তারানা হালিমের ‘পতন’ যে কারণে

সরকারের শেষ সময়ে এসে মন্ত্রিসভায় বড় ধরনের রদবদল হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা একে ভোটের রদবদল বলে মন্তব্য করেছেন।মন্ত্রিসভার কলেবর বৃদ্ধি ও দায়িত্ব পুনর্বণ্টনে সবচেয়ে চমক হয়ে এসেছে ডাক তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়। এই মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে তারানা হালিমকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে।এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। কারণ, বিগত দুই বছরে মন্ত্রণালয়ের কাজ গুছিয়ে একটি জায়গায় দাঁড় করিয়েছেন তারানা হালিম। কিন্তু, সে সুফল ঘরে তোলার আগেই ক্ষোভ, দুঃখ, আক্ষেপ আর মনবেদনা নিয়ে তাকে নিজের সাজানো বাগান থেকে ছিটকে পড়তে হলো।

মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা জানান, দুই বছরে ডাক তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় গোছাতে গিয়ে অনেক শত্রু তৈরি করেছেন তারানা হালিম। শেষ পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের হাজার কোটি টাকার ‘কারবার’ নিয়ে গজিয়ে ওঠা ওই প্রভাবশালী চক্রের কাছে হার মানলেন এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও আইনজীবী।

শত্রু তৈরির কথা তারানা হালিমের স্বীকারোক্তিতেও পাওয়া গেল। তবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে যে যুদ্ধটা করা শিখেছেন, এখনই এর শেষ না দেখে লড়াইয়ে ক্ষ্যান্ত দিবেন না তিনি।

মন্ত্রণালয়ে কাজের ক্ষেত্রে প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বেশ কয়েকটি বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এসব করতে গিয়ে তিনি প্রভাবশালীদের বিরাগভাজন হয়েছেন।

মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা জানান, তারানা হালিমকে তার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার পেছনে কয়েকটি সিদ্ধান্ত বড় নিয়ামক হয়ে কাজ করেছে। এর মধ্যে বিটিসিএল এমডি নিয়োগ নিয়ে প্রথম তারানা হালিমের সঙ্গে মতবিরোধ শুরু হয় সরকারেরই শক্তিশালী ও প্রভাবশালী অংশের। সে সময়ে বিটিসিএল-এ মাহফুজুর রহমানকে এমডি নিয়োগে চূড়ান্ত বিরোধিতা করেন তারানা হালিম। সরকারি তদন্তেই দুর্নীতির সন্দেহ, পরিবারে স্বাধীনতা বিরোধী অবস্থানের কারণে তারানা হালিম বিরোধিতা করলেও তৃতীয় মেয়াদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান বিটিসিএল-এর এমডি মাহফুজুর রহমান।

এরপর দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবল নিয়ে বড় রকমের জটিলতায় পড়তে হয় তারানা হালিমকে। যেখানে সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক রাজনৈতিক প্রকল্প হয়েও দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল নিয়ে মন্ত্রণালয়ের একাধিক সিদ্ধান্ত প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এমনকি সুপ্রিম কোর্টে এ-সংক্রান্ত একটি মামলায় হেরে গিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানকে ১০ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণের নির্দেশ আসে উচ্চ আদালত থেকে।

দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত হওয়া নিয়ে প্রভাবশালীর চাপকে উপেক্ষা করেন তারানা হালিম। তিনি টেন্ডারে প্রথমে থাকা কোম্পানির পরিবর্তে দ্বিতীয় স্থানে থাকা কোম্পানিকে কাজ দেননি। সরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে সাবমেরিন ক্যাবলের কাজ করানোর চুক্তি করেন তারানা হালিম।

তারানা হালিমের ইচ্ছাতে কক্সবাজার-কুয়াকাটা ৩০০ কোটি টাকার সাবমেরিন ক্যাবল করে তা সিঙ্গাপুরের ব্লু-বেরি টেলিকমের মাধ্যমে ব্লু-বেরি বাংলাদেশ কোম্পানি নামে লাউস ও কম্বোডিয়ায় ব্যান্ডউইথ বিক্রি করতে চায় মন্ত্রণালয়।

পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে ব্লু-বেরি কোম্পানিটি ভুয়া। ফলে প্রকল্পটিই বাতিল হয়। গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল নিয়ে এই অপরিপক্ক কাজ সরকারের উচ্চমহল ভলোভাবে নেয়নি।

অন্যদিকে মর্ডানাইজেশন অব টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক এমওটিএস প্রকল্প নিয়েও বিটিসিএলের এমডি মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে তীব্র বিরোধ হয় তারানা হালিমের। প্রকল্পটিতে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা বেশি ব্যয় ধরা হয় বলে একনেকে ধরা পড়ে। ফলে ব্যয় কমানোর পক্ষে অবস্থান নেন তারনা হালিম। কিন্তু, বিটিসিএলের এমডি প্রাক্কলন ব্যয়ের চেয়ে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা বেশি ব্যয়েই প্রকল্প পাসের পক্ষে অবস্থান নিলে বিরোধ চূড়ান্ত আকার ধারণ করে।

তার ওপর টেলিযোগাযোগের বেসরকারি খাতও ক্ষিপ্ত ছিল, তারানা হালিম নিজেও স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘দেশি কোম্পানি ফাইবার ক্যাবল উৎপাদন করে আসছে। আমি কেন বিদেশি ও প্রাইভেট কোম্পানি দিয়ে সেটি করাব? এ নিয়ে অনেকেই আমার প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল।’

বিদেশি মিটার কেনা নিয়েও একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে বিরোধে জড়ান তারানা হালিম। তিনি মিটার কেনার জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দেন।

ডাক বিভাগকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা নিতে দেখে মনে ব্যথা পান তারানা হালিম। এক পর্যায়ে তিনি তা বন্ধ করে দেন। এ নিয়েও অনেকের শত্রুতে পরিণত হন এই জনপ্রিয় অভিনেত্রী।

এর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে বেসরকারি অপারেটরদের শক্ত হাতে সামলাতে গিয়েও চাপে পড়েছিলেন তিনি। নিজ মন্ত্রণালয়ের একটি অসাধু মহলও রুষ্ট ছিল। কারণ, দুর্নীতিরোধে মাঝে মাঝেই মন্ত্রণালয়ের সন্দেহভাজন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পারিবারিক অনুষ্ঠানে হাজির হতেন তারানা হালিম। পরখ করতেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে আসা উপঢৌকন।

টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরে যাওয়ার পেছনে সিন্ডিকেটের প্রভাব নিয়ে ক্ষোভ আছে তারানা হালিমের মাঝে। আবার ওই সিন্ডিকেটকে ইঙ্গিত করে নবনিযুক্ত টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তফা জব্বারের বক্তব্যেও আহত হয়েছেন তিনি।

দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিনে মোস্তফা জব্বার সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘তারানা হালিমের সরে যাওয়ার কারণ প্রকাশ্যে বলা যাবে না।’

এ বিষয়ে তারানা হালিম বলেন, ‘মোস্তফা ভাই হয়তো সিন্ডিকেটের কথাই বলেছেন। তাহলে আমার চলে যাওয়াটা কোন সিন্ডিকেটের কারণে, সেটা তার প্রকাশ করা উচিত। উনি এটা করলে আমার বড় ধন্যবাদ পাবেন। যদিও পরদিন তিনি একটি আত্মপক্ষ সমর্থনে বক্তব্য দিয়েছেন। তারপরও তার সত্য প্রকাশ করা উচিত, হোক সেটা আমার বিরুদ্ধেই।’

মন্ত্রণালয়ে শক্তিশালী সিন্ডিকেট সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এখন এ নিয়ে কিছুই বলতে চাচ্ছি না। একটা কথাই বলি, কোনো মানুষ সৎ এবং কর্মঠ হলে তিনি কখনোই সিন্ডিকেটকে তোয়াক্কা করেন না। আমি যেখানেই যাব, কোনো সিন্ডিকেটকে পাত্তা দিব না। আমি সারা জীবন সিন্ডিকেট, অসততার বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, সেটি যেখানেই যাই অব্যাহত থাকবে। আমার ওপর নেত্রীর (শেখ হাসিনা) সে আস্থা আছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তারানা হালিম বলেন, ‘আমাকে কনভিন্সড করবে এমন মানুষ পৃথিবীতে জন্মেনি। আমি নিজে দুর্নীতি করি না। কারো এ ধরনের কার্যক্রম সমর্থন করি না।’

তিনি বলেন, ‘আমি আমার কাজে সৎ থেকেছি। মানুষ বলে টেলিকমিউনিকেশনে এত উন্নতি আগে কখনো হয়নি। আমি এক বছরে যত কাজ করেছি, তার তালিকা আছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের চুক্তি স্বাক্ষর থেকে বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন, আইকেন থেকে ডটবাংলা ডোমেইন, দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবলে সংযুক্ত হওয়া, কলড্রপে কল ফেরত পাওয়া, সামনের বছর ফোরজি আসার সম্ভাবনা, বেসিসকে লাভজনক করা, ডাক বিভাগকে প্রবৃদ্ধির চাইতে বেশি লাভজনক করার অবস্থায় নেওয়া এবং খুলনা ক্যাবলকে ২৭ বছরের ইতিহাসে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছি।’

তথ্য মন্ত্রণালয়ের নতুন এই প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমি সব সময় মনে করেছি, যত বেশি কাজ করব, সরকারের মুখ তত উজ্জ্বল হবে। কোনো সিন্ডিকেটের সঙ্গে সমঝোতা করিনি, ভবিষ্যতেও করব না।’

ডাক তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি অনেক কাজ শেষ করে এসেছি। এখন যিনি এসেছেন, তিনি সেগুলো উদ্বোধন করলেই হবে। তার প্রতি আমার শুভ কামনা থাকল। এতো কাজ করে এসেছি, অবশ্যই এগুলোর উদ্বোধন হতে না দেখাটা খারাপ লাগবে।’

তারানা হালিম বলেন, ‘আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রী সব সময় চ্যালেঞ্জিং দায়িত্বই আমাকে দেন। টেলিযোগাযোগ সেক্টরের চ্যালেঞ্জ আমি মোকাবেলা করেছি। হয়তো আরেকটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য তিনি আমাকে তথ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন। সেটিতেও নেত্রী আস্থার রাখার চেষ্টা করব।’

তিনি বলেন, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ বিগত দুই বছরে এডিপির এক নম্বরে রয়েছে। আমি দেখিয়েছিলাম সৎ থাকা যায়, সঙ্গে এডিপিও বাস্তবায়ন করা সম্ভব।

‘আমি এখন পর্যন্ত আল্লাহর রহমতে কোথাও ব্যর্থ হইনি। আশা করি নতুন জায়গাতেও ব্যর্থ হব না’, যোগ করেন নবনিযুক্ত তথ্য প্রতিমন্ত্রী।

নতুন ডাক তার ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের উদ্দেশে তারানা হালিম বলেন, ‘উনাকে আমার মত ক্যান্সার মুক্ত করতে হবে না। আমি যে কেমোথেরাপি দিয়ে এসেছি, সেগুলো অব্যাহত রাখলেই হবে।’