জামায়াত কি সংস্কারের পথ থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে?

বাংলাদেশে অস্তিত্ব রক্ষার সংকটে পড়া জামায়াতে ইসলামী অতীতের উত্তরাধিকার থেকে বেরিয়ে আসতে সংস্কারের যে কথা বলেছিল, তা থেকে তারা পিছিয়ে এসেছে বলে জানা গেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকার জন্য দলটি এখনও ভবিষ্যৎ নির্ধারণে সমস্যায় পড়ছে।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে জামায়াতের একজন কেন্দ্রীয় নেতার পদত্যাগের পর ৭১ সালের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নসহ বিভিন্ন বিষয়ে দলটিতে সংস্কার আনার কথা বলা হয়েছিল।

কিন্তু এখন জামায়াতের বিভিন্ন সূত্র বলছে, সংস্কার নয়, শুধু দলটির নাম পরিবর্তনের বিষয়েই দলের ভিতরে আলোচনা চলছে।

তবে এসব মানতে রাজি নন দলটির সেক্রেটারি জেনারেল ডা: শফিকুর রহমান। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, সব বিষয় নিয়েই তাদের দলে আলোচনা রয়েছে।

জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সরকারি সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক গত ফেব্রুয়ারি মাসে যখন পদত্যাগ করেন, তখন তিনি অন্যতম কারণ হিসেবে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিতর্কিত ভূমিকার জন্য দলটির ক্ষমা না চাওয়ার বিষয়কে তুলে ধরেছিলেন।

তাঁর পদত্যাগ এবং সংস্কারের পক্ষে খোলামেলা বক্তব্য দলটির বিভিন্ন স্তরে বেশ নাড়া দিয়েছিল।

ব্যারিস্টার রাজ্জাকের পদত্যাগের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত জামায়াতের একজন কেন্দ্রীয় নেতা মজিবুর রহমান মঞ্জুকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।

জামায়াতে সংস্কারের দাবি যাতে মাথা চাড়া দিতে না পারে, সে সময় দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সেই চেষ্টাই ছিল বলে সূত্রগুলো বলছে।

দলটিতে সংস্কারের সুপারিশ তৈরির জন্য একটি কমিটি গঠনের কথাও বলা হয়েছিল।

কিন্তু জামায়াতের সূত্রগুলো বলছে,৭১ এর ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়া বা দলের অতীত থেকে বেরিয়ে আসার প্রশ্নে সংস্কারের চিন্তা থেকে দলটির নেতৃত্ব পিছিয়ে এসেছে।

জামায়াতের ফেনী জেলার আমীর এ কে এম শামসুদ্দিন বলছিলেন, কোনো সংস্কার নয়, তাদের কমিটি কাজ করছে দলের নাম পরিবর্তনের জন্য।

“কোনো সংস্কারের বিষয় আমাদের দলে নেই। দলের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব এসেছিল, সে ব্যাপারেই সবার মতামত নেয়ার পর একটা কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি নাম নিয়ে কাজ করছে।”

সংস্কারের প্রশ্ন তুলে জামায়াতের মাঠ পর্যায়েও কয়েকজন নেতা দল ছেড়েছিলেন গত ফেব্রুয়ারি মাসে।

তাদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, দলটিতে বিভিন্ন সময়ই সংস্কারের দাবি উঠেছে। যখনই এমন প্রশ্ন উঠেছে, তখনই সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে কমিটি গঠন বা সংস্কারের সুপারিশ তৈরি করা বিভিন্ন কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কখনই কার্যকর কিছু হয়নি।

জামায়াতের সূত্রগুলো বলছে, এবারও সংস্কার প্রশ্নে দলের ভিতরের সংকট সামলানো সম্ভব হয়েছে বলে নেতৃত্ব ভাবছে।

তবে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ডা: শফিকুর রহমান বলেছেন, তাদের দলে সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া।

“৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সম্মান দেখিয়ে জামায়াতের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বক্তব্য দেয়া হয়েছে। ভবিষ্যতেও দেয়া হবে।”

ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্ন এলেই জামায়াতের পক্ষ থেকে এমন বক্তব্যই তুলে ধরা হয়।

জামায়াতের রাজনীতির ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক শাহ আব্দুল হান্নান বলছিলেন, ৭১এর ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাইলে কোনো লাভ হবে কিনা, সেই প্রশ্ন হয়তো দলটিতে কাজ করছে।

একাত্তর সালের ভূমিকার দায় জামায়াতের নতুন প্রজন্ম কেন নেবে, বিভিন্ন সময় এমন প্রশ্নও তুলেছেন দলটির নেতাদের অনেকে।

শাহ আব্দুল হান্নানও বলেছেন, “এই পার্টির জন্ম হয়েছে ১৯৪১ সালে। তখন অল ইন্ডিয়া ছিল। এখন ৪১থেকে ৪৭ সাল পর্যন্ত সময়ের দায়ভার পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী নেয়নি। ৪৭ থেকে ৭১ সাল পর্যন্ত ধরেন, এরপরে এই পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৭৯ সালে এই পার্টি আবার যখন পুনর্জন্ম হলো, তার পর তারা মনে করে যে আগের দায়ভার আমাদের নাই।”

তবে জামায়াতের সূত্রগুলো বলছে, যুদ্ধাপরাধের দায়ে তাদের শীর্ষ নেতাদের বিচার হয়ে গেছে। তাদের অনেক ত্যাগ রয়েছে দলটির জন্য, এমন বিবেচনা থেকে পুরনো অবস্থানে সংস্কার না আনার চিন্তা দলে সক্রিয় রয়েছে।

দৈনিক নয়া দিগন্তের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সালাউদ্দিন বাবর বলছিলেন, জামায়াতের মধ্যে দোদুল্যমানতা কাজ করছে বলে তাঁর মনে হয়।

“জামায়াতের সিদ্ধান্ত নেযার ক্ষেত্রে এখানে দোদুল্যমানতা আছে। কারণ একটা সংকট থেকে উত্তরণ ঘটেছে তাদের। সেই সংকটের প্রেক্ষাপটে তাদের এ বিষয়গুলো আলোচনায় আসে যে, তারা সংস্কারের পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু তারা এ বিসয়ে বিলম্ব করছে।”

“জামায়াতেও একটা জেনারেশন গ্যাপ আছে। এই জেনারেশন গ্যাপের কাছে সব বিষয়গুলো সমানভাবে মূল্যায়ন হয় না।যেমন ধরেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক যে প্রশ্নগুলো তুলেছিলেন, সে ব্যাপারে কিন্তু জামায়াতের পক্ষ থেকে কোনো জবাব আসে নাই।তাতে মনে হয়, তারা এই বিষয়গুলোতে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে এবং সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারছে না।”

জামায়াত এখন শুধু নাম পরিবর্তনের প্রক্রিয়া নিয়ে এগুচ্ছে বলে দলটির বিভিন্ন সূত্রে যে জানা যাচ্ছে, সে ব্যাপারে ডা: শফিকুর রহমান বলেছেন, নাম পরিবর্তনের সাথে বৃহত্তর সব বিষয় জড়িত থাকে। ফলে সব বিষয় নিয়েই তাদের দলে আলোচনা চলছে।