‘জীবনহানির আশঙ্কা না থাকলে জামিন দেওয়া যায় না’

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন প্রশ্নে শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, ‘অসুস্থতাজনিত কারণে যদি জীবনহানির আশঙ্কা না থাকে এবং মেডিকেল বোর্ডের যথাযথ মতামত না থাকে তাহলে শুধু অসুস্থতার যুক্তিতে জামিন দেওয়া যায় না।’

এর জবাবে খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘হাইকোর্ট ইতিপূর্বে অনেক সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে জামিন দিয়েছেন কিন্তু সরকার বা দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) কেউই এর বিরুদ্ধে আপিল করেনি। শুধু এই (খালেদা জিয়ার মামলায়) একটি মামলাতেই পরীক্ষামূলকভাবে রাষ্ট্র-দুদক এক সঙ্গে হয়ে আপিলে এসেছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে।’

আজ মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে শুনানির সময় এসব কথা বলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এবং আইনজীবী জয়নুল আবেদীন। শুনানি শেষে আগামীকাল আদেশের জন্য দিন ধার্য করেন আদালত।

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যার্টনি জেনারেল মাহবুবে আলম মঙ্গলবারের শুনানিতে দুদকের করা মামলায় সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, ব্যারিস্টার মীর নাছিরের ছেলে ব্যারিস্টার মীর হেলাল ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহম্মদ নাসিমের মামলার উদাহরণ তুলে ধরেন।

এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘নাজমুল হুদা এক বছর আটমাস কারাভোগ করার পর গুরুতর অসুস্থ বিবেচনায় তাঁর জামিন হয়। একইভাবে মোহাম্মদ নাসিমকে দণ্ড দেওয়ার পর তাঁর এক পা ও হাত প্যারালাইসিস হয়ে যায়। মেডিক্যাল বোর্ডের সুপারিশের ভিত্তিতে তাঁকে জামিন দেওয়া হয়। একইভাবে সংক্ষিপ্ত সাজায় মীর হেলাল ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে গুরুতর অসুস্থ বিবেচনায় জামিন দেওয়া হয়। তাঁদের প্রত্যেকে অনেকদিন সাজা খেটেছেন।

শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘অসুস্থতাজনিত কারণে যদি জীবনহানির আশঙ্কা না থাকে এবং মেডিকেল বোর্ডের যথাযথ মতামত না থাকে তাহলে শুধু অসুস্থতার যুক্তিতে জামিন দেওয়া যায় না।’

এ সময় আদালত প্রশ্ন রাখেন, ‘এসব মামলা কি জরুরি অবস্থার সময় হয়েছে? তখনকার প্রেক্ষাপট কী ছিল?’

জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল দুদকের কিছু মামলায় আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বলেন, ‘৯০ কর্মদিবসে যদি আপিল শুনানি শেষ না হয়,আসামি যদি গুরুতর অসুস্থ হয় বা মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে এবং সাজা যদি তিন বছরের ঊর্ধ্বে না হয় তাহলে অসুস্থতাজনিত কারণে আসামি জামিন পেতে পারেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার মামলায় আসামি জামিন পাওয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের একটি যুক্তিও নেই।’

মাহবুবে আলম আরো বলেন, ‘ওই সব মামলার অভিযোগ আর এ মামলার অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এসব মামলায় আসামিদের জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে মেডিকেল বোর্ডের যথাযথ মূল্যায়ন বা মতামত ছিল। কিন্তু এ মামলায় জামিন প্রশ্নে মেডিকেল বোর্ডের কোনো মূল্যায়ন নেই। যা দেওয়া বা দেখানো হয়েছে তা হলো খবরের কাগজে প্রকাশিত মন্তব্য।’ তিনি আরো বলেন, ‘ওই সব মামলায় রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাতের কোনো ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু এই মামলায় প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে এতিমদের টাকা তছরুপ করা হয়েছে। কিন্তু হাইকোর্ট জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে এ অভিযোগ বিবেচনায় নেয়নি। যা ফৌজদারি আইনের লঙ্ঘন।’ দুপুর ১২টা ৫৫মিনিটে তিনি শুনানি শেষ করেন।

এরপর খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘মাইলর্ড আমরা কোনো প্রতিউত্তর করব না। শুধু রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, কেননা ইতিপূর্বে যেসব মামলার শুধু উদাহরণ টেনেছি কিন্তু আজ অ্যাটর্নি জেনারেল বিস্তৃতভাবে পড়তে উপস্থাপন করেছেন। যা আমাদের পক্ষে গেছে। জরুরি অবস্থার সময়ের বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করে অসুস্থতার যুক্তিতে হাইকোর্ট ওই সব মামলায় আসামিদের জামিন দিয়েছিলেন এবং আপিল বিভাগ তাতে কোনো হস্তক্ষেপ করেননি।

জয়নুল আবেদীন আব্দুল ওয়াহাব ও ইসমত আরার মামলার উদাহরণ টেনে বলেন, ‘যথাক্রমে এ দুই মামলায় আট বছর ও সাত বছরের সাজা দেওয়া হয়েছিল আসামিদের। হাইকোর্ট তাঁদের জামিন দিয়েছিলেন কিন্তু সরকার বা দুদক কেউই এর বিরুদ্ধে আপিল করেনি। শুধু এই একটি মামলাতেই পরীক্ষামূলকভাবে রাষ্ট্র-দুদক এক সঙ্গে হয়ে আপিলে এসেছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে।’

এর আগে সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে হাইকোর্টের জামিন আদেশ স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আপিল আবেদনের ওপর শুনানি শুরু হয়। অ্যাটর্নি জেনারেল একদিন সময় আবেদন করলে আদালত তা দুপুর ১২টা পর্যন্ত মঞ্জুর করেন। দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে আবার শুনানি শুরু হয়।

সকালে সময় আবেদন করে অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতকে বলেন,‘আমার ফারদার কিছু সাবমিশন করতে হবে।’ এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন,‘না, না।’ অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘মাই লর্ড, আমার কিছু কথা বাকি আছে।’ প্রধান বিচারপতি বলেন,‘আপনি তো শুনানি করেছেন। কী বলতে চান? আর্গুমেন্ট থাকলে এখনই বলেন।’ অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘একদিনের জন্য কী হবে আর? প্রয়োজনে কালকে রায়ের জন্য থাকুক।’

প্রধান বিচারপতি এ সময় অন্য বিচারপতিদের সঙ্গে পরামর্শ করে অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে বলেন,‘আগামীকাল আবার এক ব্রাদার (সহকর্মী) আসতে পারবেন না। ঠিক আছে,আপনি সাড়ে ১১টায় আসেন।’ এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল ফের দুপুর ১২টার সময় দেওয়ার আবেদন জানালে আদালত অনুমতি দেন।

গত ৯ মে খালেদা জিয়ার জামিন শুনানি শেষে রায় ঘোষণার জন্য মঙ্গলবার দিন ধার্য করেন আপিল বিভাগ। আদালতে খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী,সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি জয়নুল আবেদীন ও আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। এ ছাড়া ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদসহ জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা খালেদা জিয়ার পক্ষে উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষে আইনজীবী খুরশিদ আলম খান শুনানি করেন।

গত ১৯ মার্চ খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন ৮ মে পর্যন্ত স্থগিত করেন আপিল বিভাগ। দুই সপ্তাহের মধ্যে সরকার, দুদক ও আসামিপক্ষকে আপিলের সারসংক্ষেপ দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। খালেদা জিয়ার জামিনের বিরুদ্ধে দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষের লিভ টু আপিল গ্রহণ করে এ আদেশ দেওয়া হয়। ১৫ মার্চ খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন স্থগিত চেয়ে লিভ টু আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুর্নীতি দমন কমিশন। ১৪ মার্চ খালেদা জিয়ার হাইকোর্টের দেওয়া চার মাসের জামিন স্থগিত করে লিভ টু আপিল দায়েরের জন্য দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষকে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে চার মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেন হাইকোর্ট। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ খালেদা জিয়ার জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেন।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় কারাগারে থাকা বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের শুনানি শেষ হয়। গত ২২ ফেব্রুয়ারি একই বেঞ্চ খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। এ ছাড়া এই মামলায় নিম্ন আদালতের দেওয়া অর্থদণ্ড স্থগিত করা হয়। পাশাপাশি নিম্ন আদালতের নথি ১৫ দিনের মধ্যে পাঠাতে ঢাকা বিশেষ জজ আদালত-৫-এর বিচারককে নির্দেশ দেওয়া হয়।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন নিম্ন আদালত। এ মামলার অপর আসামি খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ বাকি পাঁচজনকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তাঁদের দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা জরিমানাও করা হয়।