর্তে তা স্ব স্ব আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি নিয়ে যায়। রাজনীতির প্রেক্ষপটে বিশেষ উপঢৌকন হিসেবে মতলবের ক্ষীর চাঁদপুরের ইলিশের সাথে পাল্লা দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে দেশ বরেণ্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলীয় নেতাকর্মীদের বাসভবনে।

গুণ, মান ও স্বাদের কারণে ব্রিটিশ আমলে এখানকার জমিদার ও ইংরেজদের কাছে এই ক্ষীর খুবই প্রিয় ছিল বলে জানালেন বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের সদস্য উপজেলা সদরের দক্ষিণ কলাদী এলাকার বাসিন্দা অহিদুল ইসলাম।

পাঁচটি বিশেষ কারণে এখানকার ক্ষীর গুণে ও মানে সেরা। প্রথমত, গৃহস্থের কাছ থেকে সংগ্রহ করা খাঁটি দুধ দিয়ে এই ক্ষীর বানানো হয়। দ্বিতীয়ত, দুধ ও চিনি মিশ্রণের অনুপাতে হেরফের হয় না। এক কেজি ক্ষীর বানাতে পাঁচ কেজি দুধ ও ৫০-৬০ গ্রাম চিনি মেশানো হয়। তৃতীয়ত, ক্ষীরে ময়দা বা আটা মেশানো হয় না। চতুর্থত, দুধের ননি ওঠানো হয় না। ননিসহ ক্ষীর বানানো হয়। পঞ্চমত, লাকড়ির চুলায় ক্ষীর তৈরি করা হয়।

মতলবের ঐতিহ্যবাহী ক্ষীর নিয়ে প্রসিদ্ধ ক্ষীর ব্যবসায়ী প্রয়াত গান্ধীচরণ ঘোষের ছেলে সজল ঘোষ বলেন, আমাদের মতলব শহর হচ্ছে ক্ষীরের জন্য বিখ্যাত। আজ থেকে ৬০-৭০ বছর আগে মণে মণে ক্ষীর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করতেন আমার প্রয়াত পিতা গান্ধীচরণ ঘোষ। বিশেষ করে দেশের বাইরেও মতলবের ক্ষীরের চাহিদা ছিল ব্যাপক। এখনও এর চাহিদা অব্যাহত আছে। আমি আমার বাবার আশীর্বাদে আমাদের এ দুগ্ধজাতীয় ব্যবসাটি এখনও ধরে রেখেছি।

আগে দুধের দামও কম ছিল, আমরা ভাল ক্ষীর তৈরি করতে পারতাম। এখন সবকিছুর দামই বেড়ে যাচ্ছে। ভালো দুধের উপর নির্ভর করে ক্ষীর তৈরি করা হলে ভাল ক্ষীরের কেজি ৪৮০-৫০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। দ্রব্যসামগ্রী সহজলভ্য না হওয়ায় মাঝে মাঝে ক্ষীরের দাম তুলনামূলক একটু বেশি থাকে।

উপজেলা সদর বাজারের রূপা স্টোর সংলগ্ন আনন্দ ক্ষীর হাউসের প্রধান স্বত্তাধিকারী উৎপল ঘোষ শুধুমাত্র দধি, ক্ষীর ও ঘি বিক্রি করেন। তিনি বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকেই উপজেলা সদরের ঘোষপাড়া এলাকার গান্ধী ঘোষের পূর্বসূরীরা ক্ষীর তৈরি শুরু করেন। খাঁটি দুধের তৈরি ও স্বাদের কারণে তখন এলাকায় এই ক্ষীরের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তাদের দেখাদেখি কলাদি ও বাইশপুর গ্রামের দাসপাড়ার আরও ১৫-২০টি হিন্দু পরিবার এ কাজে নামে। বর্তমানে ঘোষপাড়ার সুনীল ঘোষ, মিলন ঘোষ, গান্ধী ঘোষ, অনিক কুমার ঘোষ, উৎপল ঘোষ, নিবাস চন্দ্র ঘোষ, উত্তম ঘোষ এবং দাসপাড়ার মাখনলাল ঘোষ, নির্মল ঘোষসহ কয়েকটি পরিবার ক্ষীরের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

পৌরসভা সংলগ্ন টিফিন কনফেকশনারীর প্রধান স্বত্তাধিকারী বাবু নিবাস চন্দ্র ঘোষ বলেন, মতলবের ক্ষীর দেশজুড়ে সমাদৃত। আমরা মতলবে ভেজাল বিহীন ক্ষীর তৈরি করে থাকি। ক্রেতার সন্তুষ্টি বজায় রাখাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। আমরা ব্যাপক সুনামের সহিত এ ক্ষীরের ব্যবসা পরিচালনা করছি।

আমরা প্রথমত ক্ষীর তৈরির অর্ডার গ্রহন করি, অতঃপর তা চাহিদানুসারে ডেলিভারী করে থাকি। বর্তমানে এক কেজি দুধের দাম ৬০-৭০ টাকা,কিছু কিছু সময় দাম আরও বেশিও হয়ে থাকে। চিনিসহ অন্যান্য খরচ মিলে এক কেজি ক্ষীর বানাতে খরচ পড়ে ৪০০ টাকা। প্যাকিং খরচ সহ প্রতি কেজি ভালো ক্ষীরের দাম পড়ে যায় ৪৫০ টাকা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিক্রেতারা প্রতিদিন সকালে গৃহস্থের কাছ থেকে খাঁটি দুধ সংগ্রহ করেন। অতঃপর সংগ্রহীত দুধ বড় পাত্রে ঢেলে চুলায় একটানা দুই ঘণ্টা জ্বাল দেয় এবং পাশাপশি তিনটি কাঠি দিয়ে পাত্রের তলদেশে বিচক্ষনতার সহিত নাড়তে থাকেন, যেন পাতিলের তলায় পোড়া না লেগে যায়। অতঃপর দুধের রং পরিবর্তন হয়ে ক্ষীরে পরিনত হয়ে আসলে তা মাটির ছোট ছোট পাত্রে হাফকেজি/ কেজি পরিমাপ করে আলাদাভাবে রাখেন। অতঃপর বিক্রির উপযুক্ত করার জন্য পাত্রের ক্ষীর কিছুক্ষণ ফ্যানের বাতাসে ঠান্ডা করে নেন।

কয়েকজন ক্ষীর ক্রেতা জানান, “মতলবের ক্ষীর, বগুড়ার দই” না খেয়ে ক্যামনে রই! কথাটি চাঁদপুর অঞ্চলের মানুষের সাথে সাথে এখন দেশজুড়ে সকলের মুখে মুখে প্রাঞ্জল হয়ে ওঠেছে। মতলব ক্ষীরের জন্য বিখ্যাত। আগে স্বল্পমূল্যে প্রকৃত ক্ষীর কিনতে পারতাম এখন দাম একটু বেশি কিন্তু তারপরও এই ক্ষীরের স্বাদ অতুলনীয়। এদিকে এখনও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ক্রেতারা এসে ক্ষীর কিনছেন। খাঁটি দুধের দাম কম হলেই স্বল্প দামে এর চাহিদা পূরন সম্ভব হয়। এ প্রসিদ্ধ খাবারটি সবার পছন্দনীয় হলেও হতদরিদ্র মানুষরা অর্থের জন্য তা কিনে খেতে পারছেন না। তাই তারা এই মুুখরোচক খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।