আরবদের তেল অবরোধ কাঁপিয়ে দিয়েছিল বিশ্ব

তেল রফতানিকারক আরব দেশগুলো ১৯৭৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু শিল্পোন্নত দেশের বিরুদ্ধে তেল নিষেধাজ্ঞা জারি করে। আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইলকে সমর্থন দেয়ায় তারা এই পদক্ষেপ নিয়েছিল। আরবদের ওই সিদ্ধান্তের ফলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে গিয়েছিল কয়েকগুণ যার সুদুরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিল বিশ্ব রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে।
তেল অবরোধের প্রায় ৪৪ বছর হতে চলেছে। ওই অবরোধের প্রেক্ষাপট এবং নেপথ্যের ব্যক্তিদের নিয়ে বুধবার এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা।
এতে বলা হয়, ১৯৭০ এর দশকের শুরুতে বিশ্বের তেল সম্পদ নিয়ন্ত্রণের জন্য শুরু হয় এক নতুন লড়াই। তেল উৎপাদনকারী আরব দেশগুলো তেলের দাম বাড়ানোর চেষ্টা শুরু করার পর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো শিল্পোন্নত দেশগুলোতে।
সৌদি আরবের তেলমন্ত্রী আহমেদ জাকি ইয়ামানি ঘোষণা করলেন, একেবারে পানির দামে জ্বালানি তেল পাওয়ার দিন শেষ। বিশ্বে এক নতুন যুগ শুরু হতে যাচ্ছে। জ্বালানি তেলের যে বাজার মূল্য, তার চেয়ে কম দামে যদি কেউ উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে তেল কিনতে চায়, সেটা আর হবে না।
বিংশ শতাব্দীর বেশিরভাগ সময়জুড়ে বিশ্বের তেলের বাজার একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে সাতটি বড় পশ্চিমা তেলকোম্পানির এক জোট। এদেরকে বলা হতো ‘সেভেন সিস্টার্স’। বিশ্বের ৮৫ শতাংশ তেলের রিজার্ভ ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। এরাই তেলের দাম ঠিক করতো, এরাই কৃত্রিমভাবে তেলের দাম কমিয়ে রাখতো।
কিন্তু ৫০ এর দশক থেকে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো তেলের দাম নির্ধারণে তাদের অধিকার দাবি করলো। ১৯৬০ সালে সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, কুয়েত এবং ভেনেজুয়েলা গঠন করলো তেল রফতানিকারক দেশগুলোর জোট ‘ওপেক’। শিগগিরই এতে যোগ দিল আরো অনেক দেশ।
১৯৭৩ সালে ডক্টর ফাডহিল চালাবি ছিলেন ইরাকের তেল মন্ত্রণালয়ের পার্মানেন্ট আন্ডার সেক্রেটারি। ইরাক তখন মাত্র তাদের তেল শিল্প জাতীয়করণ করেছে। কার্যত ইরাকের পুরো তেল শিল্পের দায়িত্ব তার ওপর।
তিনি বলেন, ‘তেলের বাজার নিয়ে আগে যা চলছিল, আমি তার বিপক্ষে ছিলাম। কারণ এই ব্যবস্থাটা তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর স্বার্থের পক্ষে ছিল না। এতে তারা বঞ্চিত হচ্ছিল। কারণ তেলের দাম ছিল খুবই সস্তা।’
ওপেক সিদ্ধান্ত নিল যে তারা তেল শিল্পের জন্য একটা নতুন নীতি অবলম্বন করবে। তারা ঠিক করলো- তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোই তেলের দাম নির্ধারণ করবে, ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত সাতটি তেল কোম্পানি নয়।
১৯৭৩ সাল নাগাদ ওপেকের চাপের মুখে তেল কোম্পানিগুলোকে অনেক ছাড় দিতে হলো। তখন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপ আর জাপানে তেলের চাহিদা বছর বছর বাড়ছে। সে বছরই ওপেকের এর বৈঠকে ডক্টর ফাডহিল চালাবি তেলের দাম এক লাফে ৭০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিলেন।
কিন্তু তেল কোম্পানিগুলো এই প্রস্তাব শুনে আঁতকে উঠলো। এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার জন্য ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে ভিয়েনায় ওপেকের তেলমন্ত্রীদের এক বৈঠক ডাকা হলো। কিন্তু তখনই অপ্রত্যাশিতভাবে শুরু হলো এক যুদ্ধ যা সব কিছুর মোড় ঘুরিয়ে দিল।
ডক্টর ফাডহিল চালাবি বলেন, ‘ভিয়েনায় যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে সাদ্দাম হোসেনের খুবই ঘনিষ্ঠ এক লোকের সঙ্গে দেখা হলো। তার সঙ্গে কথাবার্তা থেকে আমি ধারণা পেলাম যে একটা যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে। তিনি আমাকে বললেন, খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে।’
মিশর এবং সিরিয়া ১৯৭৩ সালের ৬ অক্টোবর ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলো। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে যে ভূমি তারা হারিয়েছিল, সেটা পুনর্দখল তাদের লক্ষ্য। শুরুতে এই যুদ্ধে আরব সেনাবাহিনী বেশ ভালোই করছিল।
যখন এই যুদ্ধ চলছে, তখন ভিয়েনায় তেল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ওপেকের বৈঠকে চলছে অচলাবস্থা। তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে কোনো সমঝোতা হলো না। তাই তেলমন্ত্রীরা কুয়েতে আরেকটি বৈঠকে বসলেন।
সেখান ১৯৭৩ সালের ১৬ অক্টোবর তারা এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিলেন। এই প্রথম তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো তেল কোম্পানিগুলোকে বাদ দিয়ে একতরফাভাবে তেলের দাম নির্ধারণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলো। শুধু তাই নয়, তারা তেলের দাম ৭০ শতাংশ বাড়ানোরও ঘোষণা দেয়া হলো।
ডক্টর চালাবি বলেন, ‘এই প্রথম তেল কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ক্ষমতা চলে গেল ওপেকভুক্ত তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর হাতে। আমি স্বভাবতই এতে খুশি হলাম। কারণ ওপেকের ভিয়েনা বৈঠকে এর আগে আমি যে প্রস্তাব করেছিলাম, তাই এখন ঘটলো।’
কিন্তু সেখানেই থেমে থাকলো না ওপেক। মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতে তেল সম্পদকে একটি কার্যকর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের কথা চলছিল বহুদিন ধরে। ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে বিষয়টা আবার আলোচনায় চলে আসলো।
যুদ্ধ শুরুর পরপরই যুক্তরাষ্ট্র যখন ইসরাইলে জরুরি সামরিক সাহায্য পাঠাতে শুরু করলো, আরব দেশগুলো সিদ্ধান্ত নেয় এবার তাদের একটা কিছু করতে হবে।
ওপেকের আরব তেলমন্ত্রীরা কুয়েতে থেকে গেলেন এবং পরদিন ১৭ অক্টোবর তারা আবার বৈঠকে বসলেন। এই বৈঠকে সৌদি আরবের তেলমন্ত্রী ইসরায়েলের মিত্র দেশগুলোতে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার প্রস্তাব দিলেন। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং নেদারল্যান্ডসে যারা ইসরাইলে জরুরি ভিত্তিতে সামরিক সাহায্য পাঠিয়েছে।
ইরাক অবশ্য তেল নিষেধাজ্ঞার চেয়ে আরো কঠোর ব্যবস্থার প্রস্তাব দেয়। ডক্টর চালাবি জানান, তাদের প্রস্তাব ছিল, সব আরব দেশে যেসব মার্কিন তেল কোম্পানি আছে, সেগুলো জাতীয়করণ করা।
তিনি বলেন, ‘আমাদের তেলমন্ত্রী মিস্টার হামাদি বললেন, এই নিষেধাজ্ঞার আমরা বিরোধিতা করছি এই কারণে যে, এতে যুক্তরাষ্ট্রের খুব একটা ক্ষতি হবে না। এতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোই বেশি ভুগবে। যদি সত্যি সত্যি আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে একটা জবাব দিতে চাই, আমাদের উচিত তাদের সব তেল কোম্পানি জাতীয়করণ করা। কিন্তু ইরাকের এই প্রস্তাব অন্যদেশগুলো গ্রহণ করলো না।’
ডক্টর চালাবি বলেন, তেল নিষেধাজ্ঞার পক্ষে সৌদি আরব এবং কুয়েতের নেতৃত্বে জোরালো সমর্থন দেখা গেল।
তবে ডক্টর চালাবি ব্যক্তিগতভাবে এরকম নিষেধাজ্ঞার বিরোধী ছিলেন জানিয়ে বলেন, ‘আমি এর বিরুদ্ধে ছিলাম। কিন্তু এটি ছিল খুব স্পর্শকাতর একটি রাজনৈতিক বিষয়। কাজেই যখন আমি আমার মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলাম, তখন আমাকে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি ইরাকের বাথ পার্টির সদস্য ছিলাম না, কাজেই আমার অবস্থান ছিল খুব নাজুক। কিন্তু তারপরও আমি ঝুঁকি নিলাম এবং আমার মন্ত্রীকে বললাম- এটা পুরো বিশ্বের তেল শিল্পে একটা অস্থিরতা তৈরি করবে। যথারীতি আমার মন্ত্রী কিছু্ই বললেন না।’
ইরাক ছাড়া ওপেকের বাকি সব আরব সদস্য যুক্তরাষ্ট্র এবং নেদারল্যান্ডসে তেলের সরবরাহ বন্ধ করে দিতে রাজি হলো। দিনে দিনে এই নিষেধাজ্ঞা আরো কঠোর করা হলো। এর আওতায় আসলো পর্তুগাল এবং দক্ষিণ আফ্রিকাও।
এসব কিছুর ফলে তেলের দাম বেড়ে গেলো চার গুণ, কোনো কোনো দেশে তারও বেশি। পশ্চিমা দেশগুলোতে তেলের তীব্র সংকট দেখা দিল। পেট্রোল পাম্পগুলোতে তেলের জন্য দীর্ঘ লাইন। তেল রেশনিং করা শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রে এমনকি ঘণ্টায় ৫৫ মাইলের বেশি গতিতে গাড়ী চালানোর ওপর পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলো।
এবারে সত্যি সত্যি পানির দরে তেল কেনার যুগের অবসান ঘটলো। সৌদি আরবের তেলমন্ত্রী শেখ আহমেদ জাকি ইয়ামানি বললেন, ইসরাইল যদি সব আরব ভূমি থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়, তবেই কেবল এই নিষেধাজ্ঞা তোলা হবে তার আগে নয়। তারপরেই কেবল বিশ্ব ১৭ অক্টোবরের আগের দরে তেল পাওয়ার আশা করতে পারে।
বিশ্বে এই প্রথম এক শক্তিশালী জোট হিসেবে আবির্ভূত হলো তেলরফতানিকারী আরব দেশগুলো। সৌদি তেলমন্ত্রী শেখ আহমেদ জাকি ইয়ামানি হয়ে উঠলেন তাদের মুখপাত্র।
তিনি ঘোষণা করলেন, ‘আমাদের নীতি হচ্ছে, আমরা তেলের দাম বাড়াবো, তবে সেটা যুক্তিসঙ্গত হারে।’
একজন সাংবাদিক তাকে বলেন, যদি তেলের মূল্য ব্যারেল প্রতি ১০ ডলার করা হয়, তাতে পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়বে, তাদের শত কোটি ডলারের ক্ষতি গুনতে হবে। ইউরোপীয় দেশগুলোর অর্থনীতিতে এর কি প্রভাব পড়বে সেটা কি তিনি ভেবে দেখেছেন?
জবাবে শেখ আহমেদ জাকি ইয়ামানি বললেন, ‘তাহলে আপনার পরামর্শটা কী? আমাদেরকে কি আপনি আমাদেরকে বাজার মূল্যের চেয়ে কমে তেল বিক্রি করতে বলছেন? আপনি নিশ্চয়ই আমাদেরকে তা করতে বলছেন না। সেটাই আমি ধরে নেব। আর আপনি যদি এই সংকট নিয়ে আমাদেরকে ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে বলেন, সেজন্য আমরা প্রস্তুত আছি।’
হঠাৎ করে তেলের এই উচ্চ মূল্যে নাটকীয়ভাবে বিশ্বে ক্ষমতার ভারসাম্যে একটা পরিবর্তন নিয়ে আসলো। শিল্পোন্নত পশ্চিমা বিশ্ব এতদিন যে একচ্ছত্র ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব দেখিয়ে এসেছে, তাদের জন্য এ ছিল এক বিরাট ধাক্কা।
এই তেল নিষেধাজ্ঞা বজায় ছিল ১৯৭৪ সালের শুরু পর্যন্ত। কিন্তু ওপেক তেলের দাম বাড়িয়েই চললো এবং তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো বিপুল সম্পদশালী হয়ে উঠলো।
কিন্তু ডক্টর চালাবি মনে করেন, তেলের এই উচ্চ মূল্য আসলে শেষ পর্যন্ত ওপেকের জন্য ভালো হয়নি। এটা শেষ পর্যন্ত পশ্চিমা তেল কোম্পানিগুলোর স্বার্থের পক্ষেই গেছে। কারণ তারা বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে তেলের নতুন উৎস খুঁজছিল। তেলের উচ্চমূল্য এখন তাদের এই নতুন প্রকল্পগুলোকে লাভজনক করে তুললো।
তিনি বলেন, ‘তেলের এই উচ্চমূল্যের ফলে তেল কোম্পানিগুলো অন্যত্র তেলের সন্ধান শুরু করলো। যেমন ধরুণ নর্থ সী-তে। বিশ্বের নানা জায়গায় তেলের অনুসন্ধান শুরু হলো। উত্তর আফ্রিকায়, ল্যাটিন আমেরিকায়, যুক্তরাষ্ট্রে।’
ডক্টর চালাবি বলেন, ‘আমি বলেছিলাম- তেলের উচ্চমূল্য থেকে তাৎক্ষিণভাবে হয়তো ওপেক দেশগুলো লাভবান হবে। কিন্তু এর পরিণামে পরবর্তীকালে বিশ্ববাজারের তেলের সরবরাহে ওপেকের গুরুত্ব কমে যাবে। শেষ পর্যন্ত কিন্তু সেটাই হয়েছে।’