যা আছে ইসি মাহবুব তালুকদারের ‘নোট অব ডিসেন্টে’

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সুযোগ রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সংশোধনী চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন। ৩০০টি আসনের মধ্যে প্রায় ১০০টিতে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। তবে শুরু থেকেই এতে আপত্তি জানিয়ে আসছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।

বৃহস্পতিবার কমিশন সভা চলাকালে ইভিএমের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে বৈঠক বর্জন করেন এই নির্বাচন কমিশনার। তিনি এ ব্যাপারে একটি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ও দিয়েছেন। সেখানে তিনি ছয়টি পয়েন্টে তার আপত্তি তুলে ধরেছেন।

(১) বিগত ২৬ আগস্ট আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২) সংশোধনকল্পে নির্বাচন কমিশনে তিন ধরনের প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। আরপিওটিকে বাংলা ভাষায় রূপান্তর ও পরিমার্জন করে প্রথম প্রস্তাবটি পেশ করা হয়, যা কমিশনের নিয়োজিত একজন পরামর্শক তৈরি করে দেন। দ্বিতীয় অপশনটি হলো, পূর্বের ইংরেজি আরপিওতে সুনির্দিষ্ট কিছু সংশোধন, সংযোজন বা পরিমার্জন। সর্বশেষ প্রস্তাবটি হলো, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সময়স্বল্পতাহেতু ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধন আরপিওতে সন্নিবেশ করা। নির্বাচন কমিশনের ২৬ আগস্টের সভায় অন্য দুটি প্রস্তাব বাদ দিয়ে কেবল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকে। উল্লেখ্য যে, ইভিএম ও আরপিও সম্পর্কে আরও বিচার বিশ্লেষণ ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিমিত্ত কমিশনের সভা ৩০ আগস্ট পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।

(২) স্থানীয় নির্বাচনগুলিতে ইতোমধ্যে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে রাজনৈতিক দল ও ভোটারদের কাছ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রথম থেকেই বলে এসেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো সম্মত হলেই কেবল আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। সরকারি দলের পক্ষ থেকে ইভিএম ব্যবহারকে স্বাগত জানানো হলেও প্রধান বিরোধী দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল এর বিরোধিতা করে আসছে। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দলগতভাবে সংলাপকালে ইভিএম সম্পর্কে সরকারি দল ও প্রধান বিরোধী দলের অবস্থান ছিল পরস্পর বিরোধী। এমতাবস্থায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে ইভিএম ব্যবহারের কোনো সম্ভাবনা নেই। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অধিকতর আলোচনা ও সমঝোতার প্রয়োজন ছিল।

(৩) বর্তমান নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ইভিএম ব্যবহারের প্রারম্ভে বলা হয়েছিল পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে। ঐ পরীক্ষামূলক ব্যবহারের জন্য ২৫৩৫টি ইভিএম ক্রয়ের নিমিত্ত ৫০ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দের ব্যাপারে আমি গত ৮ এপ্রিল তারিখে ভিন্নমত প্রকাশ করেছিলাম। সম্প্রতি ইভিএম এর জন্য যে প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে তাতে ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৮২১ কোটি টাকা। রাজনৈতিক দলের বিরোধিতার মুখে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার যেখানে অনিশ্চিত, সেখানে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে ইভিএম ক্রয় করা কতটা যৌক্তিক, তা বিবেচনাযোগ্য। এতে সরকারি অর্থের অপচয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। বিগত রকিবউদ্দীন কমিশন ইভিএম ব্যবহার বাতিল করে অনেক ইভিএম ধ্বংস করে দেয়। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি কখনোই কাম্য নয়। যে ইভিএম বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি থেকে সরকারি সংস্থার সুবাধে বিনা টেন্ডারে ক্রয় করা হচ্ছে, এর অরিজিন কী? কে উদ্ভাবন করেছে কিংবা কোত্থেকে আমদানি করা হচ্ছে সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। কারিগরি দিক থেকে এটি সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত কিনা তা আরো পরীক্ষা করার প্রয়োজন ছিল। প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণ করার পর অদ্যাবধি প্রকল্পের সম্ভাবতা যাচাই করা হয়নি বলে জানা যায়।

(৪) একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য অতি অল্প সময়ের মধ্যে আরপিও সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আরপিওতে শুধু ইভিএম ব্যবহারের জন্য যে সংশোধনী আনা হয়েছে, তা ইতিমধ্যে কমিশন সভায় নানা প্রকার প্রশ্নের সম্মুখীন। আমি ধারণা করি, সর্বসম্মত রাজনৈতিক মতের বিরুদ্ধে ইভিএম ব্যবহার করা হলে তা নিয়ে আদালতে অনেক মামলার সূত্রপাত হবে। অন্যান্য কারণ ব্যতিরেকে কেবল ইভিএম ব্যবহারের কারণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের পক্ষে এই অনাবশ্যক ঝুঁকি নেওয়া সঙ্গত হবে না।

(৫) যন্ত্রের অগ্রগতির যুগে আমি ব্যক্তিগতভাবে ইভিএম ব্যবহারের বিরোধী নই। এ ক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ঘাটতি দৃষ্টিগোচর। প্রথমত, ইভিএম ব্যবহারের জন্য নির্বাচন কমিশন যাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে তাদের প্রশিক্ষণ অপর্যাপ্ত এবং জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান সম্পর্কে আমি সন্ধিহান। দ্বিতীয়, অনেক ভোটার অজ্ঞতাপ্রসূতকারণে ইভিএম ব্যবহার সম্পর্কে অনীহা প্রকাশ করেছে। তারা ইভিএমের বিষয়ে যে সন্দেহ প্রকাশ করছেন তা নিরসনের জন্য ব্যাপক প্রচার ও ভোটারদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল। বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম নিয়ে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটেছে, যা ছিল নিতান্তই অনভিপ্রেত। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কেন্দ্র দখল করে ইভিএম-এ একটি দলের পক্ষে ভোট প্রদানের অভিযোগও রয়েছে। তবে আমি মনে করি, স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে ধীরে ধীরে ইভিএমের ব্যবহার বাড়ানো হলে ভোটাররা তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বেন। এই অভ্যস্ততার জন্য যে সময়ের প্রয়োজন তা একাদশ জাতীয় সংসদের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। তবে স্থানীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার সাফল্য লাভ করলে ৫-৭ বছর পরে জাতীয় নির্বাচনেও ইভিএম ব্যবহার অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে।

(৬) উল্লেখিত অভিমতের আলোকে আমি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য আরপিও সংশোধনের উদ্যোগ সমর্থন করি না। এমতাবস্তায় উক্ত নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্তে ভিন্নমত পোষণ করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ প্রদান করছি।’