নয়ন এক বছর ধরে উত্যক্ত করত : রিফাতের স্ত্রী

বরগুনায় রাস্তায় ফেলে প্রকাশ্যে স্ত্রীর সামনে রিফাত শরীফ (২৫) নামে যুবককে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় নাড়া দিয়েছে বিশ্ববিবেক। তাকে বাঁচাতে নববধূ আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি ছাড়া কেউ এগিয়ে না আসায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন আদালতও।

বর্বর এই হত্যাকাণ্ডের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রকাশ্যে এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিন্দার ঝড় বইছে। সবাই এ ঘটনায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করছেন।

রিফাত শরীফকে স্ত্রীর সামনে কুপিয়ে হত্যার পর এর কারণ নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। অনেকে বলছেন রিফাতের স্ত্রীর সঙ্গে ঘাতক নয়ন বন্ডের সম্পর্ক ছিল। সেটি রিফাত মেনে নিতে পারছিলেন না। এ কারণেই তাকে খুন করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছেন মিন্নির সঙ্গে নয়নের সম্পর্কের বিষয়টি একতরফা। নয়ন মিন্নিকে পছন্দ করলেও মিন্নি তাকে পছন্দ করত না। বিয়ের পর থেকে মিন্নিকে উত্যক্ত করে আসছে নয়ন। দুই মাস আগে নয়নের সঙ্গে বিয়ে হওয়া মিন্নির জবানিতেও এমন তথ্য উঠে এসেছে।

বুধবার এই হত্যাকাণ্ডের পর বৃহস্পতিবার এ নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন স্বামী হারা মিন্নি। এ সময় হত্যাকাণ্ডের সেই নির্মম ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি।

বৃহস্পতিবার সকালে বরগুনা শহরের স্টেডিয়াম সড়কে নানা আলতাফ মোল্লার বাসায় সাংবাদিকদের সঙ্গে এ ঘটনার বর্ণনা দেয়ার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন মিন্নি।

মিন্নি জানান, রিফাতের সঙ্গে দুই মাস আগে তার বিয়ে হয়। তবে এর প্রায় বছর খানেক আগে থেকেই সাব্বির হোসেন নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড তাকে উত্ত্যক্ত করত। মিন্নি বলেন, ‘রিফাতের সঙ্গে আমার দুই আড়াই বছরের সম্পর্ক। আর এই নয়ন আমাকে ডিস্টার্ব করে এক বছরের মতো হইছে। ও আগে অল্প করত, তারপর দিনের পর দিন বাড়তে থাকে। ফোনে কথা বলতে হইবে, তারপর আমি রিকশায় গেলে রিকশায় লাফ দিয়ে উঠত। এক জায়গায় গেলে ওই জায়গা গিয়ে ডিস্টার্ব করত। ওই জায়গায় গিয়ে হুমকি-ধামকি দিত।’

মিন্নিকে নয়ন মেরে ফেরার হুমকিও দেন। এমনটি জানিয়ে মিন্নি বলেন, নয়ন বলত তার সঙ্গে কথা না বললে মাইরে ফালাবে। আমাকে জানে শেষ করে ফেলবে। পরে আমি অনেক ভয় পাই। আমার বাসার সবার সঙ্গে শেয়ার করি। পরে আমার আব্বু আমার কাকাদের সঙ্গে আলাপ করি। পরে রিফাতের সঙ্গে আমার আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়।’

বিয়ের পর রিফাতের সঙ্গে ভালোই কাটছিল সময়টা জানিয়ে মুন্নি বলেন, ‘বিয়ে হইছে দুই মাস হয়। আমরা দুজনে খুব ভালোই ছিলাম। খুব সুখেই ছিলাম। একজন আরেকজনরে ছাড়া থাকতেই পারতাম না। কিন্তু নয়নের ডিস্টার্ব করা কমেই না। আমাকে ডিস্টার্ব করতেই থাকে। আমার স্বামীও জানত। এখন এই নিয়ে কোনো ঝামেলা হইছে কি না জানি না। আমি কলেজে গেছিলাম ও আমারে আনতে গেছিল। পরে আমরা কলেজ থেকে বের হই, তখন কিছু ছেলে এসে রিফাতকে আক্রমণ করে, মারা শুরু করে। আমি অনেক চেষ্টা করি ফেরানোর। কিন্ত পারি না। পরে রামদা নিয়া আক্রমণ করে ; আমি অনেক চেষ্টা করছি, আমি অস্ত্র ধরছি, তাদের ধরছি, চিৎকার করছি। কেউ আগায়ে আসে নাই, কেউ একটু হেল্প করে নাই। আমি খুব আপ্রাণ চেষ্টা করছি। কিন্তু আমার স্বামীকে বাঁচাইতে পারি নাই। আমি একলা হাসপাতালে নিয়া গেছি।’

ভিডিও ফুটেজে দেখতে পাওয়া লোকজন সম্পর্কে আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, ‘এই মানুষ কিছু দাঁড়ায়ে দেখছে। আর কিছু ছেলেরা আছে যারা প্রথমে ওরে আক্রমণ করছিল। পরে তো দুজনে না, তিনজনই (রামদা) নিয়া আসছে। কিন্তু প্রথমে দাঁড়ানো যে ছেলেগুলো ছিল, প্রথমে ওরা আক্রমণ করছে। আর আশেপাশে তো সবাই দেখছে কেউ আগায়ে আসে নাই, কেউ আমারে কোনো রকম সহায়তা করে নাই।’

জড়িতদের শাস্তির বিষয়ে আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই। আমি নয়ন, রিফাত ফরাজী, রেশান ফরাজী আরও ওই জায়গায় যারা ছিল প্রত্যেকের ফাঁসি চাই।’

বিয়ের আগে নয়নের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল কি না বা আর কেউ বিরক্ত করত কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে রিফাতের স্ত্রী বলেন, ‘কোনো সম্পর্ক ছিল না। ওই আমাকে হুমকি-ধামকি দিত, বিরক্ত করত। আমি ভয়ে কারও কাছে বলতাম না, পরে আমি বলছি।’

নিহত রিফাত শরীফের বাড়ি বরগুনা সদর উপজেলার ৬নং বুড়িরচর ইউনিয়নের বড় লবণগোলা গ্রামে। তার বাবার নাম আ. হালিম দুলাল শরীফ। মা-বাবার একমাত্র সন্তান ছিলেন রিফাত।

বুধবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে স্ত্রী মিন্নিকে বরগুনা সরকারি কলেজে নিয়ে যান রিফাত। কলেজ থেকে ফেরার পথে মূল ফটকে নয়ন, রিফাত ফরাজীসহ আরও দুই যুবক রিফাত শরীফের ওপর হামলা চালায়। এ সময় ধারালো অস্ত্র দিয়ে রিফাত শরীফকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন তারা। রিফাত শরীফের স্ত্রী মিন্নি দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কিছুতেই হামলাকারীদের থামানো যায়নি। তারা রিফাত শরীফকে উপর্যুপরি কুপিয়ে রক্তাক্ত করে চলে যান। পরে স্থানীয় লোকজন রিফাত শরীফকে গুরুতর আহতাবস্থায় উদ্ধার করে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে রিফাত শরীফের মৃত্যু হয়।

নিহতের পরিবার জানায়, রিফাতকে কুপিয়ে হত্যায় অংশ নেয় নয়ন বন্ডসহ ৪-৫ জন। রিফাতের সঙ্গে দুই মাস আগে পুলিশলাইন সড়কের আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির বিয়ে হয়। বিয়ের পর নয়ন মিন্নিকে তার প্রেমিকা দাবি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপত্তিকর পোস্ট দিতে থাকেন।

রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বলেন, নয়ন প্রতিনিয়ত আমার পুত্রবধূকে উত্ত্যক্ত করত এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপত্তিকর পোস্ট দিত। এর প্রতিবাদ করায় আমার ছেলেকে নয়ন তার দলবল নিয়ে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে।