অন্ধ মা-বাবাকে কাঁধে করে ৩৯ কি.মি. হেঁটে বাংলাদেশে যুবক

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিজেদের নৃশংসতার চিত্র মুছে ফেলতে নিহত রোহিঙ্গাদের মরদেহ গুম করছে। তারা আগুনে পুড়িয়ে, মাটিতে পুঁতে ও নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে রোহিঙ্গাদের নিথর দেহ গুম করছে। যাতে পরবর্তীতে বিশ্বের কেউ এসে এর প্রমাণ না পায়। উখিয়ায় অনুপ্রবেশকারী অনেক রোহিঙ্গা এই দাবি করেছেন।

মিয়ানমারে সেনা অভিযান শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পার হয়ে ঢুকেছে বাংলাদেশে। যে যেভাবে পারছে সেভাবেই ঢুকে পড়েছে। শিশু-নারী-বৃদ্ধ থেকে শুরু করে সবাই নদীর স্রোতের মতো বাংলাদেশে আসছে।

এ অবস্থায় হার না মানা এক রোহিঙ্গা যুবক বাবা-মাকে কাঁধে করে বাংলাদেশে আসার দৃশ্য সবার নজর কেড়েছে। ইতোমধ্যে ওই রোহিঙ্গা যুবক ও তার মা-বাবার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

জানা গেছে, মিয়ানমারের আরাকান থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অন্ধ বাবা-মাকে ঝুড়িতে করে হেঁটে বাংলাদেশে এসেছেন রোহিঙ্গা যুবক নেজাম।

গতকাল রোববার (১০ সেপ্টেম্বর) দুপুরে কুতুপালংয়ে দেখা মেলে নেজামের। ছেলের বহন করা ঝুড়িতে তখনও ঘুমাচ্ছিলেন বাবা-মা। যখন ঝুড়িটি মাটিতে রেখেছেন তখন সবাই ছুটে এসে নেজামকে ঘিরে ধরে।

দেখা যায়, নেজামের কাঁধে দুটি ঝুড়ি। একটিতে বাবা অন্যটিতে মা। বাবার বয়স ৯৬, মায়ের ৮৭। দুজনের কেউই দেখতে পান না। বেশি দূর হাঁটতেও পারেন না। তারা এপারে আসতেও চাননি। যে ভূমির আলো বাতাসে যুগের পর যুগ কাটিয়েছেন সেখান থেকে কে আসতে চায়! তারা কেবল চাইছিলেন সন্তানকে এপারে পাঠিয়ে পুনর্জন্ম দিতে! হয়তো অপরাধবোধও ছিল, সন্তানদের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে পারেননি বলে। কিন্তু নেজাম তা মানতে পারছিলেন না।

বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কী হবে, কী করবেন নিজের মা-বাবাকে। এসব ভাবতে ভাবতে দুইদিন কেটে যায়। হয়তো কিছুদিন পর স্বাভাবিকভাবেই তাদের মৃত্যু হবে। এরপরও মিয়ানমার সৈন্যদের হাতে বাবা-মায়ের মৃত্যু যেন না হয়, সেটাই চাইছিলেন নেজাম।

যারা তাকে জন্ম দিলেন তাদের মৃত্যুর মুখে রেখে কোনোভাবেই এদিকে পা এগুচ্ছিলো না নেজামের। কাকুতি-মিনতির পর অবশেষে বাবা-মা রাজি হন।

কিন্তু রাজি হলে তো শেষ নয়। দক্ষিণ মংডুর যেখানে নেজামদের বাড়ি, সেখান থেকে সীমান্ত অন্তত ৩৯ কিলোমিটার। কোনো গাড়ি নেই। দুই পা একমাত্র বাহন। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলেন, সে বাহনেই বাবা মাকে নিয়ে রওয়ানা হবেন।

ঘরের মালামাল নেয়ার ঝুড়িতে তুলে নিলেন বাবা-মাকে। তারপর হাঁটা শুরু। সারাদিন হেঁটেছেন, রাতে জিরিয়েছেন। পরদিন আবার হাঁটা শুরু। রাস্তা, জমি, পাহাড়, জঙ্গল, নদী পার হয়ে ৫ দিন পর পৌঁছলেন বাংলাদেশে!

রোববার দুপুরে কুতুপালংয়ে দেখা হয় নেজামের সঙ্গে। ছেলের বহন করা ঝুড়িতে তখনও ঘুমাচ্ছিলেন বাবা-মা। তারা তখনও জানেন না ওই মুহূর্তে তারা কোথায়। তবুও বাংলাদেশে আশ্রয়ের কথা শুনে কিছুটা স্বস্তি তাদের মুখে।

নেজাম বলছিলেন, এতোটুকু পথ পাড়ি দিয়েছি তাতে আমার কোনো কষ্ট নেই। বাবা-মাকে এখানে আনতে পেরেছি। এটাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি।

নেজামের ভাষ্য, আমাদের আশপাশের বাড়িঘর সব পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। যখন সেনাবাহিনী আমাদের গ্রামে গুলি চালানো শুরু করল তখন উপায় খুঁজছিলাম কোথায় যাব। ভাবলাম সীমান্তের এদিকে চলে এসে বাংলাদেশে আসব। কিন্তু তখন বাবা-মা আসতে রাজি হয়নি। তারা বলেছিলেন, তুই পালিয়ে যায়। আমাদের যা হওয়ার হবে। আমাদের কথা চিন্তা করিস না। তুই বাংলাদেশে চলে যা।

তিনি বলেন, কিন্তু কোনোভাবেই মন সাড়া দিচ্ছিল না। বাবা-মাকে ফেলে আসতে খুব অসহায় লাগছিল। তাই পরের দিন চিন্তা করলাম কীভাবে মা-বাবাকে নিয়ে আসব। তখন ঘরের ওই ঝুড়িতে তাদের বসিয়ে রাতের বেলায় বাড়ি থেকে বের হলাম। তবে ভয় ছিল, যদি সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ি। তাহলে তারা আমাদের মেরে ফেলবে। এ জন্য নদী-পাহাড়ের কোলঘেষে হাঁটতে শুরু করি। এভাবে ৫ দিন হাঁটার পর বাংলাদশে প্রবেশ করি।

উল্লেখ্য, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত ২৫ আগস্ট নতুন করে সেনা অভিযান শুরুর পর থেকে গত ১১ দিনে দেড় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। প্রতিদিনের মতো মঙ্গলবারও সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে। এসব রোহিঙ্গা মোচনী, নয়াপাড়া ও লেদা, কুতুপালং ও বালুখালীর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করছে।