হাইওয়ে | মশিউর রহমান শান্ত

মানুষ হিসেবে আমি দারুন রকমের ব্যর্থ। সত্যি বলতে আমার অবস্থান একদমই ব্যর্থতার শীর্ষে। কারণ সফল হবার জন্য যে ধৈর্য ক্ষমতা দরকার তা আমার মধ্যে নেই। কখনো ছিলও না। হটাত করেই ইচ্ছে হল রিপোর্টার হব, টিভিতে নিউজ পড়ব। একটু চেষ্টা করতেই সেই ইচ্ছে পূরণ। যদিও সে একটু চেষ্টা নিয়ে একটি বই হয় তো লেখা হয়ে যাবে। কারণ যে পরিমাণ কাঠ খড় পুড়াতে হয়েছিল। সেই পরিমাণ কাঠ খড় সঠিক ভাবে পোড়ালে একটি টিভি চ্যানেল অনায়েসে পুড়িয়ে ফেলা সম্ভব বলে আমার ধারণা। দেখতে দেখতে টিভি অনুষ্ঠান এর পর্ব দাঁড়াল ১৭৬ এর বেশী। আর তখনই মনে হল টিভি প্রেজেন্টার কিংবা রিপোর্টার হিসেবে আমি ব্যর্থ কারণ আমাকে কেউই চিনে না। আমার আশে-পাশের মানুষ যখন রিপোর্ট করে এ্যাওয়ার্ড পেয়ে ব্যাংকের একাউন্ট ভরে ফেলছে। আমি তখন বিশ-ত্রিশ টাকা পকেটে নিয়ে বাসে ঝুলতে ঝুলতে অফিসে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে হাতে-গোনা দুই-একজন মানুষ বলে টিভিতে প্রোগ্রাম দেখেছিলাম। সেই দেখেছিলাম শোনার মধ্যেই আমার পাওনার সবটুকু সীমাবদ্ধ। দেখাটা ভালো হল নাকি মন্দ হল সেটাও বুঝতে পারিনা। ব্যর্থতার গল্প যেহেতু বলছিলাম একটু ঘটা করেই বলি। আমি কলেজের ছাত্র অবস্থাতেই সুযোগ পেয়ে গেলাম জাতীয় দৈনিকে লেখার। আমাকে আর তখন পায় কে ??? প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার এর অপেক্ষায় থাকি। যখনই লেখা প্রকাশ হয় তখনই আমার নানু থেকে বিশটাকা নিয়ে দুটো পত্রিকা কিনে ফেলি। পত্রিকার একটি ছোট দোকান, বাসা থেকে কিছুটা দূরে। ভোর হলেই সেই দোকানে চলে যাই। দুটো পত্রিকা কিনে হেলতে দুলতে বাসায় ফিরি। দেখতে দেখতে সেই সংখ্যাও দুশ হয়ে গেল। এবং তার কিছুদিন পর আমি বুঝতে পারলাম এত কষ্ট এক কথায় বলতে গেলে বৃথা। দুশ সংখ্যাটাই আমার জন্য সেই রকমের কুফা। এক পর্যায়ে দেখলাম ফিচার লেখক হিসেবে আমি আরও বেশী ব্যর্থ, কারণ আমাকে লেখক হিসেবে আমি ছাড়া আর কেউই চিনে না। এক বড় প্রকাশক তো রীতিমত বলেই ফেললেন, আপনি কি এমন লেখক যে আপনার বই প্রকাশ করব??? এই উত্তর শোনার পর আর লেখা-লেখি করারই মানে হয় না। যদিও দু-একজন মানুষ আমাকে লেখক হিসেবে চিনে। তবে সেই দু-একজন যারা চিনে তারা ডাল-ভাত শ্রেণীর লেখক বলে পাত্তা দেয় না। পাত্তা না দেওয়াই স্বাভাবিক। কবি-লেখক এর সংখ্যা যেখানে ঘরের মশার সংখ্যার থেকেও বেশী সেখানে লেখক হিসেবে কেউ আমাকে পোলাও কোরমা ভাববে এমনটা আমি অন্তত কখনো ভাবি না। যাই হোক কথা পেঁচিয়ে ফেলছি। আমি বরং মূল গল্পটা বলি। মূল গল্পের এর সাথে যেহেতু রেডিওর এর একটা সম্পর্ক আছে। তাই রেডিওতে ব্যর্থ হবার গল্পও একটু ছোট করে বলা দরকার। সারাজীবন শুনে এসেছি আরজেদের জন্য নাকি মেয়েরা পাগল হয়। সেই চিন্তা থেকেই হোক কিংবা অন্য চিন্তা থেকেই হোক ভাবলাম পত্রিকা টত্রিকা নয় আমি এখন রেডিওতে কাজ করব। আর যখন রেডিওতে কাজ শুরু হল তখন আমার ভূল ভাঙল। পাগল হওয়া তো দূরের কথা আমার অনুষ্ঠানই কেউ শোনেনা। বরং আমার ধারণা যারা নিয়মিত রেডিও শুনে তারাও বোধ হয় আমার অনুষ্ঠানের টাইমে পালায়। কিন্তু কোন এক অদ্ভুত কারণে একদিন ঘটল পুরো উল্টো ঘটনা। অফিসে ঢুকেই শুনি কেউ একজন আমার জন্য রিশিপশনে অপেক্ষা করছে। নাম নাকি আতাউর। আতাউর নামে কেউকে চিনি বলে মনে করতে পারছি না। আমার ফুপার নাম আতাউর ছিল। কিন্তু উনি মারা গেছেন প্রায় ৯ বছর হল। এই ৯ বছর পর উনি নিশ্চয়ই আমার সাথে দেখা করতে এবিসি রেডিওর অফিসে চলে আসবেন না। যাই হোক অত সাতপাঁচ না ভেবে রিশিপশনেই চলে গেলাম। এবং গিয়েই তো আমি অবাক। মাঝ বয়সী এক লোক এসেছেন আমার সাথে দেখা করতে। আমাকে দেখেই ভূত দেখার মত চমকে উঠলেন। হয় তো উনি আমার মত কুৎসিত কেউকে এর আগে কখনো দেখেননি। উনার চমকে যাওয়া দেখে আমিও কিছুটা ভড়কে গেলাম। উনাকে কি বলব, কিংবা উনি কেন আসলেন আর এমন চমকেই বা কেন গেলেন তার কোনটাই বুঝতে পারলাম না। তবে উনি নিজেই নিজের পরিচয় দিলেন। বাসা পুরনো ঢাকার নবাব কাটারাতে। আহামরি কিছু না। পেশা ড্রাইভার। আমার কাছে আসার কারণও আহামরি কিছু না। উনি উনার জীবনের একটা ঘটনা বলতে চান। এই এক নতুন বিপদ। রেডিওতে আমার কাজ শুরু করা হয়েছে কুয়াশা লেখার মধ্য দিয়ে। শ্রদ্ধেয় আরজে শারমিন আপু কিছু না বুঝেই উনার জনপ্রিয় প্রোগ্রাম কুয়াশার স্ক্রিপ্ট লেখার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন। যেহেতু মাসে চার পর্বের মধ্যে বেশীর ভাগ সময়েই দুই পর্ব আমার লিখতে হয়। তাই উনার কিছু শ্রোতা উনার বদৌলতেই আমাকে চিনে। না, ফেইসে না। শুধু মাত্র নামে। এই ড্রাইভারও এর ব্যতিক্রম না। ইদানীং একটা ব্যাপার খুব লক্ষ্য করছি। যার সাথেই দেখা হয় উনি উনার কাহিনী বলেন যেন আমি রেডিওতে সেই গল্পগুলো লিখতে পারি। যেহেতু কুয়াশা ভূতের গল্প নিয়ে তৈরি। তাই অন্য কিছুর অভাব হলেও ভূত দেখা মানুষের অভাব ইদানীং তেমন একটা হচ্ছে না। যাকেই দেখি সেই কোন না কোন গল্প নিয়ে হাজির হয়ে যায়। ড্রাইভার আতাউরও নিশ্চয়ই তেমনই একজন। কিন্তু অদ্ভুত কোন কারণে উনি আমার ধারণা ভূল প্রমান করলেন। কিছুক্ষণ আমার সাথে সৌজন্যমূলক কথা বলে কেটে পড়লেন। আমিও ব্যাপারটা নরমাল ভাবেই নিলাম। অনেকেই বানিয়ে বানিয়ে কথা বলতে ভালোবাসেন। শেষ পর্যায় এসে আর বানাতে পারেন না তাই নিজ থেকেই কেটে পড়েন। তবে উনি কেটে পড়লেও উনার একটা কার্ড আমাকে দিলেন আর আমার মোবাইল নাম্বার নিয়ে গেলেন। কারণ আমার কোন ভিজিটিং কার্ড নেই। উনি জানালেন কোন একদিন আমাকে একটি ঘটনা বলবেন। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে মনে বললাম সেই কোন একদিন না আসলেই ভালো হবে। তবে দুর্ভাগ্য সেই কোন একদিন কিছুদিনের মধ্যেই হাজির হয়ে গেল। পুরনো ঢাকার একটি রেস্টুরেন্টে আমি আমার এক সেলেব্রিটি বান্ধবীকে নিয়ে খাচ্ছি। সেই সেলেব্রিটির নাম বিশেষ কিছু কারণে বলছি না। এমন সময় আতাউর এসে হাজির। যেহেতু আমার স্মৃতি শক্তি অনেক বেশী বাজে তাই উনার চেহারা চিনতেই রীতিমত হিমশিম খেতে হল। তবে উনি উনার আগমনের বার্তা আমাকে মনে করিয়ে দিলেন নিজ দায়িত্বে। এবং প্রথম বারের মত বুঝতে পারলাম লোকটার সেন্স অফ হিউমার দেখার মত। উনি যাই বলেন বেশ রস লাগিয়ে বলেন যা শুনতে বেশ ভালোই লাগে। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার উনি নরমাল কোন ড্রাইভার না। নরমাল না মানে যে এবনরমাল তা বলছি না। উনি লাশের গাড়ি চালান। বেসরকারী একটি চ্যারিটি সংস্থার ড্রাইভার হিসেবে আছেন। আমার বান্ধবী উনার কথা শুনে বিরক্ত হলেও আমার তাকে খুব ইন্টারেস্টিং মনে হল। তাই নিজ দায়িত্বে একদিন ফোন করে দেখা করতে বললাম। উদ্যেশ্য ভালো কোন গল্প থাকলে সেটা নিয়ে কাজ করা। যারা গল্প বলে তাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে এমনভাবে গল্প বানিয়ে বলে যা শুনলেই লেখার এবং শোনার ইচ্ছে দুটোই পালায়। উনি যদি ঐ কাতারের কেউ হন তাহলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি নিজেই পালাব। পালানোর জন্য জায়গা রেডি করলাম। অফিসে নয় তার থেকে গল্প শুনব চারুলতা রেস্টুরেন্টে। গল্প ভালো না হলে নিজেই অফিসের বাহানা করে পালিয়ে আসব। রেস্টুরেন্টে নির্দিষ্ট সময় সে এসে হাজির। দুটো ফালুদা অর্ডার করলাম এবং মনোযোগ দিলাম তার কথায়। সে আধঘণ্টা ধরে ফালুদা খেয়ে শেষ করে জানাল এখানে সে গল্প বলতে পারবেনা। তবে যদি আমার আপত্তি না থাকে আমাকে একদিন লাশের গাড়িতে বসিয়ে লাশ নিয়ে তার ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতার কথা বলবে। ব্যাপারটা আমার কাছে আরও বেশী ইন্টারেস্টিং মনে হল। এক লাফে জানিয়ে দিলাম আমি রাজী। আর উনিও জানিয়ে দিলেন রাতে যদি কোন লাশ নিয়ে ঢাকার বাইরে রওনা করতে হয় উনি আমাকে জানাবেন। আমি তো উত্তেজনায় একদম অস্থির হয়ে গেলাম। তবে লাশের গাড়িতে লাশ নিয়ে ঘুরে গল্প শোনার মত সিচুয়েশন আর হল না। এক শনিবার রাত সাড়ে ১১ টায় আমরা লাশ ছাড়া লাশের গাড়ি নিয়ে রওনা করলাম। উদ্দ্যেশ্য উনি গাড়ি চালাতে চালাতে আমাকে গল্প বলবেন। গল্প শেষ হলে নিজেই গাড়ি দিয়ে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিবেন। আইডিয়াটা খারাপ লাগল না। এই সময়টুকুতে ঢাকার বাইরে যতটুকু যাওয়া যায় আমরা যাব…

এই গভীর রাতে রওনা হলাম তার সাথে। গন্তব্য আমি নিজেই জানি না। উনি যেখানে নিয়ে যাবেন সেখানেই যাব। রওনা হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই উনি গল্প শুরু করলেন। আতাউর এর ভাষা শুনে আমি কিছুটা অবাক হলাম। শুনে মনেই হচ্ছে না কোন ড্রাইভার কথা বলছে। একদম শুদ্ধ বাংলায় প্রতিটা শব্দ উচ্চারন করছে।

যাই হোক আপনাদের সুবিধার জন্য গল্পটি ড্রাইভার আতাউরের ভাষায় লিখে দিচ্ছি-

আমার বয়স তখন বিশ কিংবা বাইশ হবে। বাসায় টাকার প্রচণ্ড অভাব।অভাবের সংসার টানতে গিয়ে মায়ের মাথা পুরাই খারাপ। আমার বাবা মুদির দোকানদার। তার আশে-পাশে সব দোকান খুব হিট। শুধু তার দোকানেই কেন জানি কোন বিক্রি টিক্রি নাই। খুব বাজে অবস্থা নিয়ে দিন পার হচ্ছে। এমন সময় বিশ-বাইশ বছরের একটা ছেলে বেকার ঘুরবে সেটা কেউ মানবে সেটার প্রশ্নই আসে না। তবে আমার বাসা সেটা অনেকদিনই মেনে নিল। লেখাপড়ার যোগ্যতা নেই বলেই হয় তো আমার প্রতি সবার আশা-ভরসা খুবই কম। ঠিক কম না, বরং আমার উপর কারো ভরসা নাই বললেই চলে। তাই চাকরি বাকরি করার কোন সম্ভাবনাও দেখতে পাচ্ছিলাম না। একবার ভাবলাম ধোলাইখালে কাজে নামব। কয়েকদিন ঘুরাফেরাও করলাম। বড় বড় গাড়ি থেকে মোটর পার্স চুরি ছাড়া আর কিছুই শেখার মত পেলাম না। তাই হতাশ হয়েই বলা যায় অন্যকিছু করার কথা চিন্তা করলাম। আর তখনই উপরওয়ালা আমাকে একটা পথ বের করে দিলেন। ঢাকা মেডিকেলে গিয়েছি। ফেরার পথে শহীদ মিনারের সামনে চায়ের দোকানে বসে আছি। এক কাপ চা নিয়েছি সেটা শেষ করতেও ইচ্ছে করছে না। শুন্য পকেটে সবকিছুই কেমন যেন শুন্য শুন্য লাগছে। এমন সময় চায়ের দোকানেই এক বয়স্ক লোকের সাথে পরিচয় হল। মুখভর্তি পান নিয়ে কথা বলছেন। দুজন মুখ শুকনা করে তার কথা শুনছেন। নেই কোন কাজ তো খই ভাজ। আমিও তার কথা শুনতে শুরু করলাম। ধর্ম নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছেন। বুড়ো বয়সে মানুষ যা দেয় আর কি। তবে লোকটার কোথায় যেন কি একটা ছিল। উনি যখন চা খেয়ে বের হচ্ছেন তখন আমি আমার পুরো অভাবের কাহিনী উনাকে বলে দিলাম। আরও বললাম যদি সম্ভব হয় আমাকে একটু সাহায্য করতে। উনি পান চিবুতে চিবুতেই বললেন গাড়ি চালাইতে পারবা??? যেহেতু নাই মামা থেকে কানা মামা অনেক বেশী ভালো তাই বলে বসলাম হ্যা পারব। তাছাড়া না পারার কোন কারণ অবশ্য ছিল না। আমি আগে থেকেই গাড়ি চালাতে পারতাম।

উনি কপালটা একটু কুঁচকে বললেন, সাধারণ গাড়ি না, লাশের গাড়ি। মেডিকেলের সামনে যে মাইক্রোটা দেখতেছ ঐটা আমার। আমি লাশের গাড়ির খ্যাপ মারি।

আমি উনাকে অনেক ভালোভাবেই বললাম, জি পারব। লাশের গাড়ি কেন বাঁশের গাড়ি হলেও প্রবলেম নেই।

উনি হেসে বললেন, লাশ আর বাঁশে বিশাল পার্থক্যরে বাবা। আমি এদিকেই থাকি চইলা আইসো। দেখি কিছু করতে পারি কিনা।
কবে আসব?

আইসো কাল পরশু। লাশ আনা-নেওয়া তো বলে কয়ে হয় না। তবে মেডিকেল মানে বিষয় অন্য। আর কিছুর অভাব হইলেও লাশের অভাব নাই। আইসো… আমি তো আছি…

আমি তিনদিন পর গিয়ে হাজির হলাম। উনি ওদিকেই ছিলেন। লোকটার চেহারায় একটা ব্যাপার খুব দারুন। সারল্যের একটা হাসি দিয়ে মানুষকে কিভাবে যেন নিজের করে নিতে পারেন। আমাকে দেখেই বললেন, পারবা তো গাড়ি চালাইতে। এটা কিন্তু নরমাল গাড়ি না। লাশের গাড়ি।

উনার হয় তো আমার সাহস সম্পর্কে কোন আইডিয়া ছিল না। তাই উনি বারবার এরকম প্রশ্ন করছিলেন। আমি উনাকে আশ্বাস দিলাম যে কোন ভয় নেই। যাই হোক না কেন আমি পারব।

উনি আর কথা বাড়ালেন না। সেদিন সন্ধ্যা বেলাতেই আমাদের একটা লাশ নেওয়ার খ্যাপ মিলে গেল। ১৬-১৭ বছরের বাচ্চা একটা মেয়ে। সুইসাইড করেছে। তবে মেয়ের বাবা-মা চাচ্ছে না জানাজানি হোক। তাই অনেকটা চুপি চুপি লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে মাটি দিতে চাচ্ছেন।লাশের সাথে তাই বেশি মানুষও যাচ্ছে না। একজন মহিলা আর একজন পুরুষ যাবে। সম্ভবত সেই মেয়ের মা-বাবাই।পুরো ব্যাপারটা নিয়ে যেহেতু ঐ গাড়ির মালিক কথা বলেছেন তাই বাসা থেকে চুপি চুপি লাশ উঠানো পর্যন্ত সবকিছুই উনার উপর ছেড়ে দিলাম। আর কে যাবে, কে যাবে না এটা নিয়েও মাথা ঘামালাম না। আমি আর ঐ গাড়ির মালিক সাথে একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা লাশ গাড়িতে তুলে রওনা হলাম।ও গাড়ি ওয়ালা চাচার নাম বলতে ভুলে গেছি। উনার নাম আলীগোল। আলীর সাথে গোল এর কি সম্পর্ক সেটাই বুঝলাম না। ও সেই সময়টা কেমন সেটাও তো বলিনি। তখন শীতকাল। শীতকালে হাইওয়েতে গাড়ি চালানো সহজ ব্যাপার না। তাই লাশ নেওয়ার চাইতে কুয়াশার মাঝে গাড়ি চালানোটাই আমার কাছে বেশি চ্যালেঞ্জিং মনে হতে লাগল। কারন ঢাকা শহরে শীত গরম একই কথা হলেও হাইওয়েতে বোঝা যায় কুয়াশা কাকে বলে। লাশের কিছু ঝামেলা শেষ করে রওনা হলাম। দুই ঘণ্টার মধ্যে আমরা ঢাকার বাইরে অনেক দূর চলে গেলাম। পিছনের মহিলা একটু পর-পরই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন আর পিছনে বসা ভদ্রলোক ধমক দেন। এদিকে লাশ নিয়ে যাওয়া আমার কাছে বেশ ইন্টারেস্টিং লাগল। ভয়ডর কিছুই লাগল না। ভালো ভাবেই অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেলাম। সন্ধ্যা থেকে না খেয়েই ছিলাম। তাই রাত দশটা-এগারোটার দিকে প্রচন্ড ক্ষুধায় একদম নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসার অবস্থা হল। আমার চেহারা দেখেই মনে হল আলীগোল চাচা আমার ক্ষুধার কথা বুঝতে পারলেন। হাইওয়ের পাশে একটা নরমাল ভাতের হোটেল দেখে থামতে বললেন। গাড়ি থামিয়েই পিছনের মানুষদের উদ্দ্যেশ্য করে বললেন, লম্বা পথ যাইতে হবে। আপনেরা কি কিছু খাইবেন???

মহিলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললেন, আমাদের খাওয়ার মত অবস্থা নাই। আপনাদের খাওন দরকার আপনারা খায়া আসেন।

গাড়ি রাস্তার পাশে পার্ক করে আমি এবং আলীগোল চাচা খেতে গেলাম। যাবার আগে আলীচাচা কঠিন সাবধানবাণী দিয়ে গেলেন। লাশ ছেড়ে যেন ভুলেও উনারা গাড়ি থেকে না নামেন। অস্বাভাবিক স্বাভাবিক যে কোন লাশই নাকি একা রাখা বিপদজনক।

সাবধানবাণী আমার কাছে তেমন কিছু মনে হল না। কারন জীবিত মানুষ ভয় পায়। মৃত মানুষের আবার ভয় ডর কি? আমি নিশ্চিন্ত মনে হোটেলে ঢুকে খাওয়া শুরু করলাম। আহামরি কিছু না। ভাত পাবদা মাছ আর ডাল। আমি আর আলী চাচা খাচ্ছি। এমন সময় সামনের টেবিলের দিকে তাকিয়ে আমার চোখ চড়ক গাছ হয়ে গেল। ঐ মহিলা আর পুরুষ এসে বসে বসে খাবার এর অর্ডার দিচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে আমার কিছু মনে না হলেও আলী চাচা ভয়ংকর রকম ক্ষেপে গেলেন।তাদের হোটেলের মধ্যে তীব্র অপমান করে উনি একা একা গজগজ করতে করতে গাড়ির দিকে গেলেন। আমি কি করব ঠিক বুঝতে না পেরে খাওয়া শেষ করে গাড়িতে ফিরে গেলাম।কিছুক্ষণের মধ্যেই ঐ মহিলা পুরুষও এসে পড়ল। আবার যাত্রা শুরু করলাম। কিন্তু আলী চাচা তার মেজাজ আর ভালো করতে পারলেন না। একা একা কিছুক্ষণ গজগজ করে তসবী পড়তে শুরু করলেন। আর মহিলা কিছুক্ষণ পর পর একটু একটু ফুঁপানো শুরু করল। কিন্তু ঝামেলা শুরু হল হাইওয়ে ছেড়ে যখন আমরা একটা গ্রামের পাশের রাস্তায় চলতে শুরু করলাম তখন। ঐ রাস্তা দিয়ে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই আমাদের ছিল না। কিন্তু পুরুষ লোকটি বলল এদিক দিয়ে গেলে নাকি তাড়াতাড়ি হবে উনার কথার কারণেই মূলত আমরা ঐ রাস্তায় যেতে বাধ্য হলাম। রাস্তায় ঢুকতে না ঢুকতেই জোরে শব্দ হল।মনে হল আশে-পাশের কোথাও জোরে বোমা ফেটেছে। আমি সাথে সাথে গাড়ি থামিয়ে ফেললাম। আশে-পাশে আর কোন গাড়ি নেই। রাস্তায় এত কুয়াশা যে দূর থেকে গাড়ি আসলেও বুঝতে পারার ক্ষমতা আমাদের নেই। হটাত করেই আলী চাচা বললেন টায়ার ঠিক আছে তো???

বুঝলাম বোমা নয় ফাটলে আমাদের টায়ারই ফেটেছে। চার ব্যাটারির বড় টর্চ নিয়ে আলী চাচা নামলেন। আমিও তার সাথে নামলাম। সবকয়টি চাকা ভালো ভাবে দেখা হল। কোন টায়ারই ফাটেনি। যেহেতু কোন কিছুই হয়নি তাই আল্লাহ্র নাম নিয়ে আবার গাড়ি স্টার্ট দিলাম। কিছুদূর সামনে গেলাম। সময় তখন কয়টা… দেড়টা কিংবা দুইটা হবে। আলী চাচা তসবী হাতে ঘুমে ঝিমুচ্ছেন। আর আমি কুয়াশার সাথে যুদ্ধ করে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। পিছনের মানুষ ঘুম নাকি জেগে আছে বুঝতে পারলাম না। অনেকক্ষণ ধরেই মহিলার কোন ফুঁপানোর শব্দ পাচ্ছি না। তবে আরেকটু সামনে যাওয়ার পর-পরই পিছন থেকে মহিলা চিৎকার করে বলল, আমার মাইয়া নাইক্কা… ডেরাইভার গাড়ি থামান… আমার মাইয়া নাইক্কা… আলী চাচা লাফ দিয়ে ঝিমুনি ছেড়ে উঠে বসলেন। ঘটনা কি বুঝবার আগেই ইশারায় বললেন গাড়ি থামাতে। আমি গাড়ি থামালাম। পিছনের পুরুষ মানুষটি বলল, গাড়িতে লাশ নাই। লাশ কই গেল?

পিছনের মানুষের কথা আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। ঘটনা কি বুঝবার জন্য নামলাম। আলী চাচা টর্চ মারলেন। আসলেই লাশ নেই। শুধু লাশ না। যে স্ট্রেচারে লাশ চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল সেটাও নেই। ঘটনা হজম করতে আমার সময় লাগল। কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারলাম না। এদিকে মহিলা মরা কান্না শুরু করল। টর্চের আলোতেই দেখলাম পুরুষ মানুষটি ঘটনার আকস্মিকতায় ভড়কে গেছেন। আলী চাচা টর্চ দিয়ে গাড়ির ভেতর বাহির সব দেখলেন। আমি তার দিকে তাকালাম। কি করা উচিত আর আদৌ কি হয়েছে আমি নিজেই ঠিক বুঝতে পারছি না। উনি বললেন আল্লাহ্র নাম নিয়া গাড়ি ঘুরাও। ফাঁসির মরার সাথে শয়তান ঘুরে। লাশ আশে-পাশেই আছে। আমি গাড়ি ঘুরালাম। একে তো কুয়াশা তার উপর রাস্তার দিকে তাকিয়ে লাশ খোজা। একবার মনে হল অর্থহীন কাজ করা হচ্ছে। লাশ গাড়ির বাইরে যাবে কি করে? ঠিক আবার মনে হল মৃত্যু যেমন রহস্যময় এরকম আরও অনেক রহস্য দুনিয়ায় আছে তার কতটুকু আমরা জানি? আস্তে আস্তে গাড়ি ঠিক সেই জায়গায় নিয়ে গেলাম যেখানে খুব জোরে শব্দ পেয়েছিলাম।গাড়ির আলোতে দেখলাম দূরে রাস্তার মাঝখানে স্ট্রেচার রাখা। তার উপরেই চাদর দিয়ে লাশ রাখা। লাশ রাস্তার মাঝখানে কিভাবে গেল সেই চিন্তা মাথায় আসার আগে মাথায় আসল লাশ পাওয়া গেছে এটাই আমাদের সাত কপাল। গাড়িটা স্ট্রেচারের সামনে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই আমরা নেমে স্ট্রেচার গাড়িতে তুললাম।লাশ লাশের মতোই আছে। শুধু টর্চের আলোয় লাশের চেহারায় এমন কালো কালো ছোপ দেখলাম যা দেখলে যে কারো পিলে চমকে যাবে। এক মনে দোয়া পড়তে পড়তে লাশ গাড়িতে তুললাম। কপাল এমন খারাপ। এমন এক রাস্তা যে আমাদের গাড়ি ছাড়া আর একটা গাড়িও যেতে দেখছি না।মানুষ দেখলেও একটা ভরসা কাজ করে। সেই ভরসার খুব অভাববোধ করতে শুরু করলাম।লাশ গাড়িতে উঠিয়ে আবার স্টার্ট দিলাম। বেশি না বিশ গজ সামনে গিয়েছি।পিছন থেকে মহিলা পুরুষ দুজনই বলল লাশ নাই।গাড়িতে লাশ নাই। আলী চাচা জোরে জোরে দুরুদ পড়তে শুরু করলেন। আমি কি করব ঠিক কিছুই বুঝতে পারলাম না। শীতের রাত। কুয়াশায় কিছু দেখা যাচ্ছে না তবুও বুঝতে পারলাম আমার কপাল বেঁয়ে ঘাম ঝড়ছে। পুরো ঘটনা হজম করবার মত হজম ক্ষমতা আমার মস্তিষ্কের নেই। আমি অসহায় ভাবে আলী চাচার দিকে তাকালাম। উনাকে অস্থির লাগছে। আমাকে ইশারা করলেন গাড়ি নিয়ে এগিয়ে যেতে। বুঝতে পারছি যা হচ্ছে ভালো হচ্ছে না। এদিকে পিছনের মহিলা পুরুষ পাগলের মত চেঁচাচ্ছে আর বলছে লাশ খুজেন। গাড়ি থেকা নামেন।গাড়ি সামনে নিয়ে যাব কিংবা পিছনেই নিয়ে যাব খেয়াল করে দেখলাম আমার পা ঠিক মত একসেলেটরে চাপ পর্যন্ত দিতে পারছে না। হটাত করেই পায়ের সব শক্তি হারিয়ে গেছে। শুধু পায়ের না পুরো শরীরের শক্তিই মনে হয় নাই হয়ে গেছে।তখনই আমার ডান পাশের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে যা দেখলাম তা দেখে আমার পুরো শরীর পাথর হয়ে গেল।যে মেয়েটির লাশ স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাচ্ছিলাম। সেই মেয়েটি আমার গাড়ি থেকে ঠিক এক হাত দূরে আস্তে আস্তে হেঁটে যাচ্ছে। গাড়ি টেনে যাব সেই সামর্থ্য আর আমার নেই। আলী চাচা জোরে জোরে দোয়া পড়ে যাচ্ছেন। কুয়াশার মাঝেও আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি মেয়েটার জিব বের করা।আমি গাড়ি আর একটুও টানতে পারলাম না। সারারাত গাড়ি ওখানেই রইল। গাড়ির আশে-পাশে অনেক রকম কিছুই দেখতে পেলাম। কিন্তু যখন ফজর এর আযান হল,তার কিছুক্ষণ পরই সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেল। তবে তখন আর লাশটি খুজে পেলাম না। আলী চাচা বললেন অস্বাভাবিক মৃত্যুর লাশের সাথে ঝামেলা আছে। এই লাশ পাওয়া যাবে না। মেয়েটির বাবা-মা সকালের আলো ফোটার পর রাস্তার আশে-পাশে থেকে শুরু করে অনেক খোঁজা খুজি করলেন কিন্তু লাশের কোন হদিসই পাওয়া গেল না।

এই পর্যন্ত বলে ড্রাইভার আতাউর তার গল্প শেষ করলেন। হঠাত আমি আতাউর এর ড্রাইভিং সিটের পাশের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে দেখলাম এই গভীর রাতে কেউ একজন মেয়ে হাঁটছে। আমি উনাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনি যে রাস্তার কথা বলছেন এটা কি সেই রাস্তাটা?
আতাউর কোন কথা না বলে স্পীডে গাড়ি নিয়ে হাইওয়েতে উঠে গেলেন।সেই রাস্তার গল্প আর শোনা হল না…কি আর করা কিছু জিনিস না শোনাই হয় তো সবার জন্য মঙ্গলজনক।