বঙ্গবন্ধুপ্রেমী এ এক অন্য মান্নানের গল্প!

জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে বৃদ্ধ বয়সে আজও রোজা রাখেন স্থানীয় মসজিদে দোয়ার আয়োজন করেন। জাতীয় শোক দিবসে করেন কোরবানি। আপ্যায়ন করেন দলীয় নেতাকর্মীদের। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার বুধল ইউনিয়নের বঙ্গবন্ধু ও তার জ্যেষ্ঠ কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একনিষ্ঠ ভক্ত মো. আব্দুল মান্নান।

জাতির পিতার প্রতি ভালোবাসার প্রতিদান হিসেবে আবেগ থেকে নিজ বাড়ির একাংশে তৈরি করেছেন বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর। মৃত্যুর আগে তার শেষ ইচ্ছা বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং তার তৈরি করা স্মৃতি জাদুঘরটি সরকারের কাছে হস্তান্তর করা।

আব্দুল মান্নানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কুমিল্লা সিলেট মহাসড়কের পাশেই আব্দুল মান্নানের বাড়ি। কয়েকটি টিন শেডের জরাজীর্ণ ঘর। প্রতিটি ঘরের কাঁচাভিটা। বাড়ির এক অংশে একটি ছোট ঘর। এই ঘরের সামনে লেখা বঙ্গবন্ধু জাদুঘর।

ঘরের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ছবি। বিভিন্ন সময় ঘটে যাওয়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আহত হওয়ার ছবি। আছে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা’সহ বিভিন্ন বই। এলাকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ছাড়াও বিভিন্ন লোকজন প্রায়শই এই জাদুঘরটি দেখতে আসেন। জাদুঘরের সামনে বসে আড্ডা জমায়। প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস, ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসে আলোচনা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেন আব্দুল মান্নান।

আব্দুল মান্নান জানান, ১৯৫২ সালে সদর উপজেলার নন্দনপুর গ্রামে তার জন্ম। এরপর চলে যান নানা বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার অষ্টগ্রাম গ্রামে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মান্নান ছিলেন টকবগে যুবক। অষ্টগ্রাম এলাকায় জীবন বাজি রেখে কাজ করেছেন মুক্তিযোদ্ধার সহযোগী হিসেবে। তবে মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট কী? এর গুরুত্ব আছে কিনা? এনিয়ে কখনো ভাবেননি আব্দুল মান্নান। এখনও এ নিয়ে তার কোনো ভাবনা বা আক্ষেপ নেই।

মান্নান জানান, পৈত্রিকভাবে অনেকটা সম্পদশালী ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে অগাধ শ্রদ্ধা করেন ও ভালোবাসেন। বঙ্গবন্ধুর নামে রোজা রাখতেন, কোরবানি দিতেন। এ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগকে মনেপ্রাণে ভালোবাসেন। সেই ১৯৬৮ থেকে তিনি আওয়ামী লীগের একজন নিবেদিতকর্মী হিসেবে দলের জন্য কাজ করছেন। দলের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে অনেকে তাকে পাগল বলে আখ্যায়িত করতেন। এক পর্যায়ে গত ২০০০ সালে তার বসতঘরটি পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা।

মান্নান দাবি করেন, আওয়ামী লীগ করায় অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা তার বসতঘরটি পুড়িয়ে দিয়েছিল। ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ বিএনপি ক্ষমতা থাকার সময় প্রায়ই বিএনপি নেতাদের দ্বারা কটুবাক্য শুনে মানসিকভাবে নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হতেন।

মান্নান আক্ষেপ করে বলেন, গত ২০০৩ সালে বিএনপি জামায়াত ক্ষমতায় থাকাকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার অষ্টগ্রামে তার জমিজমা ও বাড়ি ছিল। ওই সময়ে এলাকার প্রভাবশালী এবং তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের অনুসারী আশরাফ আলী ভেন্ডারী নামে এক ব্যক্তি তাকে নিঃস্ব করেছেন। তার সরলতাকে কাজে লাগিয়ে ওই ব্যক্তি নানাভাবে চাপ প্রয়োগ ও ভয়ভীতি দেখিয়ে তার ১২০ শতাংশ জায়গা এবং স্থানীয় মার্কেটের ১৮টি দোকান ঘর ওই ব্যক্তি নিজ নামে লেখিয়ে নেন।

শুধু তাই নয়, ১৪ লাখ টাকা তার কাছে পাওয়ার কথা বলে তার নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে মান্নানকে ৮ মাস জেল খাটান। এরপর থেকে তিনি অনেকটা নিঃস্ব এবং মানসিকভাবে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে অনেকটা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন।

মান্নান জানান, তার দুঃসময়ে ওই এলাকার বঙ্গবন্ধুপ্রেমী কেউ তার সহায়তায় এগিয়ে আসেননি বা আসার সাহসও পাননি। মনের দুঃখ নিয়ে অষ্টগ্রাম ত্যাগ করে আবারও পাশের বুধল ইউনিয়নের উত্তর নন্দনপুরে এসে মহাসড়কের এক পাশে একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন। বর্তমানে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের পাশে একটি জরাজীর্ণ বাড়িতে অবস্থান করছেন আব্দুল মান্নান। মোট সাত শতাংশের বাড়িতে জরাজীর্ণ দুটি টিন শেডের ঘর আছে। বছর তিনেক আগে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে প্রশাসনের সহায়তায় একটি ঘর পেয়েছেন আব্দুল মান্নান। সেই ঘরটিতে নিজে বা পরিবারকে নিয়ে না থেকে তিনি সেটিকে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর বানিয়েছেন। জাদুঘরটি ইতোমধ্যে গ্রামে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে।

জাদুঘরটিতে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামাচা’সহ বেশকিছু বই রয়েছে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে নির্যাতনের ঘটনার অনেক পেপার কাটিংসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি রয়েছে। এর আগে ১৯৭০ সাল থেকে সংগৃহীত বঙ্গবন্ধুর ছবি সম্বলিত নানা ঘটনার ইতিহাস, ছবি, পেপার কাটিং সহ দালিলিক বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত ছিল। কিন্তু ২০০০ সালের অগ্নিকাণ্ডে তার বসত ঘরটি পুরিয়ে দেয়ায় অনেক দুর্লভ পেপার কাটিং এবং ছবি সহ নানা স্মৃতি চিহ্ন পুড়ে ভস্মীভূত হয় বলে জানান আব্দুল মান্নান।

সেই অগ্নিকাণ্ডের ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা তুলে ধরে আক্ষেপ করে মান্নান বলেন, ওই সময়ের বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর স্মৃতি চিহ্নগুলো থাকলে তার স্মৃতি জাদুঘরটি আরও সমৃদ্ধ হত।

আব্দুল মান্নানের মেঝ ছেলে মোসলেম মিয়ার বয়স এখন ৩০। মোসলেম বলেন, ছোট থেকে আব্বাকে দেখেছি আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর জন্য ওনার প্রাণ নিবেদিত। দলের মিটিংয়ে যেতেন। মিছিলে এখনো তিনি নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন।

মোসলেম জানান, বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগকে ভালোবাসার কারণে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন তার পরিবার।

তিনি বলেন, আমরা তখন বয়সে ছোট। তবে যখন বুঝতে শিখেছি মায়ের কাছে জানতে পেরেছি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আমাদের বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল বিএনপির সময়ে। প্রভাবশালীদের কারণে তার বাবা ৮ মাস জেল পর্যন্ত খাটেন বলে জানান মুসলিম।

এদিকে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, আমি ছোট বেলা থেকে ছাত্র রাজনীতি করেছি। এখন যুব রাজনীতি করছি। আমি ১৯৯২ সাল থেকে মান্নান ভাইকে চিনি। তিনি দলের জন্য অনেক কাজ করেছেন। তখন তিনি এলাকায় বসবাস করতেন না। তবে তিনি আওয়ামী লীগের সব মিটিংয়ে থাকতেন। যেখানে আওয়ামী লীগ, সেখানে তিনি থাকতেন।

জাকির বলেন, একবার আমরা কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে আমাদের দলীয় মেয়র প্রার্থী সীমার পক্ষে কাজ করতে নন্দনপুর থেকে কুমিল্লা যাব। মান্নান ভাই জানতে পেরে জোর করে আমাদের গাড়িতে উঠে চেপে বসেন। আমাদেরকে বলেন তিনিও যাবেন। আমরা বললাম আপনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। তিনি বায়না ধরলেন তাকে নিতেই হবে। শেষ পর্যন্ত তাকে নিয়ে যেতে হলো। এই হলেন আব্দুল মান্নান।

তিনি আরও বলেন, এখন তার জীবনের শেষ ইচ্ছা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করার। আমরাই চাই তার ইচ্ছাপূরণ করা হোক। তাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দাবি জানাই তার ইচ্ছাপূরণ করার জন্য আমাদের দলের ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দসহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্তৃপক্ষ যেন একটা সুযোগ করে দেন।

মান্নান সম্পর্কে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম ভূঁইয়া জানান, বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় থেকে আওয়ামী লীগের হয়ে কাজ করে আসছেন তিনি। আওয়ামী লীগের জন্য নিজের প্রাণ বাজি রাখতেও দ্বিধাবোধ করবেন না তিনি। যখন আর্থিকভাবে সক্ষম ছিলেন তখন বঙ্গবন্ধুর নামে কোরবানি দিতেন। বঙ্গবন্ধুর নামে রোজা রাখছেন। তার গুণ বলে শেষ করা যাবে না।

এক সময়ের মুদি ব্যবসায়ী আব্দুল মান্নান ও রওশনারা বেগম দম্পতি তিন ছেলে ও দুই মেয়ে সন্তানের জনক।