হত্যার হুমকি

জীবন নিয়ে শংকিত এক ব্লগার, অনলাইন এক্টিভিস্ট ও মানবাধিকারকর্মী

আবারও প্রকাশ্যে ধর্মীয় মৌলবাদী জঙ্গিদের থেকে হত্যার হুমকি পেলেন এস এম সাইফুর রহমান নামের এক ব্লগার, অনলাইন এক্টিভিস্ট ও মানবাধিকারকর্মী। ধর্মীয় মৌলবাদ ও ধর্মের নামে সন্ত্রাসের বিপক্ষে তিনি দীর্ঘদিন ধরে অনলাইনে ও অফলাইনে স্বোচ্চার। তিনি তার ফেসবুক প্রোফাইল ও নিজের ব্যক্তিগত অনলাইন ব্লগে নিয়মিত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখে থাকেন। ফেসবুকে তার প্রায় ১১০০০ ফলোয়ার ও ৫০০০ বন্ধু আছে। মানুষকে মৌলিক মানবাধিকার, শিশু অধিকার, নারী অধিকার, সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে সচেতন করতে তিনি প্রবন্ধ লেখেন। দেশের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি নিয়েও তিনি সরব বলে আমাদের প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন। তার বক্তব্য অনুয়ায়ী ধর্মীয় সন্ত্রাসের বিপক্ষে, বিশেষ করে ইসলামী মৌলবাদের বিপক্ষে ও নারীদের পোশাকের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলার কারনে তিনি প্রতিনিয়ত ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে ও কমেন্টে প্রকাশ্য গালিগালাজ, হুমকি ধমকির শিকার হচ্ছেন। ইদানীং জঙ্গি গোষ্ঠীর কেউ কেউ তাকে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন।

গত ০৭ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে জনাব এস এম সাইফুর রহমান একটি প্রবন্ধ লেখেন ফেসবুকে। প্রবন্ধের মূল বিষয়বস্তু ছিলো ধর্ষণ, দুর্নীতি এসব দূর করার জন্য শৈশব থেকেই শিশুদের আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক, নৈতিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার প্রসার ঘটানো। বিভিন্ন সভ্য দেশ ও পরিসংখ্যানের উপাত্ত তুলে ধরে তিনি সেখানে দেখানোর চেষ্টা করেন ধর্মীয় শিক্ষা ও ধর্মীয় পোশাক নারীদের ধর্ষনের মতো বড় অপরাধের শিকার হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে না, বরং একটি বিজ্ঞানভিত্তিক, নৈতিক শিক্ষা ও আইনের শাসন পারে নারীদের নিরাপত্তা দিতে। আইনের শাসন যেখানে বলবৎ ও মানুষ নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত সেখানে নারীর পোশাক কোন ব্যাপার না, নারী তার ইচ্ছামতো পোশাক পরলেও ধর্ষনের ঝুঁকি কম থাকে। এই সমস্ত লেখাকে ইসলামের মূল আকীদার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বর্ননা করে মৌলবাদী জঙ্গিরা তাকে প্রকাশ্যে হত্যা করার ঘোষনা দেয়।

জনাব সাইফুর এই প্রতিবেদককে আরও জানালেন  মোহাম্মাদ ইসমাইল নামের এক ব্যক্তি তাকে এর আগেও পিটিয়ে মারা, প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা, যেখানে পাওয়া যাবে সেখানে হত্যা করার হুমকি দিয়েছেন। জনাব ইসমাইলের ফেসবুক প্রোফাইল সর্বসাধারন থেকে লকড করা ও প্রোফাইলে বাংলাদেশের অন্যতম ইসলামী বক্তা জনাব মামুনুল হকের ছবি সংযুক্ত। উল্লেখ্য যে, জনাব মামুনুল হকের বিরুদ্ধে উগ্র ধর্মীয় ঘৃনা ছড়ানো ও জঙ্গিবাদ প্রসারে বক্তব্য রাখার অভিযোগ রয়েছে।

লেখালেখির কারনে ধর্মীয় মৌলবাদী ও জঙ্গিদের রোষানলে পড়ে এর আগেও একাধিক ব্লগার, অনলাইন এক্টিভিস্ট নির্মমভাবে হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। মূলত ২০১৩ সালের গণজাগরন মঞ্চের আন্দোলনের পর থেকে এই ধারাবাহিক হত্যাকান্ডের হার বাড়তে থাকে। জঙ্গিরা সেসময় ৮৪ জন ব্লগার, এক্টিভিস্টের তালিকা করে তাদের হত্যার ঘোষনা দেয়। কিছু ব্লগার জীবন বাঁচাতে দেশ ছেড়ে অন্যদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাশ, ওয়াশিকুর বাবু, নাজিমুদ্দিন সামাদ, নীলয় নীল, রাজীব হায়দার, অধ্যাপক রেজাউল করীম সিদ্দিকী, শাহজাহান বাচ্চু, ফয়সাল আরেফিন দীপনসহ অনেকে রাস্তায় ও বাড়িতে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হন। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই আল কায়েদা ও আইএস এর মতাদর্শে চালিত জঙ্গিগোষ্ঠী আনসার-আল-ইসলাম ও নব্য জেএমবি এসব হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করে।

একের পর এক ব্লগার হত্যার পরও হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর প্রক্রিয়া ধীরগত‌‌‌িতে চলায়  নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন সাইফুর রহমানের মতো অন্য ব্লগার, মুক্তমত ও বাক-স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলা এক্টিভিস্টরা। অন্যদিকে তালিকা করে হত্যার হুমকি এবং ধারাবাহিকভাবে একাধিক জনকে হত্যা করা হলেও নিরাপত্তা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা না থাকায় উদ্বিগ্ন ব্লগারা। এ কারণেই অনেকেই প্রাণনাশের আশঙ্কায় আত্মগোপনে দিন কাটাচ্ছেন। কেউ-কেউ মনে করছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের  বিচার দাবিতে সোচ্চার হওয়া এবং এ নিয়ে লেখার কারণেই মানবতাবিরোধী সমর্থকগোষ্ঠীর এই হুমকি। আবার কারও মতে, ব্লগাররা  সেক্যুলার মতাদর্শে বিশ্বাস করে ধর্মীয় গোঁড়ামি, মৌলবাদের বিরুদ্ধে লেখার কারণে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটছে। এ পর্যন্ত ব্লগার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আটকরা বলেছেন ইসলামবিদ্বেষী লেখার কারণে ‘নাস্তিক’ ব্লগারদ‌‌ের হত্যা করা হয়েছে। বর্তমানে ব্লগার বলতেই নাস্তিক, ইসলামবিরোধী পরিচয় দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ঢালাওভাবে প্রচার  করা হচ্ছে, যারা ব্লগে লেখেন, তারা সবাই নাস্তিক। এতে সমাজের সকল ধর্মপ্রাণ মানুষের মনেও ব্লগারদের উপরে একটা বিদ্বেষমূলক মনোভাব তৈরি হচ্ছে এবং আশ্চর্যজনকভাবে জঙ্গি ও হত্যাকারীদের সমর্থন দেয়ার মানুষেরও অভাব নেই।

জনাব সাইফুরের অন্যান্য পরিচয় ও তার অবস্থান সঙ্গত কারনে উল্লেখ করা হচ্ছে না। তিনি জানালেন একাধিকবার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করলে প্রতিবারই পুলিশ কর্মকর্তারা পরামর্শ দেন সাবধানে চলাফেরা করতে ও সন্দেহজনক কিছু ধারনা করলে সঙ্গে সঙ্গে তাদের জানাতে। কিন্তু তিনি আস্থা না পেয়ে শংকার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন একপ্রকার বিচ্ছিন্ন হয়ে যা তার পেশা, উপার্জন ও ব্যক্তিগত জীবনকেও হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। দুই শিশুসন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ৪ জনের সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তিনি। তার অবর্তমানে তার পরিবারের সদস্যদের বিশেষ করে দুই শিশুসন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন। তিনি জানান, এক সময় গালিগালাজ, হুমকিগুলোকে পাত্তা দিতেন না, কিন্তু ধীরে-ধীরে পরিস্থিতি বদলেছে। একে-একে মুক্তমনা ব্লগার হত্যা, হুমকি ও ভিন্নমতাবলম্বীদের গুম ও নির্যাতনের মধ্যে তার জীবনের পরিসর ছোট হয়ে এসেছে। বাজারে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া, কোনটাই আর আগের মতো নেই। পরিবারের চাপে লেখালেখি থামিয়ে দিয়েছেন। কারণ নিরাপত্তা সংকটে পড়ে বারবার চোখের সামনে ভেসে আসে দুই শিশুসন্তানের ছবি। সাইফুর লেখালেখি করেন কিন্তু আগের মতো সরাসরি কথা বলেন না। বাসায় ফিরতে রাত করেন না এবং কখন কোথায় থাকছেন কাউকে না কাউকে বলে রাখেন। যেন যেকোনও পরিস্থিতিতে তাকে খোঁজা সহজ হয়। বাইরে কিছু লোক তাকে নিয়মিত অনুসরণ করে বলে সন্দেহ করায় তিনি কর্মস্থলে যান ভিন্নপথে।

ব্লগারদের একের পর এক হুমকি প্রসঙ্গে ব্লগার অমি রহমান পিয়াল বলেন, “দেশের সকল বিপণ্ন নাগরিককে রক্ষার দায়িত্ব পুলিশের, রাষ্ট্রের। সেই বিবেচনায় অবশ্যই বিপণ্ন ব্লগারদের  নিরাপত্তার ব্যবস্থা পুলিশকে নিতে হবে। এখন সেটা পুলিশ নিজে থেকে করে না, ব্লগারকে দায়িত্ব নিয়ে থানায় গিয়ে জিডি করতে হবে যে, সে বিপণ্ন। তার ওপর হুমকি আসছে। তারপর পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারে। কারণ সবকিছু একটা নিয়মের মধ্যে দিয়ে চলে। আমাকে আগে টেলিফোনে হুমকি দিত, মেইল করত, এখন সেটা করে না। ফেসবুকের ম্যাসেজ বক্সে আসে হুমকি। ভাষা ঘুরে ফিরে একই, আমার লাশও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এরপর আমার স্ত্রী ও কন্যাকে অপহরণের হুমকি তো নিয়মিতই পাই। এগুলো এখন সয়ে গেছে। দশ বছর ধরে একই হুমকি আর কতো। আইন আছে, কিন্তু কার্যকর করতে যে জ্ঞানগম্যি দরকার সেটা আনুষঙ্গিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নেই। এছাড়া পুলিশের সাইবার ক্রাইম স্কোয়াডও খুব একটা শক্তিশালী নয়। তারা রাজনৈতিক নেতাদের ছবি নিয়ে দুষ্টুমি দমনে যত তৎপর, বৌদ্ধদের কিংবা হিন্দুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার ডাক দমনে ততটা নয়।”