ঘুম থেকে উঠে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন স্বামী : কে তুমি?
অ্যাডাম এবং র্যাকেল গনজালেস সংসার করছেন পাঁচ বছর ধরে, কিন্তু হঠাৎ এক সকালে জেগে উঠে অ্যাডাম কিছুতেই তার স্ত্রীকে চিনতে পারলেন না, মনে করতে পারলেন না যে সে কে? বিবাহিত জীবনের সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছিলেন অ্যাডাম।
কিন্তু স্ত্রী র্যাকেল খুব দৃঢ়ভাবে চেয়েছিলেন যে তিনি সেই স্মৃতি ফিরিয়ে আনবেনই।
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর, খুব ভোরবেলায় র্যাকেল গনজালেস তাদের বসার ঘরে এসে দেখতে পেলেন তার স্বামী চোখে বিভ্রান্ত এক দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। আর এমন ভঙ্গীতে কথা বললেন যেন তিনি এক অপরিচিত নারী। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যে র্যাকেল আসলে কে, সে সম্পর্কে তার কোন ধারণাই নেই।
র্যাকেল বলছিলেন, আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কোথায় আছো তা কি তুমি জানো? বলতো এটা কত সাল? তুমি কি আমার নাম বলতে পারবে? আর এসব প্রশ্নের উত্তরে অ্যাডাম বললেন, না!
এরপর র্যাকেল অ্যাডামকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন যে, এটা তাদেরই বাসা, র্যাকেলই তার স্ত্রী এবং তাদের তিনটি সন্তান আছে। শুনে অ্যাডাম কাঁদতে শুরু করলেন।
এরপর অ্যাডাম বলেছিলেন, আমার আইডি খুঁজে পেতে হবে, আমার ফোন আর আইডি কোথায়?
র্যাকেল অ্যাডামকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্যে পোশাক পরে তৈরি হতে বললেন। তার তখন মনে হয়েছিল যে মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলে বাধার ফলেই হয়তো অ্যাডামের মারাত্মক কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে। যখন অ্যাডাম তার আলমারি খুললেন তখন জানতে চাইলেন যে তার স্যুট-টি কোথায়। র্যাকেল তখন বললেন যে, তার আসলে কোনও স্যুট নেই।
এরপর খুব ধীরে ধীরে তৈরি হয়ে অ্যাডাম র্যাকেলকে অনুসরণ করলেন, কেননা তিনি হাসপাতালের রাস্তাও ভুলে গিয়েছিলেন।
র্যাকেল অ্যাডামের প্রতি খুবই কোমল ব্যবহার করছিলেন, কেননা তিনি জানতেন যে এর আগে এক নারী অ্যাডামকে হত্যার চেষ্টা করার পরই সে তার স্মৃতি হারিয়ে ফেলেছিলেন।
পুরনো ঘটনা
২০১১ সালের ঘটনা, অ্যাডামের বয়স তখন ৩৫। টেক্সাসে থাকতেন তিনি আর চাকরি করতেন এটিএন্ডটি নামের বড় একটি টেলিকম কোম্পানিতে, আর সেইসাথে লুববক-এর গির্জাতেও ছিলেন খুব সক্রিয়।
প্রথম স্ত্রীর সাথে ছাড়াছাড়ি হবার পরপরই তার সাথে নতুন একজন নারীর সাথে সম্পর্ক তৈরি হয়। কিন্তু সেই সম্পর্কের ইতি ঘটে এক মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে। তার নতুন বান্ধবী তাকে মাথার পেছনে ধাতব কোনও দণ্ড দিয়ে আঘাত করে গ্যারেজের ছাদে ঝুলিয়ে রেখে চলে যায়, যেন এভাবেই তার মৃত্যু ঘটে।
মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে নেয়ার পথে অন্তত তিনবার তার হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাবার মতো অবস্থা হয়েছিল। প্রতিবারই প্যারামেডিকরা সেই অবস্থা থেকে তাকে ফিরিয়ে আনে। চার মাস কোমায় থাকার পর পুরোপুরি জ্ঞান ফেরে তার।
যখন আমার জ্ঞান ফিরলো, আমি কিছুতেই মনে করতে পারলাম না যে আসলে আমি কে, আমি মনে করতে পারছিলাম না যে আমার বিয়ে হয়েছিল, বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছিল এবং আমার দুটি সন্তান আছে,- বলছিলেন অ্যাডাম।
তিনি পুরো একবছর হাসপাতালে ছিলেন, সেখানে আবার তিনি শিখলেন কিভাবে হাঁটতে হয়, কিভাবে কথা বলতে হয়। কিন্তু তার পূর্ব জীবনের স্মৃতি আর ফেরেনি।
মাসখানেক পর যখন তার ছেলে আর মেয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় হয়, অ্যাডাম মনে মনে একটা চ্যালেঞ্জ অনুভব করেছিলেন। কিভাবে একজন বাবা তার নিজের জৈবিক সন্তানকে ভুলে যেতে পারে?
বাড়িতে যখন তিনি ফিরলেন, পুরো বাড়িতে সাজিয়ে রাখা প্রচুর ছবি, পুরষ্কার দেখে কিছুই তিনি চিনতে পারেননি।
আমি বোঝার চেষ্টা করেছি যে এই অ্যাডাম লোকটা কেমন ছিল। আমি কি এই ব্যক্তির পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবো? অ্যাডাম তার পুরনো পেশায় আর ফিরে যেতে পারেননি। ভয় করতেন যে হয়তো আগের মতো করে আর জীবনধারণ করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। এমনকি নিজের বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কেও তার কোনও স্মৃতি ছিল না।
এরপর তিনি সেই শহর ছেড়ে নতুন করে জীবন শুরুর সিদ্ধান্ত নেন। অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের শহর ফিনিক্স-এ চলে আসেন অ্যাডাম গনজালেস আর একজন কেবল টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ শুরু করেন।
নতুন জীবনের শুরু
২০১২ সালে ৩০-বছর বয়সী এক মার্কেটিং ম্যানেজারের সাথে অ্যাডামের অন-লাইন ডেটিং এর মাধ্যমে পরিচয় হয়, আর তিনিই হলেন র্যাকেল। তার তখন নিজেরও একটি মেয়ে ছিল।
একদিন তারা এক রেস্টুরেন্টে দেখা করতে চাইলেন। র্যাকেল সেখানে অন্তত সেখানে ৩০ মিনিট অপেক্ষায় ছিলেন। পরে জানা যায় যে, অ্যাডাম তাকে ভুল রেস্টুরেন্টে আসতে বলেছিলেন।
অ্যাডাম এতটাই লজ্জিত ছিল এবং ক্ষমাপ্রার্থী ছিল যে আমার মনে হলো, ঠিক আছে প্রত্যেকেই ভুল করে থাকে, বলছিলেন র্যাকেল। অ্যাডামের কথায় টেক্সান টানও তার পছন্দ হয়েছিল।
অবশেষে যখন দু’জনের দেখা হলো তখন অ্যাডাম পরেছিলেন লেদার জ্যাকেট আর জিনস। আর তাতেই র্যাকেলের কাছে তাকে দুর্দান্ত সুপুরুষ বলে মনে হয়েছিল। আর অ্যাডাম নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলেন র্যাকেলের টোল পড়া সুন্দর হাসির দিকে। এরপর থেকেই তাদের ঘন ঘন দেখা হতে শুরু হয়।
তারা ২০১৫ সালের জুলাইয়ে বিয়ে করেন আর দু’পক্ষের ছেলেমেয়েসহ একসঙ্গে থাকতে শুরু করেন। কিন্তু ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরের এক সকালে দু’জনের একসাথে চলার চার বছরের সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলেন অ্যাডাম।
হাসপাতালে যখন অ্যাডামের চিকিৎসা চলছিল, তখন সে জানায় যে একজনকেই কেবল সে বিশ্বাস করতে পারে। আর তিনি হলেন তার মা। এরপর অ্যাডামের মা এসে তাকে আশ্বস্ত করে যে, র্যাকেলই তার স্ত্রী।
‘তো তখন থেকেই কিছুটা বিশ্বাস এলো তার প্রতি আর এরপর থেকেই তাকে নানা ধরনের প্রশ্ন করতে শুরু করলাম’, বলছিলেন অ্যাডাম। এই সুন্দরী আর রহস্যময়ী নারীকে নতুন করে জানার এক উত্তেজনা কাজ করতে শুরু করলো তখন।
এরপর থেকে তারা নানা বিষয়ে আলোচনা শুরু করে। তাদের আলাপ চলতো সারাদিন কখনো সারারাত। সেল ফোন থেকে পুরনো ছবি দেখিয়ে র্যাকেল মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতো নানা বিষয়। অ্যাডাম এমনকি র্যাকেলের কাছে তাদের ম্যারেজ সার্টিফিকেট পর্যন্ত দেখতে চেয়েছে।
তবে এরসবই সবসময় খুব ইতিবাচক ছিল না। একবার অ্যাডামের মনে হয় যে, তাদের আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো। তবে দুঃখ পেলেও হাল ছাড়েননি র্যাকেল।
এরপর বাসায় ফিরে এলে র্যাকেল তাকে শেখাতে শুরু করে রান্না করা। র্যাকেলের সংসার, সন্তান পালন সবকিছুই মুগ্ধ করতে শুরু করে অ্যাডামকে। সন্তানরাও তাদের জীবনের আকস্মিক পরিবর্তনকে নিজেদের মতো করে মোকাবিলা করতে শুরু করেছিল। দ্বিতীয়বারের মতো যখন অ্যাডামের স্মৃতিভ্রংশ হয় তখন অ্যাবির বয়স ১২, লুলুর ছিল ১৫ আর এলিজার ১৭ বছর।
তারা খুব বিস্ময়ের সাথে তাদের বাবা’র বিভিন্ন কর্মকাণ্ড লক্ষ্য করতো। একে অন্যকে তারা জড়িয়ে ধরে থাকতো সেসময়। মেয়েটি তার বাবা’র স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে মনে করিয়ে দিতে চাইতো যে সে কিভাবে জিমনেশিয়ামে তাদের ব্যায়াম করা শিখিয়েছে।
আবার ফিরে আসা
অ্যাডামের অ্যামনেশিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার তিন মাস পর ২০১৬-এর ডিসেম্বরের সকালে জেগে উঠে আবারো তার পরিচিত ভঙ্গীতে ডেকে ওঠেন তার স্ত্রীকে। যেন তিনি ফিরে গেছেন তার বিয়ের আগের সময়ে।
এরপর সবকিছু শোনার পর অ্যাডাম বলেন, কি করে আমি তোমাকে ভুলে ছিলাম র্যাকেল? অ্যাডাম অনেক স্মৃতিই পুনরুদ্ধার করতে পেরেছেন, তবে আগের তিনটি বছর তার হারিয়েই রইলো। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথাও তার স্মরণে আসেনা যেমন র্যাকেলের সাথে বিয়ের ঘটনাটি। ভুলে গেছেন পরিবারের সাথে ডিজনিল্যান্ড যাওয়ার ঘটনাও।
র্যাকেল খুব সতর্কতার সাথে পরিবারের নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উপকরণ সাজিয়ে রাখেন, যাতে করে অ্যাডামের স্মৃতি ফিরে পেতে সুবিধা হয়। ডাক্তাররা এমআরআই, ক্যাটস্ক্যান, ইকোকার্ডিওগ্রামের মতো নানা ধরনের পরীক্ষা করে দেখেছেন অ্যাডামকে। তবে দ্বিতীয়বারের স্মৃতি হারাবার কারণ বুঝতে পারেননি।
এখন গনজালেস দম্পতি তাদের ভবিষ্যতের জন্যে কাজ করে যাচ্ছেন। অ্যাডাম আবার তার কর্মজীবনে ফিরেছেন আর হয়েছেন গির্জার যাজক। র্যাকেলের মনে হয় যে তাদের বিবাহিত জীবনে এক অন্য ধরনের বিপর্যয় ঘটে গিয়েছিল, কিন্তু সেটি তাদের সম্পর্ককে করেছে আরও মধুর। বিবিসি বাংলা
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন