প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতামঞ্চে এত মানুষ কেন?

সাহেদ আলম : এই প্রশ্নটি ঢাকা থেকে আগত প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সংগ্রহকারী সাংবাদিকদের। বিশেষত প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে দেশে-বিদেশে যখন প্রবল উৎকণ্ঠা তখন জাতিসংঘের সম্মলনে ভাষণ দেয়ার আগের দিন ম্যানহাটনে হোটেল ম্যারিয়টের বলরুমে আয়োজিত সংবর্ধনা সভায় প্রধানমন্ত্রী যেখানে বসেছিলেন, তার পেছনের মঞ্চে বসা ছিল শতাধিক মানুষ।

এরা কারা সেটা নিয়ে প্রশ্ন যেমন ঢাকার সাংবাদিকদের তেমনি নিউইয়র্কের স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরও।

‘আমরা প্রধানমন্ত্রীর বহু সমাবেশ কাভার করেছি। কিন্তু, সভামঞ্চে এত মানুষ কখনও দেখিনি। এমনকি তার নির্বাচনী প্রচারণার সময়ও এমনটি দেখা যায় না। এখানে ব্যতিক্রম। অনেকেই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বসে বা পেছনে দাঁড়িয়ে একটি ছবি তোলার জন্য পরিস্থিতিকে নাজুক করে তুলেছিল। এটা তার নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ’, এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলছিলেন ঢাকা থেকে আগত সাংবাদিক দ্বীপ আজাদ।

এরা কারা? এটা নিয়ে স্থানীয় সাংবাদিক এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরও প্রবল আগ্রহ। সারা বছর যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নানা কার্যক্রমে এদের বেশিরভাগ মানুষকে দেখা যায় না। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী এলে স্যুট-টাই পরে বসে যাওয়া এই মানুষগুলো কি আসলেই প্রবাসে আওয়ামী রাজনীতি করেন সক্রিয়ভাবে? নাকি প্রধানমন্ত্রীর পেছনে মঞ্চে বসতে তারা মোটা অংকের টাকা খরচ করেন, যার সুবিধাভোগী যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি?

এই উস্কে দেয়া আলোচনায় কিছুটা যোগ করেছেন প্রবাসী সাংবাদিক সোহেল মাহমুদ। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সভামঞ্চের একটি ছবি দিয়ে লিখেছেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিউইয়র্কে গণসংবর্ধনা দিতে গিয়ে হল ও অন্যান্য খরচ বাবদ শুধু হোটেলের বিল দিতে হয়েছে ৮৭ হাজার ডলার। সব মিলে খরচ ছাড়িয়ে গেছে এক লাখ ডলার। কারা দিয়েছে এই অর্থ? এই অর্থ ব্যয়ের আউটপুট কি? কিছু মানুষের ক্ষমতা দেখানোর আয়োজন থাকে এমন সংবর্ধনাগুলোয়। আর কিছু মানুষ করে চাঁদাবাজি। সামনের কাতারে বসার জন্য ১০ হাজার ডলার খরচ করতে কার্পণ্য থাকে না কারও কারও।’

তিনি আরও লেখেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মঞ্চে বসার জন্য ৪০ হাজার ডলার খরচের ঘটনা নিউইয়র্কে ‘মিথ’ হয়ে আছে। এমন সংবর্ধনার মাধ্যমে দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চাঙ্গা হয় না। ‘কাউয়া’ তৈরি হয়। কোনো যোগ্যতা ছাড়াই প্রথম সারিতে বসে সেটি টেলিভিশনে প্রচারের যাবতীয় ব্যবস্থা করে, এসব কাউয়া আবার দলে গ্রুপিং তৈরি করে। এমন একটা সংবর্ধনা আসলে পরবর্তী এক বছরের জন্য আওয়ামী পরিবারে কোন্দল-সামগ্রী তৈরি করে দেয়।’

সোহেল মাহমুদের কথার সত্যতা আছে। এবারের প্রধানমন্ত্রীর সংবর্ধনা নিয়ে এরই মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ এতটাই প্রতীয়মান হয়েছে যে, খোদ প্রধানমন্ত্রী নাকি যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্বের ওপর ক্ষেপেছেন।

যারা প্রধানমন্ত্রীর আশেপাশে ছিলেন, তারা শুনেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- ‘সিদ্দিকুর এবং নিজাম মিলে দলটাকে এখানে কুক্ষিগত করে ফেলেছে, এটা চলবে না। আমি খুব শিগগরিই নতুন কমিটি দেব’। প্রধানমন্ত্রীর এমন মনোভাবের তথ্য দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক সিদ্দিক।

প্রধানমন্ত্রী তার হোটেলে প্রবাসী নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের জন্য প্রায় দেড় ঘণ্টা বসেছিলেন। সেখানে তিনি চেয়েছিলেন, দলের নানা সংগঠন যেমন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ বা অন্যান্য যেসব অঙ্গ সংগঠন আছে তাদের নেতাদের সাসঙ্গে কথা বলবেন। কিন্তু. ডা. সিদ্দিকুর রহমান কাউকেই ভেতরে ঢুকতে দেননি। অথচ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য বাইরে নেতাকর্মীরা প্রায় কান্নাকাটি করেছেন। কিন্তু, সভাপতি ( ডা. সিদ্দিকুর রহমান) তার পছন্দের লোকদের, এমনকি অন্য স্টেটে থাকা লোকদের বেছে বেছে পাঠাতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। সেটা তিনি করেছেনও।

আর এই ঝামেলায় প্রায় এক ঘণ্টা প্রধানমন্ত্রী একা বসেছিলেন, অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দেখা করবেন বলে। সেটাতে বাধা দিয়েছিলেন সভাপতি। পরে এসএসএফ (প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তারক্ষী) বাইরে এসে হঠাৎ করে অপেক্ষমান অনেককেই ভেতরে নিয়ে যেতে চাইলে, সেখানেও বাধা দেন সিদ্দিকুর রহমান।

এ কারণেই ক্ষেপেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ‘এই কমিটি ভেঙে দেবেন তিনি।’- বলছিলেন দপ্তর সম্পাদক সিদ্দিক।

অবশ্য টাকার বিনিময়ে প্রধানমন্ত্রীর সভামঞ্চ বা অন্যান্য সাক্ষাতের সময়, যারা টাকা দিয়েছে তাদেরই প্রাধ্যন্য দেয়া হয়েছে কিনা সেটা জানতে জাইলে দপ্তর সম্পাদক মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, ‘এই বিষয়টি আমাদের সভাপতিকেই জিজ্ঞেস করতে হবে। কেন না, তিনি এই টাকা-পয়সার হিসাব কখনও আমাদের কাছে দেননি অতীতে। কোথা থেকে এত টাকা তিনি সংগ্রহ করেন, কোথায় খরচ করেন, সেটা আমরা জানি না। আমরা বাদ বাকি সব কাজ করি। কিন্তু, টাকা-পয়সার কাজ করি না।’

এসব অভিযোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা. সিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এই টাকার হিসাব আমি কাউকেই দেব না, কারও সেটা জানার অধিকারও নেই। আমি জানি ম্যানহাটনের মত একটি জায়গায় হোটেল ভাড়া নিয়ে একটি সংবর্ধনা সভা আয়োজন করতে কত কষ্ট। সেই সভায় সবাই যান, ছবি তোলেন- এটা আমাদের একটি রেওয়াজ। কিন্তু, সেটি সম্পন্ন করার দুরূহ কাজটি আমাকেই করতে হয়। তাই কত টাকা খরচ হলো, কিভাবে এল টাকা, কিংবা এই টাকার হিসেব-নিকেষ দিতে আমি কারও কাছে বাধ্য নই।’

প্রধানমন্ত্রীর এই বাৎসরিক সংবর্ধনা ঘিরে এখানে বার্ষিক একটি চাঁদাবাজির ক্ষেত্র তৈরি হয় বলে অভিযোগ অনেক দিনের। ম্যারিয়টে এবারের সংবর্ধনায় হল ভাড়া, স্টেট নির্মাণসহ খরচ হয়েছে প্রায় ৮০-৯০ হাজার ডলার। এই টাকা সংগ্রহে ডা. সিদ্দিকুর মাসব্যাপী চষে বেড়ান ঢাকা, লন্ডন আর যুক্তরাষ্ট্রের নানা শহর।

কথিত আছে, এটি তার সারা বছরের আয় রোজগারের ক্ষেত্র। তবে এই টাকার ভাগ নাকি পান নিউইয়র্ক থেকে ঢাকায় দলের বড় নেতা বনে যাওয়া একজন রাজনীতিক। তিনি আবার এই সিদ্দিকুর প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর রাগ ভাঙানোর জন্য কাজ করছেন বলে জানা গেছে।
তাতে স্থানীয় নেতাকর্মী যারা দলের সক্রিয় কাজে থাকেন সব সময়, অথচ সভাপতি এক নায়কতান্ত্রিক কর্মে দলে অচ্ছুত বলেই পরিগণিত হন, তারা আবার হতাশায় পড়েছেন। কেউ কেউ বলছেন, নামে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ হলেও এটি আসলে এখন ‘ওয়ানম্যান শো’তে পরিণত হয়েছে, আমরা হতাশ।

যেহেতু ডা. সিদ্দিকুর তার কোটি টাকার সংবর্ধনা মঞ্চের খরচের উৎস এবং খাত নিয়ে কোনো তথ্য দেন না দলের কাছে বা কারও কাছে। তাই এখন এটি একটি মুখরোচক আলোচনা যে, যত মানুষ আসলে দেখা যায় মঞ্চে বা মঞ্চের আশেপাশে, তারা একটি ছবির জন্যেই খরচ করেন ৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার ডলার।

এর বাইরে, আরও একটি উৎস আছে। দেশের শিল্পপতি বা অন্যান্য মন্ত্রী-এমপি যারা নিউইয়র্কে এসে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একই হোটেলে অবস্থান করেন, দেখাতে চান যে তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর যোগাযোগ আছে, তাদের জন্য অনেক আগে থেকেই আলাদা রুম বুকিং করে রাখেন সিদ্দিকুর রহমান। তারাও এই অর্থ যোগানের একটি বড় উৎস।

যেহেতু এই নিয়ে কোনো তথ্য নেই এবং এসব অভিযোগ নিয়ে ডা. সিদ্দিকুরের জবাব ‘সব ডাহা মিথ্যা কথা’। সেহেতু প্রধানমন্ত্রীর এই সংবর্ধনা নিয়ে মঞ্চে এত মানুষের উপস্থিতির গল্পের ডাল-পালা বিস্তার করেই যাচ্ছে নিউইয়র্কে।