খাগড়াছড়িতে হাজার কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনে সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী মামলার ফাঁদে
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার হাজার কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনে সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র-মল্লিকা মামলার ফাঁদে পড়তে যাচ্ছে। হাজার হাজার কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অবশেষে দুদকের মামলার ফাঁদে পড়তে যাচ্ছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও তার স্ত্রী স্কুল শিক্ষিকা মল্লিকা ত্রিপুরা।
গত ২১শে নভেম্বর করা সম্পদের (স্থাবর-অস্থাবর) যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত চেয়ে চিঠি ইস্যু করেছে দুদকের অনুসন্ধান টিম। তবে পলাতক কুজেন্দ্র ও মল্লিকা চিঠির জবাব না দেওয়ায় দুদক তাদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুুতি নিচ্ছে। দুদকের একটি দায়িত্বশীল এমন তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছে।
দুদকের তথ্য মতে, ২০২৪সালে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জমা দেওয়া হলফনামায়, ১০বছরে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার আয় বেড়েছে প্রায় ১৩গুণ। মাত্র ১০বছরের ব্যবধানে বেড়েছে শত শত একর জমি, বেড়েছে ব্যবসা। সেই সঙ্গে এফডিআরের পরিমাণ, স্বর্ণালংকার, গাড়ি ও বাড়ির সংখ্যা বেড়েছে তার।
২০১৪ ও ২০১৮সালের হলফনামায় কেবল খাগড়াছড়ি সদর ও দীঘিনালায় সম্পত্তি থাকার কথা উল্লেখ থাকলেও ২০২৩সালে জমা দেওয়া হলফনামায় রাঙ্গামাটি ও ঢাকায় সম্পত্তি থাকার হিসাব দেখানো হয়। সে সাথে তার স্ত্রী স্কুল শিক্ষিকা মল্লিকা ত্রিপুরার নামে অবৈধ উপায়ে শত শত কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের প্রমাণ মিলেছে। কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
ইতিমধ্যে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার বিরুদ্ধে খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামে হত্যাসহ অন্তত: এক ডজন মামলা দায়ের হয়েছে। পুলিশ এখনো তাকে গ্রেফতার করতে না পারলে খাগড়াছড়িতে একটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের নেতার আশ্রয়ে তিনিসহ কয়েকজন আওয়ামীলীগ রয়েছেন বলে জানা গোছে।
দুদকের সূত্র জানায়, অনুসন্ধানের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী এবং খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা তথা সংসদীয় আসন ২৯৮-এর সাবেক সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও তার স্ত্রী স্কুল শিক্ষিকা মল্লিকা ত্রিপুরার নামে অবৈধ উপায়ে শত শত কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের প্রমাণ মিলেছে।
অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পাওয়ায় ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন(দুদক) থেকে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও তার স্ত্রী মল্লিকা ত্রিপুরাকে সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার জন্য পৃথক নোটিশ দেওয়া হয়েছে। গত ২১শে নভেম্বর ইস্যুকরা সম্পদের(স্থাবর-অস্থাবর) যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত চেয়ে চিঠি দিয়েছে দুদকের অনুসন্ধান টিম। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে তাদের কাছ থেকে কোন জবাব মেলেনি।
নাম প্রকাশ না শর্তে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রতিবেদককে জানান, সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকার বেশি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সে কারণে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও তার স্ত্রীর সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ জারি করা হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা জানান, অভিযোগ অনুসন্ধানে ভূমি অফিস, সাব-রেজিস্ট্রার, গণপূর্ত, রাজউক, সিটি কর্পোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ দেড় শতাধিক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। সম্পদের বিবরণ পাওয়া গেলে যাচাই-বাছাই করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুদকের সূত্রের দাবী অনুসন্ধানে এখন পর্যন্ত রাঙ্গামাটির সাজেক ভ্যালিতে খাসরাং নামে দুটি রিসোর্ট, খাগড়াছড়ি আলুটিলায় খাসরাং রেস্টুরেন্ট, ঢাকার পূর্বাচলে প্লট, উত্তরায় বিশাল দুইটি ফ্ল্যাট, খাগড়াছড়ি সদরের খাগড়াপুরে নিজের নামে, খবংপুড়িয়ায় বান্ধবী রূপনা চাকমার নামে বাড়ী ও দীঘিনালায় তিনটি বাড়ি ও ল্যান্ডক্রুজার গাড়িসহ বিলাসবহুল একাধিক গাড়ির তথ্য পাওয়া গেছে। অন্যদিকে, নামে-বেনামে বিভিন্ন হিসাবে শত কোটি টাকা থাকার তথ্য-প্রমাণও পাওয়া গেছে।
দুদকের অনুসন্ধান টিম বলছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খাগড়াছড়ি আসনে টানা তৃতীয়বারের মতো আওয়ামীলীগের মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচিত হন জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী বিষয়ক টাস্কফোর্সের তৎকালীন চেয়ারম্যান(প্রতিমন্ত্রী মর্যাদা) কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা।
পার্বত্য বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার সাবেক সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা নিজ এলাকায় গড ফাদার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি, সরকারি জমি দখল, টেন্ডারবাজি, অর্থের বিনিময়ে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য, নারী কেলেঙ্কারি ও দলের পদ ও কমিটি নিয়ে অনৈতিক বাণিজ্য করার অভিযোগ রয়েছে।
২০১৪সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার হলফনামায় ইটভাটা, কৃষি ও মৎস্য খামার, কাঠ ব্যবসাসহ মৌসুমি ব্যবসার খাত থেকে বাৎসরিক আয় দেখানো হয় ৩০লাখ ৫৭হাজার ৩৭৫টাকা। ২০১৮সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৫লাখ ১৪হাজার টাকায়। ২০২৩সালে এসে তার আয় দাঁড়ায় চার কোটি ১৬লাখ ৬৫হাজার ৬৮০টাকা। তার আয়ের সবচেয়ে বড় খাত হিসেবে দেখানো হয় রাঙ্গামাটির সাজেকে রিসোর্ট ব্যবসা। এখান থেকে তার বছরে আয় হয় এক কোটি ৩৬লাখ ৩১হাজার ২৪৭টাকা।
কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা দ্বিতীয় আয়ের খাত হিসেবে ইট, বালুসহ বিভিন্ন উপকরণ সরবরাহের কথা বলা হয়। এ খাত থেকে তার আয় হয় এক কোটি ৩১লাখ ৭৬হাজার ৫৫৪টাকা। ইটভাটা থেকে আয় ২৫লাখ টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন এফডিআর, সঞ্চয়ী জামানত ও অংশীদারি বিনিয়োগ থেকে আয় দেখানো হয়।
কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার নিজের পাশাপাশি স্ত্রীর নামেও রয়েছে কোটি টাকার সম্পদ। ২০১৪ ও ২০১৮সালের নির্বাচনের হলফনামায় সম্পদ, আয় ও আর্থিক বিবরণী একই রকম দেখানো হলেও ২০২৩সালে এসে তা বেড়ে যায়। ২০২৩সালের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৮থেকে ২০২৩সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের ব্যবধানে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার প্রায় আট কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ বেড়েছে।
এর মধ্যে রাঙ্গামাটির সাজেক ভ্যালির কংলাকে ৪দশমিক ৮একর ভূমির ওপর খাসরাং রিসোর্টে বিনিয়োগ দেখানো হয় চার কোটি ৪২লাখ এক হাজার টাকা। খাগড়াছড়ি সদরের আলুটিলায় খাসরাং রেস্টুরেন্টে বিনিয়োগ দেখানো হয় দুই কোটি ২২লাখ ৬৫হাজার টাকা।
দুদক অনুসন্ধান বলছে, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার খাগড়াছড়ি সদরের খাগড়াপুর, খবংপুড়িয়া ও দীঘিনালায় বাড়ি রয়েছে তিনটি। হলফনামায় যার মূল্য দেখানো হয়েছে তিন কোটি ১৭লাখ ৭১হাজার ৩৬৬টাকা। বাস্তবে কিন্তু তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা রয়েছে শুল্কমুক্ত ল্যান্ডক্রুজার ও জিপসহ বিলাসবহুল কয়েকটি গাড়ি।
এ ছাড়া এমপি পুত্রের নামে ৩৬লাখ টাকার একটি বিলাসবহুল প্রাইভেট কার, পরিবহন খাতে ব্যবসার উদ্দেশ্যে পিকআপ-১, পিকআপ-২-সহ ভাড়ায় চালিত অসংখ্য গাড়িও রয়েছে বলে জানা গেছে।
কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ঢাকার পূর্বাচলে ভূমি কেনাবাবদ বিনিয়োগ দেখিয়েছেন সাত লাখ ৫০হাজার টাকা, ঢাকার উত্তরায় এক হাজার ৭৮৩বর্গফুটের ফ্ল্যাট, নথিপত্রে যার ক্রয়মূল্য দেখিয়েছেন মাত্র ৪২ লাখ টাকা। বাস্তব যার মূল্য কয়েকগুণ বেশি। অন্যদিকে, অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে এক কোটি ১৫ লাখ ৫ (পাঁচ) হাজার ১৫৬টাকার এফডিআর, ১৪লাখ ১৭হাজার ৮৪১ টাকার ডিপিএস, সংসদ সদস্য ও টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান পদ থেকে বাৎসরিক আয় ২৪লাখ ৮৭হাজার টাকা দেখিয়েছেন তিনি।
এ ছাড়া ‘মল্লিকা অ্যাগ্রো প্রজেক্ট’র নামে বনায়ন, কৃষি, মৎস্য ও গবাদি পশু পরিপালনে ১০৭একর জমির তথ্যও উল্লেখ করেছেন হলফনামায়।
অভিযোগ রয়েছে, খাগড়াছড়ি সদর উপজেলাধীন আলুটিলা পর্যটন এলাকায় ১০একর (১০০০ শতাংশ) সরকারি খাসজমি দখল করেন কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা। খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার রাস্তার দুই পাশে কয়েক হাজার একর জমিতে সেগুন ও আমবাগান, দীঘিনালা উপজেলাধীন বোয়ালখালী এলাকায় স্ত্রী ও নিজের নামে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে “কুজেন্দ্র-মল্লিকা মডার্ন কলেজ’। এ জন্য ২০কোটি টাকার ব্যক্তিগত ট্রাস্টি গঠন।
একটি সূত্র জলছে, নির্বাচনী হলফনামায় ব্যবসা খাতে ‘ব্রিক ফিল্ড’ থেকে তার বাৎসরিক আয় ২৫লাখ টাকা দেখানো হয়েছে, সেখানেও রয়েছে ঘাপলা। কারণ, খাগড়াছড়ি জেলায় বৈধ কোনো ইটভাটা নেই। জেলায় প্রায় ৪০টি ইটভাটার মধ্যে একটিরও কোনো লাইসেন্স বা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই।
এছাড়া খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নের মধ্য বোয়ালখালী এলাকার কেবিএম ব্রিকস ও ফোরবিএম ব্রিকস নামে দুটি ইটভাটার সঙ্গে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে কেবিএম ব্রিকসের সরাসরি ব্যবসায়িক অংশীদার এবং ফোরবিএম ব্রিকসের প্রায় অর্ধেক অংশের ভূমির মালিক তিনি।
দুদকের সূত্র জানায়, সম্পদের হিসাব চাওয়া দুদকের পৃথক নোটিশে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও তার স্ত্রী মল্লিকা ত্রিপুরার নামে থাকা স্থাবর-অস্থাবর যাবতীয় সম্পদের বিবরণ ২১কর্মদিবসের মধ্যে জমা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলেও কোন জবাব পাওয়া যায়নি। ফলে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪এর ৫(২) ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুুতি নিচ্ছে।
দুদকের সূত্র জানায়, অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত ৪ঠা সেপ্টেম্বর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদক থেকে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাকে তলব করা হলেও তিনি হাজির হননি। এর আগে ২৯শে আগস্ট দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার সিনিয়র স্পেশাল জজ থেকে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাকে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন