নির্বাচনী সহিংসতা : অভিযোগ পেলেই ‘শুধু আশ্বাস’ ইসির

একাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে হামলা–সংঘাতের ঘটনায় নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। বিভিন্ন ঘটনায় ‘বিব্রত’ ‘দুঃখ প্রকাশ’ আর তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন এই প্রতিষ্ঠানটি।

এদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের গাড়ি বহরে হামলার ঘটনায় গতকাল রোববার রাজধানীর দারুস সালাম থানায় মামলা করেছেন ঢাকা-১৪ আসনে বিএনপির প্রার্থী সৈয়দ আবু বকর সিদ্দিক। মামলায় আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের ১৪ নেতা–কর্মীকে আসামি করা হয়েছে।

সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও ১০ ডিসেম্বর প্রচার শুরু হওয়ার পর থেকে ক্রমে হামলা–সংঘাতের ঘটনা বাড়ছে। এখন পর্যন্ত শতাধিক জায়গায় প্রচারে হামলা-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হামলার শিকার হচ্ছেন ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী–সমর্থকেরা।

গতকাল ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক কামাল হোসেন সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছেন, ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী ও সমর্থকদের ওপর হামলার ঘটনায় কোনো তদন্ত ও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, হামলার ঘটনা চলতে থাকলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। তাই এখনই এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আর এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে ইসিকেই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই আছে। শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি।

এবার নির্বাচনী সংঘাতে এখন পর্যন্ত দুজনের প্রাণহানি হয়েছে। দুজনেই আওয়ামী লীগের। অন্যদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আফরোজা আব্বাস, মাহবুব উদ্দীনসহ আরও কয়েকজন এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী আবু সাইয়িদের প্রচারে হামলা হয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ফেরার পথে হামলার মুখে পড়ে ড. কামাল হোসেনের গাড়িবহরও। প্রায় প্রতিদিনই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপি তাদের প্রার্থীদের প্রচারে হামলা-বাধা ও গ্রেপ্তারের বিষয়ে ইসিতে লিখিতভাবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করছে। গণতান্ত্রিক বাম জোটও ঢাকা ১২,১৩, ১৪, পটুয়াখালী-৪, কুষ্টিয়া-৩, সাতক্ষীরা-১ আসনে প্রচারে বিভিন্নভাবে বাধার দেওয়া হচ্ছে বলে ইসিতে অভিযোগ দিয়েছে।

ইসি বলছে, নির্বাচন–পূর্ব অনিয়ম ঠেকাতে সংসদীয় আসনভিত্তিক যুগ্ম জেলা জজ ও সহকারী জজের সমন্বয়ে গঠিত নির্বাচনী তদন্ত কমিটি (ইলেক্টোরাল ইনকোয়ারি কমিটি) এবং নির্বাহী হাকিমেরা কাজ করছেন। ঘটনা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইসি এ আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

নির্বাচন আচরণবিধি অনুযায়ী, প্রতিপক্ষের সভা, শোভাযাত্রা ও প্রচারাভিযানে বাধা দেওয়া যাবে না। আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ৬ মাসের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডের বিধান আছে।

কেউ নির্বাচন কমিশনে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করলে বা কোনো তথ্যের ভিত্তিতে বা অন্য কোনোভাবে ইসি নির্বাচন–পূর্ব অনিয়মের অভিযোগ পেলে তা নির্বাচনী তদন্ত কমিটিতে পাঠাতে পারে অথবা তাৎক্ষণিকভাবে রিটার্নিং কর্মকর্তা বা প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিতে পারে। কিন্তু ইসি শুধু নজর দিচ্ছে নির্বাচনী তদন্ত কমিটির দিকে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না।

নির্বাচন-পূর্ব অনিয়ম প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী যুগ্ম জেলা জজ ও সহকারী জজের সমন্বয়ে গত ২৫ নভেম্বর ১২২টি নির্বাচনী তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সংসদীয় আসনভিত্তিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এসব কমিটিকে। কমিটি কারও অভিযোগের ভিত্তিতে বা নিজ উদ্যোগে নির্বাচনী অনিয়ম বা ঘটনা তদন্ত করতে পারবে। নির্বাচন শেষ হওয়ার আগেই তদন্ত শেষ করতে হবে। তদন্ত শেষ করার তিন দিনের মধ্যে তারা সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন নির্বাচন কমিশনে দেবে। কমিশন সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।

ইসি সচিব হেলালুদ্দীন সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছেন, কয়েকটি নির্বাচনী তদন্ত কমিটি অভিযোগ যাচাই করে সত্যতা পায়নি। তবে কোন কোন এলাকার ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নি, তা সচিব স্পষ্ট করেননি।

হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইসি কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী গতকাল বিবিসি বাংলাকে বলেন, এসব ঘটনাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখছে নির্বাচন কমিশন। কারণ, সহিংসতা কোনোভাবেই কাম্য নয়। পুলিশকে এ নিয়ে কড়া নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, দু-এক জায়গায় কিছু বদলিও করা হয়েছে।

গত শনিবার সিইসিও নির্বাচনী তদন্ত কমিটির কথা বলেছিলেন। তবে তিনি স্বীকার করেছিলেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পেতে একটু সময় লেগে যায়। এ ধরনের ঘটনা প্রতিহত করতে তাঁরা পুলিশকে চিঠি দেবেন।

কামাল হোসেনের গাড়ি বহরে হামলায় মামলা

কামাল হোসেনের গাড়ি বহরে হামলার ঘটনায় গতকাল মামলা হয়েছে। দারুস সালাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. যোবায়ের মামলাটির তদন্ত করছেন। জানতে চাইলে পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মাসুদ আহাম্মদ বলেন, পুলিশ কাজ শুরু করেছে। আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।

মামলার বাদী ঢাকা–১৪ আসনে বিএনপির প্রার্থী সৈয়দ আবু বকর সিদ্দিক। এজাহারে তিনি লিখেছেন, ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বের হওয়ার সময় কামাল হোসেন ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের ওপর আকস্মিক হামলা হয়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার নির্দেশে রাম দা, ছুরি, চাকু, লোহার রড, হকিস্টিক ও লাঠিসোঁটাসহ শাহ আলী থানা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক মো. রনি, শাহ আলী থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মফিজুল ইসলাম শুভ, দারুস সালাম থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক মো. ইসলাম, মো. বাদল, মো. জুয়েল, শেখ ফারুক (টোকাই ফারুক), ১২ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মো সোহেল, দারুস সালাম থানা ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ রাজন, সদস্য নাবিল খান, শাহ আলী থানা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জাকির ও সাধারণ সম্পাদক সৈকত ও সদস্য শাওন এ হামলা চালান।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, নির্বাচনের আগে এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করার দায়িত্ব ইসির। নির্বাচনের সময় পুলিশও নির্বাচন কমিশনের অধীনে। কিন্তু সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনায় ইসি গুরুত্ব দিচ্ছে না বলেই মনে হচ্ছে। এভাবে চললে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সুযোগ থাকবে না, কোথাও কোথাও নির্বাচন ভণ্ডুল হয়ে যেতে পারে।খবর প্রথম আলো’র সৌজন্যে প্রকাশিত।