পাহাড় ধস : যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদ

পাহাড়ধসে রাঙামাটির সড়কব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ২৪২ কিলোমিটার দূরত্বের সাতটি সড়কের ১৪৫টি স্থানে পাহাড়ধস হয়েছে। প্রধান সড়কটির (রাঙামাটি-চট্টগ্রাম) দুটি অংশে সড়কের অস্তিত্বই নেই। এ যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত এক জনপদ।

এদিকে নতুন করে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় রাঙামাটিতে আবার আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বৃহস্পতিবার রাতেই ঘরবাড়ি ছেড়ে শহরের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটে যায় অসংখ্য মানুষ। গতকালও দিনভর গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে। পাহাড়ধসের সতর্কবার্তা জারি করে শহরে সকাল থেকে অবিরাম মাইকিং করেছে জেলা প্রশাসন। শহরের ১৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে অন্তত আড়াই হাজার মানুষ অবস্থান করছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় দিনে শুধু রাঙামাটিতেই বৃষ্টি হয়েছে ৬১৫ মিলিমিটার, যা ৪০ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে আজও দেশের চট্টগ্রাম ও সিলেটে ভারী বৃষ্টিপাতের কথা বলা হয়েছে। এই দুই বিভাগে ভূমিধসের আশঙ্কাও করা হয়েছে।

পাহাড়ধসের ঘটনায় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে এ পর্যন্ত ১৪৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সোমবার মধ্যরাত থেকে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ওই পাঁচ জেলায় পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। গতকাল সন্ধ্যায় রাঙামাটিতে উদ্ধার অভিযান আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন। তবে ধ্বংসস্তূপে কোনো মরদেহ চিহ্নিত করা গেলে ফায়ার সার্ভিস উদ্ধারে কাজ করবে।

গত রাত নয়টায় রাঙামাটির জুরাছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী মুঠোফোনে বলেন, উপজেলার দুমদুম্যা ইউনিয়ন থেকে বিকেলে দুজনের লাশ উদ্ধার করেছেন তাঁরা। এই দুটি লাশসহ সব মিলিয়ে গতকাল রাত পর্যন্ত রাঙামাটি থেকে মোট ১১২টি লাশ উদ্ধার হয়েছে।

এ ছাড়া বান্দরবান, চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, চন্দনাইশ, ফটিকছড়ি, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারের টেকনাফে পাহাড়ধসে মারা গেছে ৩৫ জন। সব মিলিয়ে পাহাড়ধসে প্রাণ হারিয়েছে ১৪৭ জন। এ তথ্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের।

এদিকে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের অবস্থা সরেজমিনে দেখতে গতকাল শুক্রবার সকাল ১০টায় রাঙামাটি শহর থেকে অটোরিকশা নিয়ে রওনা হন প্রথম আলোর দুই প্রতিবেদক। ৭৪ কিলোমিটার দীর্ঘ রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কের মাত্র ১০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার পরই প্রথম বাধা আসে মানিকছড়িতে। অবশ্য শহরের সীমানা পেরোনোর পরই দেখা যায় বালুর বস্তা ও ইট দিয়ে সড়কের এক পাশে বিভাজক তৈরি করা হয়েছে। বিভাজকের উল্টো পাশে একটু পরপর সড়কে ফাটল দেখা যায়।

মানিকছড়িতে সেনাক্যাম্প পেরোনোর পরই থমকে দাঁড়াল অটোরিকশাটি। পাহাড়ধসের কারণে রাস্তায় জমেছে মাটির স্তূপ। এই স্তূপের পেছনে সড়কের এক পাশের অন্তত ৩০ গজ পড়ে গেছে গভীর খাদে।অটোরিকশাচালক বলেন, ‘গাড়ি নিয়ে আর এগোনো যাবে না। পাহাড়ধসে এখানেই সেনাবাহিনীর চারজন মারা গেছেন।’

মানিকছড়িতে অটোরিকশা থেকে নেমে দুই প্রতিবেদক বৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রধান সড়ক ধরে সামনের দিকে এগোতে থাকেন। পথে পথে সড়কটির যে দুরবস্থা চোখে পড়ে, তা যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের দৃশ্যকেও হার মানায়।

বৃষ্টির মধ্যেই বিধ্বস্ত সড়ক ধরে গতকাল রাঙামাটি ও চট্টগ্রামমুখী লোকজনকে হেঁটে গন্তব্যে ছুটতে দেখা যায়। রাঙামাটি থেকে চট্টগ্রাম যেতে প্রধান সড়কের মানিকছড়ি পর্যন্ত অটোরিকশা চলাচল করতে পারছে। এরপর মানিকছড়ি থেকে কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া পর্যন্ত প্রায় আট কিলোমিটার সড়ক পায়ে হাঁটতে হচ্ছে। কারণ, ঘাগড়াতেও পাহাড়ধসে রাস্তা বন্ধ হয়ে আছে। এ কারণে চট্টগ্রাম থেকে কোনো গাড়ি ঘাগড়ার পর রাঙামাটির দিকে এগোতে পারছে না।

কুমিল্লায় চাকরিরত সেনাসদস্য শিপন মিয়ার বাড়ি রাঙামাটিতে। দুর্যোগের পর স্বজনদের দেখতে তিনি রাঙামাটির পথে রওনা হন। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তাঁর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের দেখা হয় প্রধান সড়কের সাপছড়ি এলাকায়। শিপন বলেন, ‘ঘাগড়া পর্যন্ত গাড়িতে এসেছি। এরপর পায়ে হেঁটে রাঙামাটি যেতে হচ্ছে।’

শিপনের মতো অনেক নারী-পুরুষ জরুরি প্রয়োজনে ছুটছে চট্টগ্রামের পথে। কেউবা উল্টোদিকে রাঙামাটির উদ্দেশে। কাউখালী উপজেলার ঘাগড়ার নতুন পাড়া থেকে সবজি নিয়ে তিন পাহাড়ি গতকাল সকাল সাতটায় রাঙামাটির উদ্দেশে রওনা দেন। সকাল সাড়ে ১০টায় তাঁদের পাওয়া যায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে সাপছড়ি এলাকায়।

পাহাড়ধসে রাঙামাটির সড়কব্যবস্থার কতটা ক্ষতি হয়েছে, তার চিত্র পাওয়া গেছে সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী এমদাদ হোসেনের বক্তব্যে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাঙামাটিতে সওজের ২৪২ কিলোমিটার দূরত্বের সাতটি সড়কের ১৪৫টি স্থানে পাহাড়ধস হয়েছে। ৩৭টি স্থানে সড়ক ধসে গেছে। প্রধান সড়কটির (রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়ক) দুটি অংশে সড়কের অস্তিত্বই নেই। এ ছাড়া কয়েকটি স্থানে সেগমেন্টসহ (রাস্তার পাশ থেকে) মাটি নেমে গেছে।

এমদাদ হোসেনের বক্তব্যের সত্যতা মেলে সড়ক ধরে হাঁটতে গিয়ে। প্রথমে অটোরিকশায় ও তারপর হেঁটে রাঙামাটি থেকে সাপছড়ি পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার রাস্তায় দেখা গেছে, অন্তত ৪০টি স্থানে সড়কের ওপর পাশের পাহাড় ভেঙে পড়েছে। ২২টি স্থানে প্রধান সড়কটিতে বড় বড় ফাটল রয়েছে। কিছু অংশ পড়েও গেছে। দেখে মনে হয়, যেন ডিনামাইট দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সড়কের অংশটি।

সড়কের সাতছড়ি এলাকায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া দেড় শ মিটার পার হয়ে আবারও দুই কিলোমিটার এগিয়ে দেখা গেল একই চিত্র। সড়কের এক পাশ নেই। মাটি পড়ে স্তূপ হয়ে রয়েছে সড়কজুড়ে। সেখানে তিনটি বুলডোজার ও একটি এক্সকাভেটর দিয়ে সড়কের মেরামতকাজ করছিলেন সওজের প্রকৌশলী ও শ্রমিকেরা। অন্তত ১০টি স্থানে ১০০ মিটার করে অংশ মাটি পড়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে আছে বলে তাঁরা জানান।

ক্ষতবিক্ষত সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে আশার বাণী শোনালেন উপসহকারী প্রকৌশলী আবু মুছা। তিনি বলেন, রাতদিন কাজ করছে সওজ। চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য দু-তিন দিনের মধ্যে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচলের উপযোগী করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। অস্তিত্বহীন অংশে বাইপাস করে দেওয়ার চিন্তা রয়েছে। বড় গাড়ি চলাচলের উপযোগী করতে সময় লাগবে বলে তিনি জানান।

চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগের দুটি বিকল্প সড়কের ঘাগড়া-বরইছড়ি সড়কটিও বিভিন্ন অংশে পাহাড়ধসে বন্ধ বলে জানালেন সওজের কর্মকর্তারা। স্থানীয় সরকার বিভাগের কাপ্তাই-রাঙামাটি সড়কটির একটি সেতুতে ফাটল দেখা দিয়েছে। এর বাইরে কয়েকটি রাস্তা পাহাড়ধসে অচল হয়ে পড়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী আতিয়ার রহমান বলেন, অনেক খারাপ অবস্থা সড়কটির। ঠিক হতে একটু সময় দিতে হবে। এ ছাড়া রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি সড়কও একই কারণে বন্ধ হয়ে রয়েছে। ওই সড়কে একটি সেতু ভেঙে গেছে।

রাস্তা পরিষ্কারের কাজ করছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকজনও। গতকাল সরকারি লোকজনের পাশাপাশি রাঙামাটি জেলা বিএনপির নেতা-কর্মীরাও সড়কটির বিভিন্ন অংশে জমে থাকা কাদামাটি সরাতে নেমে পড়েন। জেলা বিএনপির সভাপতি মো. শাহ আলম দাবি করেন, দুই শতাধিক নেতা-কর্মী গতকাল সকাল থেকে সড়কের মাটি পরিষ্কার করেছেন।

প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে গতকালও রাঙামাটিতে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। প্রথম আলোর চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও পটিয়া বন্ধুসভার সদস্যরা রাঙামাটি সরকারি কলেজ আশ্রয়কেন্দ্র, গোধূলি আমানতবাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র, বেতার ভবন এবং টেলিভিশন সম্প্রচার কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া দুর্গত মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেন।

আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক যোগাযোগ পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে আরও কয়েক দিন সময় লাগবে। এতে বলা হয়, মেজর ইফতেখারের নেতৃত্বে ১৯ ইসিবির একটি দল সড়ক ও জনপথ বিভাগের সহযোগিতায় এই সড়ক যান চলাচলের উপযোগী করতে কাজ করে চলেছে।

যোগাযোগবিচ্ছিন্ন রাঙামাটির অবস্থা এখন কেমন, তা জেলা প্রশাসনের মাইকিং শুনলেই বোঝা যায়। পাহাড়ধসের সতর্কতার পাশাপাশি বাজারে নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে জেলা প্রশাসন শহরজুড়ে মাইকিং করেছে। গতকাল থেকে সকাল ও বিকেলে রাঙামাটি ও কাপ্তাই নৌপথে চার জোড়া স্টিমার চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়েছে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। ওই স্টিমারযোগে পণ্য আনা-নেওয়ার অনুরোধ করা হচ্ছে।

জ্বালানি তেল সরবরাহকারী পেট্রলপাম্পগুলো গতকালও যথারীতি বন্ধ ছিল। খোলাবাজারে অকটেন বিক্রি হয়েছে লিটারপ্রতি ১৫০ থেকে ২০০ টাকায়। তেলের দাম বেশি হওয়ায় সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলো দ্বিগুণ ভাড়া নিচ্ছিল।

সূত্র : প্রথম আলো