চাঁদপুরে বালু উত্তোলনে ধ্বংসের মুখে পড়েছে জাতীয় সম্পদ ইলিশ

চাঁদপুর হাইমচরের চরভৈরবী থেকে মতলব উত্তরের ষাটনলের ৭০ কিলোমিটার এলাকার নৌ পথে শত শত অবৈধ বালুর ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু উত্তোলনে ধ্বংসের মুখে পড়েছে জাতীয় সম্পদ ইলিশ উৎপাদন। যেজন্য নদীতে নেমেও কাঙ্খিত বড় ইলিশ পাচ্ছে না জেলেরা। সরকার নদীতে জাটকা রক্ষায় অসাধু জেলেদের বিরুদ্ধে কঠোর ছিলো। কিন্তু তা পুরোপুরি ভেস্তে দিচ্ছে অবৈধ ড্রেজিংয়ের বালু উত্তোলন। এমনটি জানিয়েছেন চাঁদপুর জেলে, মৎস নেতা, মৎস কর্মকর্তা, ইলিশ গভেষকসহ সংশ্লিষ্টগণ।

৪’রা মে মঙ্গলবার সরজমিনে চাঁদপুরের বড়ষ্টেশনমাছঘাট, বহরিয়াবাজার, হরিনাঘাট, পুরানবাজার ঘুরে দেখা যায়, ঘন্টার পর ঘন্টা নদীতে নৌকা নিয়ে ঘুরেও ইলিশ ছাড়াই ফিরতে হচ্ছে জেলেদের। এতে করে জেলেরা চরম অসহায় এবং হতাশা অনুভব করছে।

চাঁদপুর জেলা মৎস বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মার্চ-এপ্রিল দু’মাসের অভয়াশ্রমের সময় প্রায় পাঁচ শতাধিক জেলেকে জেল জরিমানা করা হয়েছে।এরমধ্যে সাড়ে ৪’শ কিশোর জেলেকে জরিমানা করে মুচলেকা রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।এছড়াও ৫’শ ৫৮টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। অভিযানে প্রায় ৪০টন জাটকা ও আড়াই কোটি মিটার অবৈধ কারেন্ট জালসহ অন্যান্য জাল জব্দ করা হয়েছে।

জেলা মৎস বিভাগ সূত্রে আরও জানা যায়, চাঁদপুর সদর, হাইমচর, মতলব দক্ষিণ ও মতলব উত্তর উপজেলাসহ জেলায় মোট ৫১ হাজার ১’শ ৯০ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছে। তালিকাভুক্ত এসব জেলেকে এ সময় চার ধাপে ৪০ কেজি করে নদীতে না নামার শর্তে ভিজিএফের চাল প্রদান করা হয়েছে।

চাঁদপুরের দক্ষিনাঞ্চলের সবচেয়ে বড় মাছঘাট বড়ষ্টেশন মৎস বণিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী শবে বরাত সরকার বলেন, আমাদের বড় স্টেশন মাছঘাটে গত বছর এই সময়ে অন্তত ২’শ মণের উপরে ইলিশ মাছ এসেছিলো। সেখানে এ বছর মাত্র ৪০-৪৫ মণ ইলিশ মাছ এসেছে। তাই ইলিশের দামটাও তুলনামূলক বেশি।

তিনি আরও জানান, এক কেজি সাইজের ইলিশ মাছ এখন কেজিপ্রতি ১৩’শ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে ভোলা বা বরিশাল থেকে ইলিশ মাছ আমদানি শুরু হলে তখন হয়তো ইলিশের দাম কিছুটা কমবে।

হাইমচর চরভৈরবী মৎস ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি সালাউদ্দিন হাওলদার বলেন, সরকার প্রশাসন দিয়ে জেলেদের আটকিয়ে ইলিশ স্বিকার বন্ধ করে ঠিকই। কিন্তু ইলিশ উৎপাদনের মূল বাঁধা জেলে নয় বরং অবৈধ ড্রেজিং। তাই সরকারকে অবৈধ বালু উত্তোলনকারী এসব ড্রেজার নদী থেকে উৎখাতের মাধ্যমে বন্ধ করতে হবে। তাহলেই নদীতে ইলিশের অন্যান্য মাছের ডিম টিকবে এবং ভরপুর বড় বড় মাছ পাওয়া যাবে।

বাংলাদেশ আওয়ামী মৎসজীবী লীগ চাঁদপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মোঃ মানিক দেওয়ান বলেন, জাটকা ইলিশ বালু উত্তোলনকারী ড্রেজিংয়ে ধ্বংস হচ্ছে। যেজন্য দুমাস জেলেরা অবসর থেকেও এখন নদীতে কাঙ্খিত ইলিশ পাচ্ছে না। তাই জেলেদের পক্ষ হতে আমি বালু উত্তোলনকারী ড্রেজার বন্ধ করতে প্রশাসনসহ সর্বমহলের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

বাংলাদেশ আওয়ামী মৎসজীবী লীগ চাঁদপুর জেলা শাখার সভাপতি আব্দুল মালেক দেওয়ান বলেন, জাটকা ত যা মরার মরছেই। অক্টোবর – নভেম্বরে যখন মা ইলিশ নদীতে ডিম ছাড়ে। ঐ সময়েই কোটি কোটি ইলিশের ডিম এই অবৈধ বালু উত্তোলনকারী ড্রেজিংয়ে ধ্বংস হয়েছে। যেজন্য চাঁদপুরে ইলিশ উৎপাদন এখন ধ্বংসের মুখে! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলবো, আপনি চাঁদপুরের ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে এসব অবৈধ বালু উত্তোলনকারী ড্রেজিং বন্ধ করতে ব্যবস্থা নিন।

কেন্দ্রীয় মৎসজীবীলীগ সমবায় সমিতি চাঁদপুর জেলা শাখার সভাপতি মোঃ তছলিম বেপারী বলেন, কাঙ্খিত ইলিশ পেতে হলে জেলেদের মতো বালু উত্তোলনকারী ড্রেজিংয়ের বিষয়েও প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। এক্ষেত্রে অক্টোবর নভেম্বর কমপক্ষে দু-মাস নদীতে বালু উত্তোলনকারী সকল প্রকার ড্রেজার দেশের বৃহৎ স্বার্থে বন্ধ রাখতে হবে। নয়তো ইলিশ আর চাঁদপুরের নদীতে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ!

চাঁদপুর জেলা মৎস কর্মকর্তা মোঃ আসাদুল বাকী বলেন, ইলিশের গভেষকদের মতে অভয়াশ্রম ও প্রজনন মৌসুমে বালু উত্তোলনকারী ড্রেজারে নদীর পানি মারাত্মক ডিস্টার্ব হচ্ছে। এতে ইলিশের খাদ্য সংকটসহ নানাভাবে এদের উৎপাদন বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। এ ব্যপারে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে আমরা উপর মহলে এর ভয়াবহতা তুলে ধরে পরবর্তীতে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিবো।

চাঁদপুর নদী কেন্দ্রের চীফ সাইন্টিফিক অফিসার ড. মোঃ আনিছুর রহমান বলেন, পরিভ্রমনশীল স্বভাবের ইলিশ মাছ সাগর মোহনা হয়ে মেঘনা নদী দিয়ে পদ্মায় যে চলাচল করছে। এর অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে যেখানে ইলিশ ডিম ছাড়ে, বাচ্চা লালিত-পালিত হয়। সেখানে বালু উত্তোলনের প্রেক্ষিতে তাদের যে ইকো সিস্টেম, সেটা বাঁধাগ্রস্থ হয়। পানির গুণাগুণও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সর্বোপরী এই যে মাইগ্রোরেটি রুটে অভিপ্রায়ন ইলিশ চলাচল করে। তাদের চলাচলের গভীরতাও বাঁধা গ্রস্থ হয়ে ইলিশ উৎপাদন হুমকির মুখে রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, বালু অঞ্চলসহ ইলিশ প্রজনন অঞ্চল টা ক্লিয়ার করলে এদের চলাচলের গভীরতা ঠিক থাকে। ১৪ই অক্টোবর থেকে পোনা তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রেও এই বালু ইলিশের খাদ্য উৎপাদনেও বাঁধা দিচ্ছে। পুরো অক্টোবর থেকে নভেম্বরের ১ম সপ্তাহ পর্যন্ত বালু উত্তোলন বন্ধ রাখলে ইলিশ উৎপাদনে তা অনেকটাই সহায়ক হবে। কেননা পানির সাথে বালু মিশলে তা পানির গুণাগুণ অর্থাৎ বাস্তুতন্ত্র বা আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্থ করছে। তাই বালু উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ এখন সময়ের দাবী। সোজাকথা ইলিশ রুট চলাচলে কোন বাঁধা দেওয়া যাবে না। ২০১৯/২০ সাল হতে বালু উত্তোলনে ইলিশ উৎপাদনের হুমকি- প্রকট আকার ধারন করেছে।

তিনি আরও বলেন, চাঁদপুর হচ্ছে ইলিশের নানী বাড়ি। এখানে ডিম ছাড়ার জায়গা। অক্টোবরের পূর্ণিমা হচ্ছে ইলিশ ডিম ছাড়ার মুখ্যম সময়। প্রধানত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর হলেও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারী ও মার্চেও সুপ্ত আকারে ইলিশ ডিম ছাড়ে। কিন্তু চাঁদপুরের সফরমালী, ফরাজীকান্দি, কানুদী ও রাজরাজেশ্বরের অঞ্চলটা বালু উত্তোলনের জন্য বেশ ক্ষতিগ্রস্থ। ইলিশের চলাচলের রুটটাও এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তবুও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ লক্ষ ৫০ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদন হয়েছে। এবার ২০২০-২১ অর্থবছরে পৌনে ৬ লক্ষ ইলিশ উৎপাদন ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তিনি বলেন, ইলিশ পরিভ্রমণশীল মাছ। এরা মিঠা পানি, লোনা পানি উভয় পানিতে স্রোতের বিপরীতে ঘন্টায় ৩ কি. মি. বেগে ছুটতে পারে। গেলো ২০২০ সালের ১৪ই অক্টোবর থেকে ২২শে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৫১.২% বা ২.৫০ কোটি মা ইলিশ নদীতে ডিম ছাড়ার সুযোগ পেয়েছে। এর ১০%- ও যদি টিকে যায়, তাহলে ৩৭.৮৫০ কোটি জাটকা ইলিশ নদীর জলাধারে যুক্ত হয়েছে। এখন করনীয় হচ্ছে জলাধারের এই ইলিশগুলোকে সুরক্ষা দেওয়া।পরবর্তীতে এক একটা ইলিশ গড়ে ১০/১২ লক্ষ ডিম এবং সর্বনিম্ন ৩/৫ লক্ষ ও সর্বোচ্চ ২০ লক্ষ ডিম নদীতে ছাড়বে। ১’লা মার্চ থেকে ৩০শে এপ্রিল ছিলো ইলিশের মূল খাবারের খাওয়ার সময়। কিন্তু ১৪ই অক্টোবর থেকে ইলিশের পোনা তৈরি হওয়ার সময়। ঐ সময়ে বালু উত্তোলন নদীতে ইলিশের খাদ্য উৎপাদনেও বাঁধা ফেলবে। তাই যেকোন মূল্যে বালু উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।তাহলেই নদীতে জেলেরা কাঙ্খিত ইলিশ পাবে বলে আশা করছি।

এ ব্যপারে জেলা প্রশাসক অন্জনা খান মজলিশ বলেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে চাঁদপুরের ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে বাঁধাগ্রস্থকারী যেকোন কিছুর ব্যপারেই প্রশাসন কঠোর অবস্থানে রয়েছে।সেখানে এই বালু উত্তোলনের ড্রেজিং ব্যবহারের ব্যপারেও আমরা কঠোর সিদ্ধান্তে যাচ্ছি। এইটুকু বলে রাখি ”অবৈধ ড্রেজারের বিরুদ্ধে প্রশাসন জিরো টলারেন্স”। ইলিশ সম্পদ রক্ষায় সকলের সচেতনতা ও সহযোগিতা কামনা করছি।