নীল আকাশজুড়ে শরৎ মেঘের ভেলায় সেজেছে কুবি

নীল আকাশজুড়ে সাদা মেঘের এলোমেলো আনাগোনা। এলোমেলো উর্ধ্বমুখী কাঁশের ঘন অরণ্য। দিনের বেলা হাতের কাছে এ মেঘতুলায় চোখ জুড়াতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের পাশটায় বিচরণ ঘটে শিক্ষার্থীদের।

গোধূলির আকাশে রক্তিম আভা আর সাদা কাশফুলের সমারোহ যেন লাল-সাদার মিষ্টি রঙ খেলা। শত ব্যস্ততা, দম ফেলবার ফুরসত নেই এমন জীবনকাঠামোর মাঝে সাদা এক কোন বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবার সুযোগ দেয় সবাইকে।

ঋতুচক্রে এসেছে নির্মল প্রশান্ত শরৎ। এই শরৎকে অনুভব করতে ইট-পাথরের শহরে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দূরে কোথাও যেতে হবে না । প্রকৃতি নিজ হাতে শরতের রঙে ঢেলে সাজিয়েছে ক্যাম্পাসকে। গত ১৬ আগস্ট ছিলো বাংলা ভাদ্র মাসের প্রথম দিন। ভাদ্রের প্রথম দিন থেকে প্রিয় ঋতু শরতের প্রথম দিন শুরু৷ আশ্বিনের শেষ দিনটি পর্যন্ত থাকবে শরতের কাল৷ কদিন ধরেই রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশে ছাইরঙা মেঘ জড়ো হয়ে একপশলা বৃষ্টি দিয়েই লুকিয়ে যায় মুহুর্তে, তার মাঝে অসহনীয় তাপপ্রবাহ শরীরকে যেন নেতিয়ে ফেলছিলো। শরতে তো এত তাপ থাকার কথা নয়! আক্ষেপ থেকে যাচ্ছিলো যান্ত্রিক সময়ের পরিবর্তনে ঋতুচক্রের মধুর সুখ থেকে অনেকটাই বঞ্চি হওয়ার। তবু বাংলার ঋতুবৈচিত্রে অনুভব করা করা যায় এসেছে মিষ্টি মধুর শরত। বর্ষা ফেলে সাদা ডানা মেলে মেঘেরা যেতে শুরু করেছে দূরে। মেঘ গলে স্নিগ্ধ কিরণ ধীরে ধীরে আছড়ে পড়ছে ঘাসে। শরতে শুভ্রতায় গা ভাসানোর, কাশের দোলায় মন মাতানোর এখনই তো সময়।

এই ক্যাম্পাসের ভবনগুলো সব ছোট ছোট টিলার উপরে অবস্থিত। এই শরতে টিলাগুলো শুভ্র কাশফুলে ছেয়ে গেছে প্রতিবারের মতো। সাদা মেঘের ভেলায় প্রানবন্ত হয়ে উঠেছে লাল মাটির ক্যাম্পাস কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে চোখে পড়ে মাঠের কোলের কাশফুল৷ শহীদ মিনারের পাশ বেয়ে, কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের পাহাড়গুলোর পাদদেশ ঘেঁষে, লালন চত্বরে ছড়িয়ে আছে কাশের ভেলা। যেন প্রকৃতি আকাশের মেঘ-তুলোদের ছোট্ট দলকে নামিয়ে নিজ হাতে সাজিয়েছে দিয়েছে ক্যাম্পাস। হলের সামনের রাস্তা থেকেই এ পথের দিকে শিক্ষার্থীদের যেন কাশফুল ডাকে । কাশফুলের নরম ছোঁয়ায় মন আবেশে ডুবে যায়, সুপ্ত তুলোমাখা ছোঁয়া ফুলের মেলায় মনটা উড়ে যায়।

পড়ন্ত বিকেলে মেঘেরা ভেসে চললে নীল আকাশের আঁচলের নিচে ছুটে চলে কিছু তরুণ প্রাণ, কখনো মায়া নিয়ে কুড়িয়ে নিতে আসে শুভ্র কাশফুল। তরুনীরা আকাশের রঙের সাথে মিল রেখে নীল শাড়িতে নিজেকে রাঙিয়ে হেসে উঠে কাশফুলের সাথে। শাড়ির আঁচলে এক টুকরা নীল আকাশ হয়ে ধরা দেয় প্রকৃতির এ মন মাতানো সাজ। গৎবাঁধা নাগরিক জীবন থেকে ছিটকে বেরিয়ে খোলা আবহাওয়ায় শরৎ গায়ে মেখে কৈশোরকে কাছে থেকে দেখে আসা শিক্ষার্থীদের নিতান্ত প্রয়োজনবোধই। শুধু শিক্ষার্থী না বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার আশপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকেও শরতের এই রূপ দেখার জন্য ছুটে আসছে অনেকে। এমন সৌন্দর্য উপভোগ করতে কেউবা বন্ধের দিনে স্বপরিবারে আসছেন ভালো কিছু মুহূর্ত কাটাতে, আবার কেউ প্রিয়জনের সাথে এসেছেন সোনালী শরতের মিষ্টি গন্ধের স্বাদ নিতে।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিশু-সন্তান নিয়ে বিকেলে ঘুরতে আসা শহীদুল ইসলাম বলেন, “আসলে এইসময়টা কাশফুলের হলেও কখন আর কোথায় ফুটছে বলা যায় না এখন। বিশ্ববিদ্যালয়ে কাশ ফুটে প্রতিবার, তাই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে দেখাতে এলাম। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় লালমাই পাহাড়ের উপর অবস্থিত, পরিবেশ খুবই সুন্দর, শরতে কাশফুল আরো সুন্দর করে তুলে।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী মারুফ এর বক্তব্যে, “সেদিন হঠাৎ করেই কাশবন দেখতে গেলাম। এ এক দারুণ মুহুর্ত ছিলো। কাশফুলের সাথে শরতের সাদা মেঘের যেন পাল্লা দেওয়ার খেলা চলছে। আকাশ বয়ে নিচ্ছে পেজা তুলোর মতো সাদা মেঘের ভেলা আর কাশফুল ছড়িয়ে দিচ্ছে শুভ্রতা।আর সে শুভ্রতা নিতেই গিয়েছিলাম। মনে হলো কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় কে কাশবন জানিয়ে দিচ্ছে শরৎ এসে গেছে।আর তার বিশুদ্ধতা ছড়িয়ে দিচ্ছে পুরো ক্যাম্পাসে।আমিও তার অংশ হতে পেরে আনন্দিত।”

শরতের বন্দনা করতে গিয়ে কবি আল মাহামুদ বলেছেন,
‘ঋতুর অতীত আমি। কে জিজ্ঞাসে এটা কোন মাস?
বাতাসে গড়িয়ে পড়ে বিদায়ের বিষণ্ণ নির্যাস।
শ্রবণের ও শক্তি নেই। কিন্তু ভাবি কোলাহল আছে
প্রতিটা বাড়ির রন্ধ্রে, ইটে ইটে আনাচে- কানাচে!
এটা কি শরৎ সন্ধ্যা? বাংলাদেশ?
কাশফুল ছেয়ে গেছে চর?’

প্রচন্ড গরমের দাবদাহের পর এক পশলা বৃষ্টি শেষে সাদা সাদা মেঘেরা উড়ে বেড়ায় আকাশে। গুমোট আবহাওয়াকে ফেলে শরতের কাশবনের প্রাকৃতিক বাতাস আনে স্বস্তির নিশ্বাস। ক্লাসের ফাঁকে সুযোগ পেলেই প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে শিক্ষার্থীরা চলে আসেন কাশবনের রূপ–লাবণ্যে মুগ্ধ হতে। কাশবনের পাশে বসে দলীয় গানে সময় বিলাশ নিত্যকার অভ্যাস। বিকেলের ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী ও যুগলেরা কাশফুল বিলাস করতে এসে হারিয়ে যান শুভ্র অনন্য রাজ্যে।