কক্ষ পরিদর্শকের ষড়যন্ত্র : পুনঃনিরীক্ষায় ফেল করা শিক্ষার্থী পেল গোল্ডেন এ প্লাস

চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের অধিনে ২০১৮ সালের এসএসসি’র ফলাফলে ফেল করা এক শিক্ষার্থী পূণ:নিরীক্ষণ ফলাফলে জিপিএ-৫ পেয়ে চট্টগ্রাম বোর্ডের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। অপ্রত্যাশিত ফল পাওয়া ওই শিক্ষার্থীর নাম তাওরিন তাসনিয়া তাসফি। সে কক্সবাজারের চকরিয়া কোরক বিদ্যাপীঠ থেকে এবার (২০১৮ সালে) বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন।

তবে ওই শিক্ষার্থীর এ রকম চমকের পেছনে ঘটে গেলো অকল্পনীয় এক ঘটনা। এসএসসি’র সদ্য প্রকাশিত ফলাফলে পাশই করতে পারেনি তাসনিয়া। গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত পুনঃনিরীক্ষার ফলাফলে তাসনিয়ার জীবনের মোড় অন্যদিকে ঘুরে গেল। প্রত্যাশিত জিপিএ-৫ পেল সে।

তাসনিয়ার এই অর্জনকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিল শিক্ষক নামের কলঙ্ক সমাজের নিকৃষ্ট এক ব্যক্তি। অদম্য মেধাবীর অধিকারী তাসফি কিছুতেই ফেল করারটা মেনে নিতে পারেনি। কেন সে ফেল করল তার হিসাব কিছুতেই মেলাতে পারছিলেন না। জীবনের কোন পরিক্ষায় সে ফেল করেনি। প্রতিটি পরিক্ষায় প্রতিভার সাক্ষর রেখেছে। সর্বশেষ বোর্ডের দেয়া সুযোগের মধ্যে তাসফি ফল পূন:নিরীক্ষনের আবেদেন করেন। তবে, মেধাবী এ শিক্ষার্থীর রেজাল্ট পরিবর্তনে পুনঃনিরীক্ষায় আবেদনকারী অন্য দশজন শিক্ষার্থীর মতো নয়। একটু ভিন্ন।

শিক্ষাবোর্ড সূত্রে জানা গেছে কোন পরীক্ষক বা নিরীক্ষকের অনিচ্ছাকৃত ভুলের শিকার নয় তাসনিয়া। রীতিমতো জালিয়াতি করে এই শিক্ষার্থীকে ফেল করানোর চেষ্টা করছিল পরীক্ষা কেন্দ্রে তাসনিয়ার কক্ষে কর্তব্য পালন করা একজন কক্ষ পরিদর্শক। একটি বিষয়ে তাসনিয়ার পূরণকৃত বহুনির্বাচনী প্রশ্নের উত্তরপত্র (ওএমআর) ফেলে দিয়ে অন্য একটি ওএমআর নিজের হাতে পূরণ করে দেন তিনি। যেটিতে ৩০টির মধ্যে ভরাট করা হয় মাত্র ২০টি প্রশ্নের উত্তর। বেশকয়টি প্রশ্নের উত্তরে একাধিক বৃত্ত ভরাট করা। শিক্ষার্থীর হাতে পূরণ করা প্রকৃত ওএমআরটি সরিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে নতুন ওএমআরটি বোর্ডেও পাঠাতে সমর্থ হন তিনি। এতে সবকটি বিষয়ে ‘এ প্লাস’ পায় সে। তবে বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়টিতে ‘এফ’ (ফেল) আসে তাসনিয়ার। যা কোন ভাবেই বিশ্বাস হচ্ছিল না তাসনিয়াও তার বাবা স্কুল শিক্ষক মো. আমিনুল হকের। স্কুল শিক্ষকরাও বিষয়টি মানতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়ে শিক্ষাবোর্ডের দ্বারস্থ হন তাঁরা।

তাসনিয়ার নম্বর ফর্দে দেখা যায় সবকয়টি বিষয়েই ‘এ প্লাস’ রয়েছে তাসনিয়ার। প্রাপ্ত নম্বর গড়ে ৯০ এর কম নয়। কিন্তু বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়ে তার মোট প্রাপ্ত নম্বর ৭৪। বিষয়টির রচনামূলক অংশের মোট ৭০ নম্বরের মধ্যে ৬৬ পেয়েছে সে। কিন্তু ৩০ নম্বরের বহুনির্বাচনী অংশে তার প্রাপ্ত নম্বর মাত্র ৮! বহুনির্বাচনী অংশে এই নম্বর দেখে তাসনিয়া তো বটেই, তার পরিবার ও স্কুল শিক্ষক সকলের চোখই যেন কপালে।

নিশ্চয়ই কোথাও কোন ভুল হয়েছে। শিক্ষাবোর্ড কর্মকর্তাদের কাছেও বিষয়টি অস্বাভাবিক ঠেকে। অডিট অফিসার মৃনাল কান্তি নাথকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মাহবুব হাসান। কমিটির অন্য দুই সদস্য ছিলেন সহকারি সচিব মো. সাইফুদ্দিন ও মূল্যায়ন কর্মকর্তা ড. শুক্লা রক্ষিত। ১৪ মে কমিটি গঠনের পর সরেজমিন পরিদর্শন ও সংশ্লিষ্ট সকলের সাক্ষ্য গ্রহন করে কমিটি। তদন্তের পর গত ৩০ মে কমিটি এ নিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন। এ ঘটনায় তাসনিয়ার পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করা শিক্ষক কাইছার লিটনের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। তাসনিয়া যে কক্ষে পরীক্ষায় অংশ নেয়, সেখানে কক্ষ পরিদর্শক হিসেবে কর্তব্য পালন করছিলেন ওই শিক্ষক। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন তদন্ত কমিটির সদস্য, শিক্ষাবোর্ডের সহকারি সচিব মো. সাইফুদ্দিন।

তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায় চকরিয়া কোরক বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থী তাসনিয়ার চকরিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের ২১ নং কক্ষে আসন পড়ে। পরীক্ষা শুরুর প্রথম দিন অপর এক শিক্ষকের মাধ্যমে তাসনিয়ার সাথে পরিচিত হোন শিক্ষক কাইছার লিটন। তিনি সাহারবিল বিএমএস উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। পরীক্ষার দ্বিতীয় দিন (বাংলা ২য় পত্র) পাশের একটি কক্ষে দায়িত্ব পালন করলেও বহুনির্বাচনী অংশের পরীক্ষার সময় তাসনিয়ার কক্ষে এসে কিছুক্ষন পর পর বহুনির্বাচনী (এমসিকিউ) কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর জানতে চান কাইছার লিটন। এভাবে চারটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে এর থেকে তিনটি উত্তর জানায় তাসনিয়া। উত্তরগুলো নিয়ে অন্য কক্ষের অপর এক ছাত্রীকে বলে দিচ্ছিলেন ওই শিক্ষক। ওই শিক্ষকের বারংবার এমন আচরণে বিরক্তি প্রকাশ করে তাসনিয়া। এ নিয়ে টুকটাক বাকবিতন্ডাও হয় দুজনের মাঝে। পরের পরীক্ষাগুলোতে কর্তব্য অন্য কক্ষ হলেও প্রায় সময়ই তাসনিয়ার কক্ষে আসতেন শিক্ষক কাইছার লিটন। তবে বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বিষয়ের পরীক্ষার দিন তাসনিয়ার কক্ষেই দায়িত্ব পড়ে কাইছার লিটনের। ওই দিন পরীক্ষার শেষ মুহুর্তে তাসনিয়ার খাতা নিয়ে ওই শিক্ষক এক প্রকার টানাটানি করেন বলে অভিযোগ তাসনিয়ার। এর ভিত্তিতেই বিষয়টির এমন ফলাফলে সন্দেহ জাগে বলে জানায় তাসনিয়া।

তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য মতে বিষয়টিতে তাসনিয়ার বহুনির্বাচনী অংশের ওএমআর সিরিয়াল নম্বর ছিল ১৭০০৭৮৩৩৯। স্বাক্ষরপত্রেও (অ্যাটেন্ডেন্সশীট) এই সিরিয়াল নম্বরটি লিখে তাসনিয়া। কিন্তু বোর্ডে পাঠানো ওএমআরটির সিরিয়াল নম্বর দেখা যায় ১৭০০৭৮২৩৪। আর তাসনিয়ার স্বাক্ষরপত্রে প্রকৃত সিরিয়াল নম্বরের শেষের তিনটি সংখ্যা (৩৩৯) কেটে এর উপরে ২৩৪ লিখে দেয়া হয়। ওই দিন তাসনিয়ার কক্ষে দুইজন শিক্ষক দায়িত্বে ছিলেন। একজন কাইছার লিটন। অপর জন মো. আশরাফুল ইসলাম। তাসনিয়ার মূল ওএমআর–শীটে স্বাক্ষর ছিল আশরাফুল ইসলামের। কিন্তু বোর্ডে পাঠানো ওএমআর শীটটিতে স্বাক্ষর পাওয়া যায় কাইছার লিটনের। বিস্তারিত তদন্ত শেষে তাসনিয়ার মূল ওএমআর খুঁজে বের করতে সক্ষম হয় তদন্ত কমিটি। এতে দেখা যায়– ৩০টি বহুনির্বাচনী প্রশ্নের মধ্যে ২৯টি সঠিক উত্তর দিয়েছে তাসনিয়া। এখন মোট ১ হাজার ৩০০ নম্বরের মধ্যে সব মিলিয়ে তার প্রাপ্ত নম্বর ১২১৩। এই মেধাবী শিক্ষার্থীকে জালিয়াতির মাধ্যমে ফেল করানোর ঘটনায় শিক্ষক কাইছার লিটনের জড়িত থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে তদন্ত কমিটি। প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে এ জালিয়াতিতে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন কাইছার লিটন। এ তথ্য নিশ্চিত করে তদন্ত কমিটির সদস্য মো. সাইফুদ্দিন বলেন, তাসনিয়ার মূল ওএমআরটি সরিয়ে ফেলে জালিয়াতির মাধ্যমে নতুন করে আরেকটি ওএমআর দিয়ে দেয়া হয়। নতুন এই ওএমআর শীটে হাতের লেখাগুলো কাইছার লিটনের। অর্থাৎ তিনিই এ কাজ করেছেন। প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে তিনি তা স্বীকার করেছেন। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে কয়েক দফা চেষ্টা করে কাইছার লিটনের মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।

এঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে তাসনিয়ার বাবা মো. আমিনুল হক বলেন– আমি একজন স্কুল শিক্ষক। একজন শিক্ষক হয়ে একজন ছাত্রীর প্রতি এমন আচরণ কোন ভাবেই মানা যায় না। তিনি পরীক্ষা কক্ষে আমার মেয়ের কাছ থেকে উত্তর জেনে নিয়ে অন্যদের বলে দিতেন। বারবার এ কাজ করলে এ নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু পরীক্ষার হলে এভাবে বিরক্ত করা তো নীতি বিরুদ্ধ। কোন ছাত্রছাত্রী যাতে এ ধরণের প্রতিহিংসার শিকার না হয়, শিক্ষাবোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সে দিকে নজর দেয়ারও অনুরোধ জানান এই অভিভাবক।

প্রথমবার ফলাফল প্রকাশের পর ফেল করার খবর শুনে খুব খারাপ লাগে জানিয়ে তাসনিয়া বলে আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। কারণ, এধরণের হওয়ার কথা নয়।

তবে একটু দেরিতে হলেও প্রত্যাশিত ফলাফল পেয়ে এখন ভালো লাগছে। ভবিষ্যতে ডাক্তার কিংবা বিসিএস ক্যাডার হয়ে মানুষের সেবা করার স্বপ্নের কথাও জানায় তাসনিয়া।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মাহবুব হাসান বলেন– কমিটি তদন্ত করে এ ঘটনায় শিক্ষক কাইছার লিটনের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও পরীক্ষা কেন্দ্রটির পরীক্ষা কমিটির বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়েছে ।