পাহাড়ে ফের ভূমিধসের শঙ্কা, ঝুঁকিতে ৩ লাখ মানুষ

কক্সবাজার বন বিভাগের ৯ হাজার ৬৫৭ হেক্টর বনভূমি অবৈধ দখলে রয়েছে। সরকারি এসব জমি দখল করে বসবাস করছে প্রায় ১০ লাখ মানুষ। এর মধ্যে প্রায় ৩ লাখ মানুষ পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম আসলেই কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করা এসব লোকজনকে অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেন। মাইকিং করে সতর্কমূলক প্রচারণা চালান। পরে আবার এসে আগের জায়গায় বসবাস শুরু করে। গত দুদিনে রাঙামাটি, বান্দরবান, চট্টগ্রাম ও টেকনাফে পাহাড় ধসে শতাধিক মানুষের হতাহতের ঘটনায় এ বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে।

কক্সবাজার বন বিভাগের সূত্র জানায়, জেলায় মোট বনভূমির পরিমাণ ৭৩ হাজার ৩৫৮ হেক্টর। এরমধ্যে অবৈধ দখলে রয়েছে ৯ হাজার ৬৫৭ হেক্টর বনভূমি। এর মধ্যে পাহাড়ি জমিতেই বসবাস করছে ১৩ হাজার ৮২৬টি পরিবারের তিন লাখ মানুষ। জেলার মোট জনসংখ্যা ২৩ লাখ।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পাহাড় ধসে গত ১০ বছরে ৬ সেনা সদস্যসহ ৩ শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৮ সালের ৪ ও ৬ জুলাই টেকনাফে ফকিরা মুরা ও টুন্যার পাহাড় ধসের একই পরিবারের চারজনসহ ১৩ জন, ২০১২ সালে ২৬ ও ২৭ জুন পাহাড় ধসের ঘটনায় ২৯ জন, ২০০৯ সালে চকরিয়া, উখিয়া ও রামুতে ৫ জন, ২০১০ সালের ১৫ জুন রামু উপজেলার হিমছড়ি এলাকার ১৭ ইসিবি সেনা ক্যাম্পের ৬ জন সেনা সদস্যসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে মারা যায় প্রায় ৬২ জন প্রাণ হারায়। ২০১১-২০১৩ সালে পাহাড় ধসে মৃত্যু হয়েছে ১৯ জন, ২০১৫ সালে কক্সবাজার শহরের রাডারের পাহাড় ধসে মা-মেয়ে সহ ৫ জন এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালে পাহাড় ধসে মারা যায় ১৭ জন মারা যায়।

পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি স্থাপন ও পাহাড় কাটার কারণে মৃত্যু তালিকা লম্বা হলেও পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস বন্ধ করা যাচ্ছে না।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কক্সবাজার শহর ও আশপাশের এলাকায় নানা কৌশলে চলছে পাহাড় কাটা। পাহাড় কেটে এসব এলাকায় গড়ে তোলা হচ্ছে বসতি। কক্সবাজার শহরের ঘোনার পাড়া, মোহাজের পাড়া, বৈদ্যঘোনা, বইল্যাপাড়া, জাদি পাহাড়, খাজা মঞ্জিল এলাকা, বাদশাঘোনা, ফাতেরঘোনা, ইসলামপুর, হালিমা পাড়া, লাইট হাউজ পাড়া, সার্কিট হাউজ সংলগ্ন এলাকা, আবু উকিলের ঘোনা, রহমানিয়া মাদ্রাসা এলাকা, পাহাড়তলী, বাঁচা মিয়ারঘোনা, হাশেমিয়া মাদ্রাসার পেছনে, সাহিত্যিকা পল্লী, বিডিআর ক্যাম্পের পেছনে, লারপাড়া, সদর উপজেলা কার্যালয়ের পেছনে, পাওয়ার হাউস, লিংকরোড, কলাতলী বাইপাস সড়কের দুই পাশের বিশাল পাহাড়ি এলাকা, হিমছড়িসহ জেলা শহরের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় পাহাড় কাটা চলছে। এছাড়া কক্সবাজার জেলার উখিয়া, টেকনাফ, রামু, সদর উপজেলা, চকরিয়া, পেকুয়া ও মহেশখালীর বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হচ্ছে অবৈধ বসতি। এসব বসতিরা রয়েছে চরম ঝুঁকিতে।

জেলার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. আলী কবির বলেন, ‘কক্সবাজারের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করা প্রায় ৩ লাখ মানুষ রয়েছে পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে। এ কারণে জেলা প্রাশসকের সঙ্গে আলাপ করে পাহাড়ে বসবাসকারীদের পুনর্বাসন করার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে পাহাড়ে বসবাসকারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি জন্য নানা কার্যক্রম চলছে। বিভিন্ন স্থানে উচ্ছেদ অভিযানও চলছে। এটা অব্যাহত থাকবে।’

কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতরের উপ-পরিচালক সরদার সরিফুল ইসলাম বলেন, ‘পাহাড় কাটা রোধে অভিযান ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি চলমান রয়েছে। প্রতিদিনই কোনও না কোনও এলাকায় অভিযান চালানো হচ্ছে। পাহাড় খেকোদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আইনে মামলা হচ্ছে।’

তবে, জনবল সংকটের কারণে অভিযান একটু ব্যাহত হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন জানান, পাহাড়ে অবৈধ বসতি ও পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন, বনবিভাগ, পরিবেশ অধিদফতর, বিজিবি ও পুলিশের সমন্বয়ে যৌথ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এছাড়া অবৈধ বসতি ও পাহাড় কাটার বিষয়ে জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন মাইকিং করা হচ্ছে।

পাহাড়ে ফের ভূমিধসের শঙ্কা

দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারি অবস্থায় থাকায় আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, এর প্রভাবে বুধবার থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে। ফলে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ফের ভূমিধসের সম্ভাবনা রয়েছে।

এছাড়া উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকায় গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা সৃষ্টি হওয়ায় দেশের সব সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, উত্তর বঙ্গোপসাগরে গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা সৃষ্টি হওয়ায় দেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্র বন্দরসমূহের ওপর দিয়ে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। এ কারণে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।