তরিকুলকে হাতুড়িপেটায় জড়িতরা সবাই ছাত্রলীগের পদধারী নেতা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তরিকুল ইসলামকে যারা পিটিয়েছেন, তাদের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা সবাই ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পদধারী নেতা। তবে পুলিশ এখনও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বলছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অভিযোগ করলে সক্রিয় হবে তারা। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, তারা হামলাকারীদের শনাক্তের চেষ্টা করছেন।

অথচ তরিকুলের ওপর কারা হামলা করেছিলেন, সেটি স্পষ্ট। হামলার একাধিক ছবিও ভিডিও চিত্র পাওয়া যাচ্ছে ফেসবুকেই। আর এই ছবি ও ভিডিওর সূত্রেই তরিকুলকে হাতুড়ি সদৃশ লোহার বস্তু দিয়ে আঘাত করা ছেলেটিরও পরিচয় জানা গেছে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক আবদুল্লাহ-আল-মামুন। ঘটনার পর থেকে তিনি লাপাত্তা। রাজনৈতিক সহকর্মী বা পরিচিতজনরাও তার খোঁজ জানেন না।

গত শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন করা সংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতার ওপর হামলা হয়। আর এর প্রতিবাদে সোমবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল করছিলেন ছাত্ররা।

এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে ছাত্রদের ওপর হামলা হয়। হামলাকারীরা রামদা, লোহার রড ও বাঁশের লাঠি দিয়ে ধাওয়া দেয়। এর মধ্যে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের তরিকুলকে ধরে ফেলে তারা। এরপর তাকে মাটিতে ফেলে বেদম পেটানো হয়।

চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে তরিকুলকে যখন বাঁশের লাঠি দিয়ে পেটানো হচ্ছিন, তখন তিনি নিথর শুয়ে থাকেন। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, এর মধ্যে হলুদ গেঞ্জি পড়া একটি ছেলে তার কোমর এবং পায়ে হাতুরি সদৃশ একটি বস্তু দিয়ে পেটাচ্ছেন।

তরিকুলের ওপর হামলার ছবি ও ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক আবদুল্লাহ-আল-মামুনই সেই ব্যক্তি যিনি হাতুড়ির মতো দেখতে বস্তুটি নিয়ে এসেছিলেন।

আর লাঠি হাতে পেটানো অন্যরা হলেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান মিশু, হাসান লাবন, সহ-সভাপতি গোফরান গাজী, মিজানুর রহমান সিনহা, রমিজুল ইসলাম রিমু, সাদ্দাম হোসেন, আহমেদ সজীব, ছানোয়ার হোসেন সারোয়ার, আরিফ বিন জহির, এবং কর্মী জন স্মিথ ও লতিফুল কবির মানিক।

এ বিষয়ে মামুনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে নানাভাবে চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তিনি ধরেননি। এমনকি ফেসবুক আইডিও ডিঅ্যাকটিভেট করা। মামুনের পাশাপাশি অন্যদেরকেও আর বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যাচ্ছে না।

জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া কথা বলেন তার সংগঠনের হামলাকারী নেতাদের পক্ষেই। তিনি দাবি করেন, সেদিন তাদের নেতা-কর্মীদের অবস্থান ছিল আত্মরক্ষামূলক।

কিবরিয়া বলেন, ‘আন্দোলনকারীরা পতাকার সঙ্গে বাঁশ এনেছিল। কেউ যদি বাঁশ নিয়ে ছাত্রলীগের ওপর হামলা করতে আসে, তাহলে তাকে তো ফুল দিয়ে সম্মান দেখানো হবে না। আত্মরক্ষা তো করতে হবে।’

সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় হওয়া এই ঘটনায় পুলিশের তৎপরতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। হামলাকারীদের গ্রেপ্তার তো দূরের কথা। তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলাও করা হয়নি।

জানতে চাইলে নগরীর মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহাদত হোসেন খান বলেন, ‘বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যাপার। তারা যেভাবে চাইবে সেভাবেই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

অর্থাৎ পুলিশ নিজে থেকে কোনো ব্যবস্থা নেবে না। তবে বাহিনীটি হাসপাতালে তরিকুলকে ঘিরে রেখেছে তিন দিন ধরে। এর কী উদ্দেশ্য সেটা স্পষ্ট নয়। যদিও মহানগর পুলিশের মুখপাত্র সিনিয়র সহকারী কমিশনার ইফতেখায়ের আলম দাবি করেছেন তারা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আহত রোগীদের নিরাপত্তা দেন। সে জন্য তরিকুলকেও নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে, যাতে আর কোনো অঘটন না ঘটে।

পুলিশের মতোই নির্লিপ্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও। তারাও এখনও কোনো আইনি প্রতিকারের ব্যবস্থা করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, ‘হামলায় কে বা কারা জড়িত সে ব্যাপারে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। অবশ্যই জড়িতদের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হবে।’

হামলার পর পর তরিকুলকে সেখান থেকে নেয়া হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সে সময় শোচনীয় অবস্থা দেখে চিকিৎসকরাও শঙ্কিত ছিলেন।

হাসপাতালে তরিকুলের মাথায় নয়টি সেলাই দেয়া হয়। এক্স-রে রিপোর্টে দেখা যায়, তার ডান পায়ের হাড় ভেঙে গেছে। তাই ওই পা প্লাস্টার করে দিয়েছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ্যতা অনুভব করার আগেই ভর্তি করার মাত্র একদিন পরই বুধবার তাকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।

তবে তরিকুল, তার স্বজন ও সহপাঠীরা মনে করছেন, হাসপাতাল ছাড়ার অবস্থায় নেই তিনি। এ কারণে তাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেয়ার প্রক্রিয়া চলছিল বৃহস্পতিবার দুপুরে।

তরিকুল ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী। বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের রাবি শাখার যুগ্ম-আহ্বায়কও তিনি। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সুন্দরখোল উত্তরপাড়া গ্রামে তার বাড়ি। তার বাবা খোরশেদ আলম একজন কৃষক। তিন ভাই বোনের মধ্যে তরিকুল মেজ।

তরিকুলের বোন ফাতেমা বেগম জানান, তার ভাইকে পেটানোর খবর পেয়ে বাবা খোরশেদ আলম ও মা তহমিনা বেগম অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই তারা ছেলেকে দেখতে আসতে পারছেন না। আর বাবা-মা ছাড়াই তরিকুলের চিকিৎসা নিয়ে তিনি এখন চরম বেকায়দায় পড়েছেন।

এদের পশুর সাথে তুলনা করলে সেই পশুকে অপমান করা হবে!!

Posted by Merajul Islam on Monday, July 2, 2018