যুক্তরাষ্ট্র–তুরস্ক সম্পর্কে টানাপোড়েনের পেছনে কারণ কী?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কে প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরে টক-ঝাল-মিষ্টি অবস্থা বিরাজ করছে। উভয় দেশই উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোট বা ন্যাটোর সদস্য এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের দিক দিয়ে কৌশলগত অংশীদার।

সামরিক, অর্থনৈতিক, ও ভূরাজনৈতিক বিষয়গুলোতে একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আছে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে। কিন্তু প্রায় গত ৫-৬ বছর আগে এই মধুর সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করে। এখন তা প্রায় বিভেদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। দিন যতই যাচ্ছে সম্পর্ক ততই তেতো হচ্ছে।

সিরিয়া যুদ্ধ ও কুর্দি সমস্যা

ইরাক যুদ্ধের সময় আমেরিকা-তুরস্ক সম্পর্ক এক ক্রান্তিকালে পৌঁছে। পরে সিরিয়া যুদ্ধের শুরুর দিকে তুরস্ক ও আমেরিকা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার পরিকল্পনা করে। কিন্তু যতই দিন যেতে থাকে উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোট বা ন্যাটোর সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক ক্ষমতা সম্পন্ন এই দুই সদস্য দেশের মধ্যে মেরুকরণ স্পষ্ট হয়।

আমেরিকা সিরিয়াতে তুরস্ককে পাশ কাটিয়ে কুর্দি সশস্ত্র বাহিনীকে একচেটিয়া সমর্থন দেয়। একই কুর্দি বাহিনী তুরস্কের পূর্ব অঞ্চলে স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েমের লক্ষে প্রায় তিন দশক ধরে সশস্ত্র বিদ্রোহ করে আসছে।

পিকেকে নামের এই গোষ্ঠীটিকে তুরস্ক, আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করলেও সেই একই সংগঠনের সিরিয়ার শাখাটিকে আমেরিকা আইএসআইএসসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নাম করে অনেক ভারি অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করে। সেই অস্ত্রে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ পিকেকে সন্ত্রাসীরা তুর্কিতে তাদের সদস্যদের কাছে পাচার করে।

২০১৫ ও ২০১৬ সালে তুর্কি সেনাদের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে। আঙ্কারার শক্তিশালী প্রতিবাদ সত্ত্বেও ওয়াশিংট সিরিয়াতে পিকেকেকে দেয়া সমর্থন একটুও কমায়নি বরং বহুগুণে বাড়িয়েছে।

এখন পিকেকের সিরিয়া শাখাটি তুরস্কের সীমান্ত ধরে সিরিয়ার প্রায় পুরো অংশটিই দখল করে রেখেছে। আমেরিকা তুরস্ককে বারবার অঙ্গীকার করা সত্ত্বেও এই বাহিনী থেকে তাদের সমর্থন উঠিয়ে নেয়নি।

এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা

সিরিয়া যুদ্ধের মাঝামাঝি দিকে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে সমর্থনদানকারী, পিকেকের সিরিয়া শাখা এবং আইএসআইএস যখন সিরিয় ভূখণ্ড থেকে তুরস্কের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে অনেক ক্ষয়ক্ষতি করে তখন তুরস্ক নিজের আকাশসীমা নিরাপদ রাখতে ন্যাটোর কাছ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাঠানোর অনুরোধ করে।

নাটোর কয়েকটি দেশ থেকে তখন তুরস্কে প্যাট্রোয়েট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাঠানো হয়। কিন্তু বছর যেতে না যেতেই ন্যাটো দেশগুলো এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উঠিয়ে নেয়।

তুরস্কের আকাশসীমা হয়ে যায় প্রতিরক্ষাহীন। তুরস্ক তখন আমেরিকার কাছ থেকে প্যাট্রোয়েট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার প্রস্তাব দেয়। আমেরিকা বিষয়টিকে প্রায় কয়েক বছর ঝুলিয়ে রেখে তারপর তুরস্কের কাছে এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিক্রি করবে না বলে সাফ সাফ জানিয়ে দেয়। তুরস্ক অনেক ধর্ণা ধরে ব্যার্থ হয়ে সে আরেক পরাশক্তি রাশিয়ার দ্বারস্থ হয়।

রাশিয়া ন্যাটো সদস্য দেশের কাছে তার সর্বাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০ বিক্রি করার প্রস্তাব দেয়। তুরস্কও এর বিপরীতে সিরিয়ার তুরস্ক সীমান্তবর্তী এলাকাতে সামরিক অভিযান চালানোর প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবটি রাশিয়ার কাছে দেয় কারণ রাশিয়া তখন সিরিয়াতে সবচেয়ে বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

প্রতিদান হিসাবে তুরস্ক সিরিয়াতে ২০১৬ সালের শেষ দিকে একটি এবং ২০১৮ সালারে শুরুতে আরেকটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। এতে তুরস্ক ব্যাপক সাফল্য পায়। আইএসআইএস এবং পিকেকে সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে সিরিয়ার এক বিশাল অংশ মুক্ত করে।

ইতিমধ্যে, তুরস্ক রাশিয়ার এই অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কেনার সব বন্দোবস্ত করে ফেলে। আগামী জুলাই মাসে এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা তুরস্কের কাছে হস্তান্তর করবে রাশিয়া। কিন্তু এক্ষেত্রে বেঁকে বসেছে আমেরিকা।

সাফ জানিয়ে দিয়েছে ন্যাটো সদস্য দেশ হয়ে তুরস্ক রাশিয়ার এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি কিনতে পারবে না। যদি কিনে তাহলে তুরস্ক আমেরিকাকে এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমান কেনার জন্য যে টাকা এবং পরিশ্রম দিয়েছে তা ভেস্তে যাবে।

এই যুদ্ধ বিমান তুরস্ককে এই বছরের শেষের দিকে হস্তান্তর করার কথা। আমেরিকা এখন বলছে তুরস্ক যদি রাশিয়ার চুক্তি থেকে সরে না আসে তাহলে বিমান তো পাবেই না বরং দেশটির বিরুদ্ধে ইরানের মতো অর্থনৈতিক অবরোধে নিয়ে আসতে পারে।

তুরস্কের সামরিক অভ্যুত্থান

২০১৬ সালে তুরস্কে ঘটে যায় এ যাবৎকালের সবচেয়ে বীভৎস এবং রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা। তুরস্কের সরকার এবং আপামর জনগণ রাস্তায় নেমে সামরিক জান্তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।

সারা বিশ্বের কাছে প্রতিষ্ঠা করে গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত। জনগণের ভোট যে সরকার ক্ষমতায় আসে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যখন সামরিক জান্তা ট্যাংক, যুদ্ধবিমান আর গোলাবারুদ নিয়ে আক্রমণে নাম তখন সেই জনগণই ট্যাংকের সামনে শুয়ে পড়ে, বন্দুকের গুলির সামনে বুক পেতে দিয়ে রক্ষা করে নিজেদের ভোটার অধিকার, বাঁচিয়ে রাখে গণতন্ত্র।

এমন বীরোচিত, সাহসী পদক্ষেপে তুর্কীরা বাহবার দাবিদার হলেও আমেরিকা শুরু থেকেই সামরিক অভ্যুত্থানের পক্ষে অবস্থান নেয়। সামরিক জান্তা ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে যেই তুরস্কের সরকার কোনো পদক্ষেপ নিতে যায় আমেরিকা তখন মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে তাদের পক্ষে সাফাই গায়।

আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক জান্তাদের পক্ষ নেয়। সামরিক অভ্যুত্থানের মূল হোতাদের আমেরিকা নিরাপদ আশ্রয় দেয়। বিষয়টি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কাঁদাছোড়াছুড়ি চলছেই।

এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তুরস্কের সঙ্গে অনেকগুলো দেশের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অনেক প্রতিযোগিতা চলছে। এই প্রতিযোগিতায় আছে সৌদিআরব, ইরান, মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীন।

কয়েক দশক ধরে পশ্চিমা মেরুতে থাকা তুরস্ক এখন রাশিয়া এবং চীনের সঙ্গে একত্রে পূর্ব মেরুতে এসে এই এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে চায়। অন্যদিকে সৌদি আরব আমেরিকার সঙ্গে আঁতাত করে মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো মুসলিম বিশ্বের মোড়ল হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। এখন এই পূর্ব-পশ্চিমের খেলায় তুরস্ক রাশিয়া-চীন ব্লকে থাকবে নাকি আমেরিকা-ইউরোপ ব্লকে থাকবে।

কোন ব্লক তুরস্ককে কী ধরণের সহযোগিতা করবে দেখতে হলে অপেক্ষা করতে হবে আরো কিছুদিন।

লেখক : সারওয়ার আলম, চিফ রিপোর্টার, আনাদলু নিউজ, তুরস্ক