হেলপারকে বাস চালাতে দিয়ে প্রথমে তানিয়াকে ধর্ষণ করে ড্রাইভার

কিশোরগঞ্জে চলন্ত বাসে নার্স শাহীনুর আক্তার তানিয়াকে ধর্ষণের পর হত্যায় জড়িত সন্দেহে রিমান্ডে থাকা আটককৃতরা পুলিশের কাছে মুখ খুলতে শুরু করেছে। রিমান্ডে স্বর্ণলতা বাসের ড্রাইভার নূরুজ্জামান ও হেলপার লালন মিয়া পুলিশকে ধর্ষণ ও হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। তাদের কথামতো স্বর্ণলতা পরিবহনের যে বাসটিতে ঘটনা ঘটে (ঢাকা মেট্রো-ব-১৫-৪২৭৪) তা গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার টোক এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। বাসটির তিন জায়গায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ পাওয়া গেছে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, প্রথমে পুলিশকে বিভ্রান্ত করতে অন্য একটি বাসের কথা বলেছিল আসামিরা। সেই বাসটি (ঢাকা মেট্রো-ব-১৪-৬২৮৫) আগেই আটক করেছিল পুলিশ। সেই বাসে ধর্ষণ বা হত্যার কোনও আলামত পায়নি তারা। এরপরই ড্রাইভার নূরুজ্জামান ও হেলপার লালনের কথায় পুলিশের সন্দেহ হয়। রিমান্ডের শুরুতে এলোমেলো কথা বলে আসামিরা। পরে তাদের আরও চাপ প্রয়োগ করা হয়। ঘুমাতে না দেওয়ার কৌশল কাজে লাগে। প্রচণ্ড মানসিক চাপে পড়ে তারা অপরাধ স্বীকার করতে শুরু করে। আসামিদের কথামতো উদ্ধার করা হয়েছে তানিয়ার ব্যাগের কাপড়-চোপড়, তানিয়ার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ও তানিয়ার সঙ্গে থাকা টেলিভিশন।

পুলিশের কাছে ড্রাইভার নূরুজ্জামান ও হেলপার লালন মিয়া স্বীকার করেছে, ধর্ষণ ও হত্যায় তারা নিজেরাসহ সরাসরি আরও একজন জড়িত ছিল। কিন্তু তৃতীয় ব্যক্তিটির নাম তদন্তের স্বার্থে পুলিশের সূত্রটি জানাতে অস্বীকৃতি জানায়।

পুলিশের কয়েকটি সূত্র নিশ্চিত করেছেন, ধর্ষণ ও হত্যার পর ধর্ষণকারীরা বিষয়টি সড়ক দুর্ঘটনা প্রমাণ করতে নাটক সাজিয়েছিল। ধর্ষণের পর তানিয়াকে চলন্ত বাস থেকে ফেলে দেওয়ার পর ধর্ষকরা নিজেরাই আবার ঘটনাস্থলে যায়। সেখানে মেয়েটিকে পড়ে থাকতে দেখে অনেক স্থানীয় মানুষও এগিয়ে আসে। কিন্তু ধর্ষকরা স্থানীয়দের জানিয়েছিল এয়ারফোনে গান শুনতে শুনতে মেয়েটি বাস থেকে পড়ে গেছে, আমরাই হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। তাদের কথা বিশ্বাসও করেছিল স্থানীরা। পরে অচেতন অবস্থায় তানিয়াকে পিরিজপুর বাজারের সততা ফার্মেসিতে নিয়ে যাওয়া হয়। ফার্মেসি থেকে মেয়েটিকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার কথা বললে স্বর্ণলতা বাসের স্টাফ আল আল আমিন ও রফিকে দিয়ে কটিয়াদী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠায় তারা। এরপর তানিয়াকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনার বর্ণনা দেয় ড্রাইভার ও হেলপার। হাসপাতালের আশপাশ থেকে রফিককে গ্রেফতার করলেও পালিয়ে যায় আল আমিন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাজিতপুর থানার একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চলন্ত বাসের দরজা জানালা লাগিয়ে তানিয়াকে ধর্ষণ করে তারা। হেলপারকে গাড়ি চালাতে দিয়ে প্রথমে ড্রাইভার তাকে ধর্ষণ করে। এরপর আরও দু’জন ধর্ষণ করে তাকে। তানিয়া নিজেকে বাঁচাতে সজোরে তাদের কিল ঘুষিও মারে। ধর্ষণের পর তানিয়াকে গলাটিপে বা অন্য কোনও উপায়ে হত্যা করতে চেয়েছিল ধর্ষণকারীরা। এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে তাদের বাকবিতণ্ডা হয়। পরে চলন্ত বাস থেকে ফেলে দিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা।

কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মাশরুকুর রহমান খালেদ বলেন, ‘তদন্ত দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। আমরা বাসটি আটক করেছি। মেয়েটির ব্যবহৃত মোবাইল ফোন, বাসে বহন করা টেলিভিশন ও কাপড়-চোপড়ের ব্যাগ উদ্ধার করা হয়েছে। আমরা একেবারেই নিশ্চিত যে তানিয়াকে চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে।’

কটিয়াদী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক ডা. তাজরিন তৈয়বা জানান, ‘মেয়েটিকে যারা নিয়ে এসেছিল তারা সড়ক দুর্ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দিতে চেয়েছিল। তাদের কথার সঙ্গে তানিয়ার শরীরের আঘাতের চিহ্ন ও সার্বিক বাস্তবতা মিলছিল না। তাই আমরা তাদের বুঝতে না দিয়ে দ্রুত পুলিশকে খবর দিয়েছিলাম। পুলিশ এসে ঘটনাস্থলেও তাদের পেয়েছিল। হঠাৎ শুনলাম ছেলে দুটো পালিয়ে গেছে। প্রথম থেকেই মনে হয়েছিল মেয়েটির সঙ্গে খারাপ কিছু হয়েছে।’

ময়নাতদন্তের দায়িত্বে থাকা সিভিল সার্জন ডা. হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, ‘ময়নাতদন্তে তানিয়াকে ধর্ষণ ও হত্যার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। আমরা ময়নাতদন্তের সময় সব বিষয় খুঁটিয়ে দেখেছি। মেয়েটিকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এটা নিশ্চিত। ধর্ষণের পর তার মাথার পেছনে প্রচণ্ডভাবে ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল। মাথার খুলির পেছনের অংশ দুই ভাগ হয়ে গেছে। মাথার ভেতর প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। এমন আঘাতের পর সঙ্গে সঙ্গে মারা যাওয়ার কথা। যদি সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু নিশ্চিত না হয় তবে সর্বোচ্চ ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিট বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আছে।’

তানিয়াকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় তার বাবা গিয়াসউদ্দিন বাদী হয়ে ৭ মে রাতে বাজিতপুর থানায় মামলা দায়ের করেছেন। এ ঘটনায় বাসের চালক নূরুজ্জামান নূরু (৩৯) ও হেলপার লালন মিয়াসহ (৩২) মোট পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বুধবার আটককৃতদের কিশোরগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালত আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

উল্লেখ্য, সোমবার রাতে ঢাকার বিমানবন্দর থেকে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের পিরিজপুর রুটে চলাচলকারী ‘স্বর্ণলতা’ নামক বাসে নার্স শাহীনুর আক্তার তানিয়াকে ধর্ষণের পর মাথার পেছনে আঘাত করে হত্যা করা হয়। তিনি কটিয়াদী উপজেলার লোহাজুরি ইউনিয়নের বাহেরচর গ্রামের মো. গিয়াসউদ্দিনের মেয়ে। তানিয়া ঢাকার ইবনে সিনা হাসপাতালের কল্যাণপুর ক্যাম্পাসে সেবিকা পদে কর্মরত ছিলেন। সোমবার (৬ মে) রাতে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলায় কিশোরগঞ্জ-ভৈরব আঞ্চলিক মহাসড়কের বিলপাড় গজারিয়া নামক স্থানে এ ঘটনাটি ঘটে। এ সময় তানিয়া ঢাকা থেকে কটিয়াদী ও বাজিতপুরের পিরিজপুর হয়ে নিজ গ্রামে ফিরছিলেন। সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন