‘রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞে দোষীদের শাস্তি পেতেই হবে’

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের মূল উদঘাটনে মিয়ানমারকে অবশ্যই সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। এ তদন্ত মিয়ানমার সরকার কিংবা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মাধ্যমে হতে পারে বলেও মত দিয়েছেন তারা।

মঙ্গলবার বিকালে রাখাইনে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা এলাকা পরিদর্শন শেষে জাতিসংঘে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত ক্যারেন পিয়ার্স নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দলের হয়ে সাংবাদিকদের একথা বলেন।

কারেন পিয়ার্স বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ওপর পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের বিষয়ে মিয়ানমারকে অবশ্যই সুষ্ঠু তদন্ত করতে হবে। রাখাইনের ঘটনায় দায়ীদের শাস্তি দিতে অবশ্যই সুষ্ঠু তদন্ত প্রয়োজন। স্থানীয় হোক কিংবা আন্তর্জাতক, রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞে দোষীদের শাস্তি পেতেই হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার সহয়তায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কাজ দ্রুততর করতে মিয়ানমারকে উদ্যোগী হতে হবে। তাছাড়া রাখাইনে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যাতে বাধাহীন প্রবেশ করতে পারে সে ব্যাপারে মিয়ানমারকে সচেষ্ট হতে হবে।’

এ সময় রোহিঙ্গা সংকটের মূল উদঘাটন করতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানান নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধি দল। তাদের মতে, রোহিঙ্গা সংকটের তদন্ত মিয়ানমার কিংবা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মাধ্যমে হতে পারে।

মঙ্গলবার রাখাইন পরিদর্শনের আগে নেপিদোতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদল মিয়ানমারের নেত্রী ও কার্যত দেশটির সরকার প্রধান অং সান সু চি ও সেনা প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন। একথা বলেন মিয়ানমারের সেনাপ্রধান।

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু হওয়ার পর নিরাপত্তা পরিষদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের এটাই প্রথম বৈঠক।

এদিন মিয়ানমারের আইনপ্রণেতা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিরা।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের দলটি ২৮ এপ্রিল বিকাল চারটার দিকে কুয়েত থেকে সরাসরি একটি চার্টার বিমানে করে কক্সবাজার পৌঁছায়। ২৯ এপ্রিল সকালে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের তমব্রু শূন্যরেখায় আশ্রিত রোহিঙ্গাদের দেখতে যান তারা। একইদিন এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পও পরিদর্শন করে তারা। সোমবার (৩০ এপ্রিল) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে তারা মিয়ানমারের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন।

মিয়ানমার যাত্রার প্রাক্কালে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রতিনিধি দলটি সাংবাদিকদের জানান, রোহিঙ্গা সংকট মিয়ানমারের। দেশটিকেই এ সংকটের সমাধান করতে হবে। তবে খুব শিঘ্রই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বলেও জানান তারা।

এদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতিনিধিদলের একাগ্রতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ মিয়ানমারের মানবাধকার কর্মীরা। বার্মা হিউমান রাইটস নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা কিয়াও উইন কাতার ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরাকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে দোষীদের চিহ্নিত করা জরুরি। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা (নিরাপত্তা পরিষদ) সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে এটি প্রয়োগ করতে অনিচ্ছুক।’

এ মানবাধিকার কর্মীর মতে, ‘দোষীদের খুঁজে বের না করায় এটি তাদের কাছে ভুল বার্তা দিচ্ছে। তারা (সেনাবাহিনী) বুঝতে পারছে যে অন্যায় করেও পার পাওয়া যাবে।’

প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী দেশটির সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না মিয়ানমার সরকার। সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে চার দশক ধরে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা।

সর্বশেষ ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইন রাজ্যে একটি নিরাপত্তা চৌকিতে কথিত হামলার অভিযোগ তুলে সেনা অভিযানের নামে নৃশংসতা শুরু হলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এ সংখ্যা ১১ লাখ ছাড়িয়ে যায়। এদের আশ্রয় হয়েছে কক্সবাজারে উখিয়া উপজেলার বিভিন্ন ক্যাম্পে।

রোহিঙ্গাদের স্রোত শুরু হওয়ার পর বিষয়টি বাংলাদেশ তোলে জাতিসংঘে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও প্রথমে রোহিঙ্গা নির্যাতনের কথা স্বীকার না করলেও পরে ‘কিছু হত্যার’ বিষয়টি স্বীকার করেন দেশটির সেনা প্রধান।

এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দিতে মিয়ানমারের সঙ্গে প্রথমে সমঝোতা স্মারক এবং পরে ফিজিক্যাল অ্যারাঞ্জমেন্ট নামে চুক্তিও হয়েছে। প্রত্যাবাসনের প্রথম ধাপ হিসেবে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারকে আট হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গার তালিকাও দেয়া হয়। যদিও মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ যাচাই বাছাইয়ের নামে সেখান থেকে মাত্র তিনশ মতো রোহিঙ্গাকে তাদের নাগরিক বলে দাবি করে।

সম্প্রতি মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী প্রথমবারের মতো একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে রোহিঙ্গাদের দেখতে বাংলাদেশ সফর করেন। তারা কক্সবাজারের ক্যাম্পে গিয়ে রোহিঙ্গাদের দুর্দশাও দেখেন।

দেশে ফিরে গিয়ে ২১ এপ্রিল ‘রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে’ বলে মিথ্যাচার করেন তিনি। ইয়াঙ্গুনে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি জানান, ‘রোহিঙ্গাদের ফেরাতে তারা (মিয়ানমার) বাংলাদেশকে একটি যাচাই ফরম বিতরণ করতে বলেছিল। অথচ বাংলাদেশ সে কাজে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।’

মিয়ানমার রোহিঙ্গাদেরকে ফিরিয়ে না নিয়ে নানা তালবাহানা করছে- একথা জানিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই বাস্তবতায় রোহিঙ্গাদের জন্য মানসম্পন্ন আশ্রয় প্রকল্প নির্মাণে সরকারকে বিপুল অংকের টাকাও ব্যয় করতে হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়নের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের আলামত খুঁজে পেয়েছে বলে জানিয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন রোহিঙ্গা নিধনের ঘটনাকে জাতিগত নিধনযজ্ঞের ‘পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’ বলেও আখ্যা দিয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ রোহিঙ্গা নিপীড়নকে জাতিগত নিধন বলে অভিহিত করেছে। তবে বরাবরের মতো মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ সমস্ত অভিযোগই অস্বীকার করে আসছে।