খেলাপি ঋণ ছাড়িয়েছে সাড়ে ৮৮ হাজার কোটি টাকা

নানা উদ্যোগেও খেলাপি ঋণের লাগাম কোনোভাবেই টানতে পারছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ৭৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে (মার্চ-১৮ প্রান্তিক) এ তথ্য জানা গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আট লাখ ২২ হাজার ১৩৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা, যা গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। অর্থাৎ তিন মাসের (জানুয়ারি-মার্চ) ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৪ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ দিচ্ছে সরকারি ব্যাংকগুলো। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকরা নিজেদের মধ্যে ঋণ আদান-প্রদান করছেন। এ ছাড়া ঋণ বিতরণে অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতি করা হচ্ছে। যাচাই-বাছাই না করেই দেয়া হচ্ছে ঋণ। বিশেষ সুবিধায় পুনর্গঠন করা ঋণ আবার খেলাপি হচ্ছে। ফলে লাগামহীনভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এতে জনগণের আমানত গ্রহণ করলেও তার সুরক্ষা দিতে পারছে না ব্যাংক। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে ব্যাংকিং খাত ভয়াবহ রূপ নেবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ দেয়া হচ্ছে। বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনর্গঠন করা খেলাপিরা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করছে না। ফলে খেলাপি বাড়ছে।

তিনি বলেন, একদিকে ব্যাংকগুলো সঠিক নিয়মে যাচাই-বাছাই না করেই বেশি মুনাফার আশায় ঋণ দিচ্ছে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না। ঋণের টাকা ফেরত না দিলে কোনো শাস্তি হচ্ছে না। আর এখন পর্যন্ত অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কারও দৃশ্যমান শাস্তি হয়নি।

সাবেক এ গভর্নর বলেন, খেলাপি ঋণের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্ত হতে হবে। পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপকদের জবাবদিহিতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোকে সময়োচিত ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে।

প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ বেড়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে। এর পরিমাণ সাত হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। এর পরেই রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। এ খাতের ছয় ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ছয় হাজার ৩৫৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। বিদেশি ৯ ব্যাংকের বেড়েছে ৩৪ কোটি টাকা। তবে গত তিন মাসে বিশেষায়িত দুই ব্যাংকে নতুন করে খেলাপি ঋণ বাড়েনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ-১৮ শেষে রাষ্ট্রীয় খাতের সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে এক লাখ ৪৬ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২৯ দশমিক ৮৪ শতাংশ। তিন মাস আগে অর্থাৎ ডিসেম্বর-১৭ শেষে ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৩৭ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা বা ২৬ দশমিক ৫২ শতাংশ।

এ ছাড়া মার্চ শেষে বেসরকারি ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে ছয় লাখ ২১ হাজার ২৯০ কোটি টাকা। এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৬ শতাংশ। তিন মাস আগে এ খাতের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ২৯ হাজার ৩৯৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা।

মার্চ শেষে বিদেশি ৯ ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে ৩১ হাজার ২২৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে দুই হাজার ১৮৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা, যা এসব ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। এ ছাড়া সরকারি মালিকানাধীন বিশেষায়িত দুটি ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ১৯৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এর বিপরীতে খেলাপি হয়েছে পাঁচ হাজার ৪২৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা বা ২৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

এদিকে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে যথাযথ ও দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। ব্যবসায়ীরা ব্যাংকগুলোকে প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণ এবং সামগ্রিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার ভিত্তি আরও মজবুত করার ওপর গুরুত্ব দেন। তারা ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী ও সময়োপযোগী করা ও ব্যাংক খাতের বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে বলেন।

খেলাপি ঋণ প্রসঙ্গে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, খেলাপি ঋণ ব্যাংকিং খাতে বড় সমস্যা সৃষ্টি করছে। যেভাবেই হোক খেলাপি ঋণ একটি নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বিশেষ উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

ঋণ দেয়ার সময় সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়ে ব্যবসায়ী এ নেতা বলেন, ব্যাংকগুলোকে বেশি সতর্ক হতে হবে। যে ঋণ দেয়া হচ্ছে এটি আদায় হবে কি না তা নিশ্চিত হতে হবে। এ ছাড়া ছোট ঋণ দেয়ার সময় যেসব নিয়ম মানা হয় বড় ঋণের ক্ষেত্রেও সেসব বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। ছোট ঋণ খেলাপি কম হয়, তাই বড় ঋণ না দিয়ে এসএমই বা ক্ষুদ্র ঋণ বাড়ানো ওপর জোর দেন তিনি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঝুঁকি জেনেও বড় ঋণে ঝুঁকছে ব্যাংকগুলো। গত কয়েক বছর ধরে এ প্রবণতা আরও বেড়েছে। ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের ৫৭ শতাংশ বড় ঋণে চলে গেছে। ফলে বাড়ছে খেলাপি ঋণ।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক বছর ধরে বড় ঋণের দিকে বেশি ঝুঁকছে ব্যাংকগুলো। সর্বশেষ হিসাবে, মোট ঋণের প্রায় সাড়ে ৫৭ শতাংশ বড় ঋণ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ৪০ শতাংশ, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ৬৫ শতাংশ, বিশেষায়িত ব্যাংকের ৪৭ শতাংশ এবং বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ৭৩ শতাংশ বড় ঋণ হিসাবে বিতরণ করা হয়েছে।

২০১৬ সালে ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ৫৮ শতাংশ ছিল বড় ঋণ, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির পথে বাধা।