পরীক্ষার্থী ২৪৯, অটোপাশ ২৫৯ জনের!

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার সাফা ডিগ্রি কলেজে অবৈধভাবে ১০ জন ভুয়া শিক্ষার্থীকে অটোপাশ করানো হয়েছে। করোনা সংকটে অটোপাশের সুযোগ নিয়ে কলেজের একটি দুষ্ট চক্র শিক্ষা বোর্ডের সংশ্লিষ্ট অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সনদ বানিজ্যে জড়িয়ে পরে। গভর্নিং বডির প্রাথমিক তদন্তে এ অনিয়মে জড়িত ২ জনের নাম উঠে এসেছে। এর মধ্যে কলেজের প্রধান অফিস সহকারী জীবন কৃষ্ণ পাইক জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। একজন প্রভাষকও জড়িত আছে।তবে চুড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনে তার নাম প্রকাশ করা হবে বলে জানান তদন্ত কমিটি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলার সাফা ডিগ্রি কলেজে এইচএসসি পরীক্ষা – ২০২০ সালে কলেজ থেকে ২৪৯ জন শিক্ষার্থী ফরম ফিলাপ করে। প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বিনয় কৃষ্ণ বল কলেজ থেকে ফরম পূরণকৃত ২৪৯ জনের নাম বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে অগ্রগামী করেন। কলেজে এর একটি কপি সংরক্ষণ করেন।

এদিকে অটোপাশের কথা শুনে অফিস সহকারী জীবন কৃষ্ণ পাইক নড়ে চড়ে বসে। সাথে নেয় একজন কলেজ প্রভাষক। অবৈধভাবে এইচএসসি পাশ করতে চাওয়া ১০ জনকে ম্যানেজ করে তারা। প্রত্যেকের কাছ থেকে নেওয়া হয় মোটা অংকের টাকা।বোর্ডের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সাথে শক্ত যোগাযোগ থাকায় সফলও হয় তারা। তবে কলেজে বৈধভাবে ফরম পূরণকৃত শিক্ষার্থীদের তালিকা সংরক্ষিত থাকায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়।

এইচএসসি ২০২০ সালের রেজাল্টের পর বরিশাল শিক্ষা বোর্ড থেকে ২৫৯ জনের একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট আসে। ২৪৯ জন পরীক্ষার্থীর অতিরিক্ত ১০টি একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট জব্দ করেন অধ্যক্ষ। একটি অবৈধ প্রবেশপত্র জব্দ করতে পারলেও বাকিগুলো লুকিয়ে ফেলেন জালিয়াতি চক্রের সদস্যরা।

কলেজ থেকে ফরম পূরনের অতিরিক্ত একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট ও একটি প্রবেশ পত্র জমাদান ও বাতিল প্রসঙ্গে আবেদন করা হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড বরিশালের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মহোদয় বরাবর আবেদনটি করেন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বিনয় কৃষ্ণ বল। আবেদনের সাথে অবৈধ ১০টি মূল একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট ও ১টি মূল প্রবেশপত্র (রোল – ৬০২৯৪৩ বিজ্ঞান) জমা দেওয়া হয়।

অবৈধভাবে পাশ করানো ১০ জন হলো – আবির মিত্র পিতার নাম – তাপস মিত্র বোর্ড রোল – ৬০২৯৪৩, মোঃ মুকিত হোসেন পিতার নাম – মোঃ মঞ্জুর মোর্শেদ বোর্ড রোল – ৯০০১৩৮, মোঃ হাসিব পিতার নাম – মোঃ বাদল শিকদার বোর্ড রোল – ৯০০১৩৯, সুরাইয়া আক্তার পিতার নাম – মোঃ এনায়েত হোসেন বোর্ড রোল – ৯০০১৪০, মোসাঃ শারমিন আক্তার পিতার নাম – মোঃ লোকমান সরদার বোর্ড রোল – ৯০০১৪১, মোসাঃ মারিয়া আক্তার পিতার নাম – মোঃ শহিদুল ইসলাম বোর্ড রোল – ৯০০১৪২, জান্নাতি পিতার নাম – মোঃ জাকির আকন বোর্ড রোল – ৯০০১৪৩, তানিয়া আক্তার পিতার নাম – মোঃ সুরুজ মিয়া বোর্ড রোল – ৯০০১৪৪, মোঃ জান্নাতুল ফেরদৌস পিতার নাম – মোঃ শফিকুল ইসলাম বোর্ড রোল – ৯০০১৪৫, হৃদয় কুমার রায় পিতার নাম – ধলু চন্দ্র রায় বোর্ড রোল – ৯০০১৪৬। এদের মধ্যে ৫ জন কলেজের বহিরাগত। এদের নাম কলেজের ভর্তি রেজিস্ট্রার খাতায়ও নেই।

বিষয়টি নিয়ে মঠবাড়িয়ায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।

সবার চোখ এখন তদন্ত কমিটির দিকে।

১৮ জুলাই গভর্নিং বডির সভায় ৬ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে রয়েছেন – প্রভাষক শাকিল আহমেদ – সদস্য, প্রভাষক মোঃ ফজলুল হক – সদস্য, প্রভাষক মোঃ ইব্রাহীম, প্রভাষক নাজনীন জায়েদা খানম, মঠবাড়িয়া পৌরসভার সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার, কলেজ গভর্নিং বডির শিক্ষানুরাগী সদস্য আবু মোতালেব – আহ্বায়ক।

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক আবু মোতালেব (মধু কমিশনার) জানান, প্রথম ভিজিটেই অনিয়মের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছি। বৃহস্পতিবার (২৬ আগস্ট) ২য় ভিজিটের দিন ধার্য ছিল। কিন্তু অভিযুক্তরা সময় চাওয়ায় পরবর্তীতে আবার তদন্তের দিন ধার্য করা হবে।

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত প্রধান অফিস সহকারী জীবন কৃষ্ণ পাইক মোবাইল ফোনে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলে মূল বিষয়টি এড়িয়ে যান। কখনো বলেন, কলেজ থেকে বাসায় এসে বিষয়টি জানাব। আবার কখনো বলেন মঠবাড়িয়ায় এসে বিষয়টি জানাব।

প্রভাষক বাদশা মিয়া ফোনে জানান, অনিয়মের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। অফিস সহকারী জীবন কৃষ্ণ পাইক এ বিষয়টি জানে।

অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে পাশ করা ১০ জনের সাথে কথা বলা সম্ভব না হলেও মোঃ মুকিত হোসেন (বোর্ড রোল- ৯০০১৩৮) এর মা খালেদা ইয়াসমিন জানান, আমরা কলেজের অফিস সহকারী জীবন কৃষ্ণ পাইকের কাছে ফরম ফিলাপের টাকা দিয়েছি। কলেজের অধ্যক্ষ বিষয়টি জানে না। এজন্য মূল মার্ক শীট আটকিয়ে রেখেছে।

কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বিনয় কৃষ্ণ বল জানান, অবৈধভাবে পাশ করা ১০ জনের একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট বাতিল চেয়ে বোর্ডে জমা দেওয়া হয়েছে। অনিয়মের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন ও যথাযথ কার্যার্থে বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মহোদয় বরাবর আবেদন করা হয়েছে।

কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আশরাফুর রহমান জানান, কলেজের কয়েকজন অসাধু শিক্ষক কর্মচারী ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডের কিছু অসাধু কর্মকর্তার কারসাজিতে সনদ বানিজ্য ধরা পড়েছে। কলেজে কারা জড়িত তা বের করার জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুস জানান, কলেজ অধ্যক্ষ অতিরিক্ত ১০টি একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট ও একটি প্রবেশপত্র বোর্ডে ফেরত পাঠিয়েছে। এগুলো বাতিল করা হয়েছে।