পাকিস্তানি সৈন্য বোঝাই ট্রেন উড়িয়ে দেয়া সেই মুক্তিযোদ্ধা আজ ভিক্ষুক

ছিলেন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেনীর শিক্ষার্থী। সেই সময়েই বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন পাকিস্তানি হায়নাদের বিরুদ্ধে। দেশের তরে নিজেকে বিলিয়ে দিতে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে ভারতের হরিয়ানা রিপুজি ক্যাম্পে একাধিক অস্ত্র চালানো প্রশিক্ষন নিয়ে যোগ দিয়েছেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। রেল পথে মাইন পুতে উড়িয়ে দিয়েছেন পাকিস্তানি সৈন্য বোঝাই ট্রেন।

পাহার বেঁয়ে উঠতে গিয়ে পাথরে আছরে পড়ে গুরতর আহত হয়েছেন বেশ কয়েকবার। সেই রনাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধাই আজ ক্ষুধার জ্বালায় ভিক্ষা করছেন মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। মো. মোস্তফা ভুইঁয়া, একজন শ্রমজীবী মানুষ অথবা ভিক্ষুক হিসেবেই তার পরিচয় জানেন অনেকই। তবে মহান মুক্তিযুদ্ধে হার না মানা একজন লড়াকু যোদ্ধা বলে দাবী তার।

১৯৪৯ সালে চট্রগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলার কাঠঘর ইউপির মুন্দার গ্রামে আবদুল কুদ্দুস ভ‚ইঁয়ার ঘরে জন্মগ্রহন করেন তিনি। মাত্র ১৮ বছর বয়সে দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের মাধ্যমে একজন সাহসী গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে একাধিক সেক্টরে যুদ্ধ করে পাকিস্তানিদের পরাস্ত করেছেন। তবে দেশের জন্য এতো আতœত্যাগের পরও স্বাধীনতার ২ বছর পর নদী ভাঙ্গনে তার সব কিছু বিলিন হয়ে গেলেও আজও কোথাও মাথা গোজার ঠাই হয়নি বাংলার এই সুর্য সন্তানের। সর্বস্ব হারিয়ে জীবীকার তাগিদে ২০০২ সালে জন্মভ‚মি ছেড়ে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় এসে বিভিন্ন যায়গায় প্রতিবন্ধী স্ত্রীকে নিয়ে ভ্রাম্যমান বসবাস শুরু করেন। কর্মের সন্ধ্যান করে খুজে নেন গভীর সমুদ্রে মৎস্য শিকারের কাজ। দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ ধরে জেলে পেশায় কাজ করলেও বয়সের ভাড়ে নুয়ে পড়ায় কর্মদক্ষতা হারিয়ে এখন করছেন ভিক্ষাবৃত্তি।

বর্তমানে কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউপির পাখিমারা বাজার সংলগ্ন মোসলেম শিকদারের বাড়িতে আশ্রীত থেকে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তিনি ও তার স্ত্রী নুরুননাহার। যেদিন ভিক্ষা করতে পারেন সেদিন দুবেলা আহারের ব্যবস্থা হয়। নয়তো অর্ধাহারে অনাহারেই কাটছে এ দম্পত্তির জীবন সংসার। যুদ্ধকালীন সময়ে পায়ে আঘাপ্রাপ্ত হওয়ায় আজও প্রতি রাতের নিদ্রায় যন্ত্রনাসিক্ত হয়ে কাঁদেন বৃদ্ধ মোস্তফা। দাড়িদ্রতার কষাঘাতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা কিংবা ওষুধটুকুও খেতে পারছেন না।

এতোকিছুর পরেও স্বাধীন দেশে শান্তির নিঃশ্বাস নিতে পারেছন বলে গর্ববোধ করেন এ মানুষটি। তবে মৃত্যুর এক মিনিট আগমূহুর্তে হলেও একজন মুক্তিযোদ্ধার স¦ীকৃতি চান তিনি। নয়া শতাব্দীর সাথে মোস্তফা ভ‚ইঁয়ার কথা হলে অমোঘ সীকারোক্তিতে ভেসে ওঠে ৭১ সালের যুদ্ধকালীন সময়ের চিত্র। জানান স্মৃতিবিজড়িত অস্ত্র প্রশিক্ষনের কথা। তার ভাষ্যমতে ভারতীয় সেনা বাহিনীর মেজর নাসীমারাও শিকের নেতৃত্বে একাটানা ১৫ দিন একাধিক অস্ত্র প্রশিক্ষন নিয়েছেন তিনি। যার মধ্যে রয়েছে থ্রী নট থ্রী রাইফেল প্রশিক্ষণ, মার একফোর রাইফেল, লাইট মেশিন গান, এসএস এলার, হ্যান্ড গ্রেনেড এস এস থার্টি সিক্স, এনটি ট্যাংক মাইন, গাছকাটা বারুদ প্রশিক্ষণসহ আরো অনেক প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফেরেন।

পরবর্তীতে চট্রগ্রাম ৪ নম্বর সেক্টরে মেজর শামিমের নেতৃত্বে দুই পাহারের মাঝখান দিয়ে বয়ে চালা কুমিরা রেল পথে মাইন পুতে রাখার দায়ীত্ব পালন করেন তিনি। এবং ভারতের মৃৎ ডালডা কোম্পানি বাহিনীর সাথে পাকিস্তানিদের সৈন্য বহনকৃত ট্রেনে হামলা চালিয়ে তাদের পরাস্ত করেন। তবে সেদিন তাদের নেতৃত্বে থাকা মেজর শামিম পাকিস্তানিদের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন। ওইদিন তিনি পাহার বেঁয়ে উপরে উঠতে গিয়ে পাথরে আছরে পরে পায়ে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে সঙ্গাহীন হয়ে পরেন। পরে ভারতীয় সৈন্যরা তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যান। তার চিকিৎসাকালীন অবস্থায় সাতদিন পরে দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। এসব স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন।

তিনি বলেন, সেই সময় জীবনের মায়া ত্যাগ করে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছি, তিনি আজ বেঁচে নেই। তবে আজ বঙ্গবন্ধুর কন্যা পর্যন্ত যাবার ক্ষমতা আমার নেই। বর্তমানে আমি কলাপাড়ার নাগরিক, ২০ বছর ধরে এখানে ভোটাধিকার প্রয়োগ করছি। অনেকবার চেয়ারম্যান, ইউএনও, উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছি। কিন্তু কেউ আমাকে আমার ত্যাগের স্বীকৃতি দেয়নি। এমনকি বঙ্গবন্ধুর নামে যে ঘর দেয়া হচ্ছে একটা ঘরও আমাকে দেয়নি। আমি শেখ হাসিনার কাছে যেতে চাই।

এবিষয়ে কলাপাড়া উপজেলার যুদ্ধকালীন কমান্ডার হাবিবুল্লাহ রানা বলেন, মোস্তফা একজন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা। এদেশ স্বাধীন হওয়ার পিছনে তার অবদান রয়েছে। তবে দুঃখের বিষয় হলো তাকে আজও তালিকাভুক্ত করে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। আমি তার জন্য চেষ্টা করছি।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবুহাসনাত মো. শহীদুল হক জানান, তার বিষয়ে তালিকা পাঠানো হয়েছে কিনা খোঁজ নিয়ে দেখছি। যদি গেজেটভুক্ত হয় তবে মুক্তিযোদ্ধার কোঠায় তিনি ঘর পাবেন। এছাড়া আমি বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখবো।