খাগড়াছড়িতে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ, লকডাউন নিশ্চিত করতে মাঠে প্রশাসন

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় করোনা সংক্রমণ রোধে সরকার ঘোষিত কঠোর লকডাউন পালন নিশ্চিত করতে মাঠে নেমেছে প্রশাসন। গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার(১/২লা জুলাই) থেকে দেশব্যাপী সর্বাত্মক কঠোর লকডাউন ঘোষণার প্রথম ও ২য় দিনে খাগড়াছড়িতে মাঠে সক্রিয় ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর খাগড়াছড়ি সদর সেনা জোন। একই সাথে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ, বিজিবি মাঠে নামে। তবে তা সত্বেও সাধারণ মানুষকে ঘরে রাখা যাচ্ছে না। নানা অজুহাতে মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে। সকাল থেকে খাগড়াছড়ি শহরের বেশ কিছু দোকানপাট খোলা রাখতে দেখা গেছে। শহরে চলছে টমটম ও রিক্সা।

সকাল থেকে সরকারের নির্দেশনায় লকডাউন সফল করতে গণপরিবহণ, দোকানপাট বন্ধ রাখা ও অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের না হওয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ মাস্ক পরিধানে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করছে প্রশাসন। এ সময় জনগণকে সচেতন করতে নির্দেশনা ও আইন অমান্যকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেন দায়িত্বরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা।

খাগড়াছড়ি সদর জোনের সেনাবাহিনীর টহল দল জেলা সদরে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট গুলোতে টহল জোরদার করে সক্রিয় ছিল মাঠে। একই সাথে সরকারী নির্দেশনা বাস্তবায়নে জনগণকে সচেতনতায় কাজ করেন।

খাগড়াছড়ি সদর জোনের ক্যাপ্টেন মো: ফাহিম ফয়সাল সামিন জানান, সরকার ঘোষিত লকডাউন পালন নিশ্চিত করতে মাঠে কাজ করছে সেনাবাহিনী। তিনি জানান, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের না হওয়া,গণপরিবহণ চলাচল বন্ধ, ঘোষিত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী নির্দেশনা বাস্তবায়নে সেনাবাহিনী কাজ করছে। সে সাথে সকলকে সচেতন হওয়ার উপর গুরুত্বারোপ করে ঘর থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রশান্ত চক্রবর্তী, মো: সাজজাদ হোসেন এবং মো: আশরাফ আলী জানান, করোনা সংক্রমণ রোধে জনগণের সহযোগিতায় লকডাউনের নির্দেশনা যেন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় এবং জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে যেন করোনা সংক্রমণ রোধ করা যায় সে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

একই সাথে প্রয়োজন ছাড়া কেউ যেন ঘর থেকে বের না হয় ঘুরাঘুরি না করে। বিশেষ প্রয়োজন ঘর থেকে বের হলে যেন অবশ্যই মাস্ক পরিধান করে সে বিষয়ে কাজ করছে বলে তিনি জানান। যারা আইন অমান্য করবে প্রশাসন তাদের জরিমানা ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে মাঠে কাজ করছে বলে জানান।

খাগড়াছড়ি সদর ট্রাফিক বিভাগের পুলিশ সার্জেন্ট ফারুক হোসেন জানান, সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নে মাঠে কাজ করছে ট্রাফিক বিভাগ। হাসপাতালে যাওয়া রোগী ও কাঁচামাল নিয়ে যারা আসছে তাদের ছাড় দেওয়া হচ্ছে। অন্যান্য সব গাড়ি বন্ধ রাখা হচ্ছে জানিয়ে তিনি করোনায় সরকারী নির্দেশনা অমান্যকারীদের ছাড় দেওয়া হবে বলে তিনি জানান। শুক্রবার সকাল থেকে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, চলছে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচার মাইক ও একাধিক মোবাইল কোর্টের গাড়ি টহল দিতেও দেখা গেছে। বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক বড় বাজারের দিন হলেও জনসাধারণের উপস্থিতির হার তেমন ছিলোনা, মাছের বাজার ও কাঁচা বাজার মার্কেটে লোকজনের উপস্থিতি থাকলেও মাস্ক ছিলো সবার কিন্তু প্রচন্ড ভীড় থাকায় স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি।

খাগড়াছড়ির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো: সাজ্জাদ হোসেন বলেন, বৃহস্পতিবার খাগড়াছড়ির প্রধান হাটের দিন হওয়ায় প্রশাসন কিছুটা ছাড় দিচ্ছে। মানুষকে বুঝানো হচ্ছে। পরের দিন শুক্রুবার থেকে প্রশাসন কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে।

শপিংমল/মার্কেট ও দোকান-পাট বন্ধ সহ গন-পরিবহন সম্পুর্ন বন্ধ রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা ও জরুরি পরিসেবা, কৃষি পণ্য ও উপকরণ(সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি) খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহণ, স্বাস্থ্য সেবা, বিদ্যুৎ,গণমাধ্যম(প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া), ব্যাংক, ফার্মেসি অন্যান্য জরুরি/অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ সকল যানবাহন প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় পত্র প্রদর্শন সাপেক্ষে যাতায়াত করতে দেখা গেছে।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, লক-ডাউন পালনে আমাদের পক্ষ থেকে প্রশাসন সতর্কবস্থানে, এছাড়াও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গাড়িতে গাড়িতে প্রচার পত্র বিলি, মাইকিং করে শহর থেকে গ্রামের জনগনকে সরকার ঘোষিত সকল প্রকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বেড় না হয়ে ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে। সদর উপজেলাসহ আরো ৮টি উপজেলাতে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি মোবাইল কোর্ট মাঠে থাকবে।

অন্যদিকে খাগড়াছড়িতে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে করোনার সংক্রমণ। প্রতিদিন আধুনিক জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গুলোতে বাড়ছে নমুনা সংগ্রহের হার।

শুক্রুবার(২রা জুলাই) খাগড়াছড়িতে প্রাপ্ত ফলাফলের ৪৮জনের নমুনায় মিলেছে করোনা পজেটিভ। এ নিয়ে জেলায় মোট আক্রান্ত দাঁড়িয়েছে ১হাজার ২শত ৪৭জনে। খাগড়াছড়ি আধুনিক সদর হাসপাতালের আইসোলেশন সেন্টারের নারী ও পুরুষ ওয়ার্ডে ২৮জন ভর্তি রয়েছে। তাদের মধ্যে ১৪জন পজেটিভ ও ১৪জন সন্দেহজনক।

খাগড়াছড়ির সিভিল সার্জন ডা: নুপুর কান্তি দাশ জানান, জেলায় গত ২৪ঘন্টায় র‌্যাপিড এবং আরটি-পিসিআর টেস্টে ১৪৩জনের নমুনায় ৪৮জনের পজেটিভ শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে চলতি মাসে ৩৬দশমিক ৫৫শতাংশে দাড়িঁয়েছে করোনা শনাক্তের হার।

রামগড় উপজেলা:
খাগড়াছড়ির রামগড়ে কড়াকড়ি লকডাউন চলছে। বিধিনিষেধ অমান্য করায় ১১ব্যক্তিকে আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অর্থদন্ড করা হয়েছে। সকাল হতে মুদি দোকান, ওষুধের ফার্মেসি ও কাঁচামালের দোকান ছাড়া বাকি সব দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পৌর এলাকায় অভিযানে রয়েছেন। রাস্তায় বের হলেই পুলিশের জেরার মুখে পরতে হচ্ছে মানুষকে। কোলাহলময় শহর এখন নিরব নিস্তব্ধ। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছে কম মানুষই। নেই টমটম, সিএনজি অটোরিক্সার দাপুটেরূপ। পৌর এলাকাজুড়ে করোনা সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রচার প্রচারনা অব্যাহত রেখেছে তথ্য অফিস। বৃহস্পতিবার(১লঅ জুলাই) সকালে রামগড় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মু. মাহমুদ উল্লাহ মারুফের নেতৃত্বে লকডাউন কঠোরভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রামগড় বাজার, সোনাইপুল বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করেন। এসময় সরকারি নির্দেশনা অমান্য করার দায়ে বিভিন্ন স্থান থেকে ১১জনকে আটক করা হয়েছে। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে আটককৃতদের বিভিন্ন হারে জরিমানা আদায করে ছেড়ে দেয়া হয় বলে জানান রামগড় থানার ওসি মুহাম্মদ শামসুজ্জামান।

এদিকে ভোর থেকেই জনসমাগম ঠেকাতে ও জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে বিপুল সংখ্যক পুলিশ তৎপর রয়েছে। বাহিরের এলাকা হতে রামগড়ে প্রবেশরোধে বিভিন্ন প্রবেশ পথে পুলিশের বিশেষ চৌকি বসানো হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযানে সহকারী কমিশনার(ভূমি) শিরিন আকতার, রামগড় সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হোসাইন মো: রায়হান কাজেমী পিপিএম(সেবা), রামগড় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা(ওসি) মুহাম্মদ শামসুজ্জামানসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা মাঠে রয়েছেন।

লকডাউন সর্বাত্মকভাবে বাস্তবায়নের জন্য বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে তার সভাপতিত্বে এক বিশেষ জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। মিটিং শেষে সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ে ইউএনও মু. মাহমুদ উল্লাহ মারুফ সাংবাদিকদের বলেন, বৈশ্বিক করোনা মহামারির সংক্রমনরোধে সরকারের ঘোষিত চলমান লকডাউন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। বিধিনিষেধ অমান্য করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে। এ ক্ষেত্রে কঠোর ভুমিকায় থাকবে প্রশাসন। এ ব্যাপারে সর্বস্তরের জনসাধারণের কাছে সহযোগিতা কামনা করেছেন তিনি।

মাটিরাঙা উপজেলা :

প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাসের সংক্রমন রোধে সরকারের সিদ্ধান্ত ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মাটিরাঙ্গায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের না হওয়া, শতভাগ মাস্ক পরিধান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ভ্রম্যমান আদালত পরিচালনা করেছেন মাটিরাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার(অ.দা) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মিজ ফারাজানা আক্তার ববি। বৃহস্পতিবার(১লা জুলাই) বিকালের দিকে অপ্রয়োজনে বাহিরে ঘোরাফেরা এবং মাস্ক পরিধান না করায় ভ্রাম্যমান আদালতে দন্ডবিধি আইনের ১৮৮ধারায় নয় জনকে পাঁচ হাজার ছয় শত টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমান আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও মাটিরাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার(অ.দা) মিজ ফারাজানা আক্তার ববি।

এসময় মাটিরাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ(ওসি) মুহাম্মদ আলী, মাটিরাঙ্গা উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও বাজার ব্যবসায়ী কমিটির সভাপতি এম হুমায়ুন মোরশেদ খান, মাটিরাঙ্গা পৌরসভার কাউন্সিলর মো: মিজানুর রহমান খোকন ও বাজার ব্যবসায়ী কমিটির সহ-সভাপতি মো: জসিম উদ্দিন ভুইয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

জনস্বার্থে এবং কোভিড-১৯ মোকাবেলায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অব্যাহত থাকবে জানিয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও মাটিরাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার(অ.দা) মিজ ফারাজানা আক্তার ববি বলেন, মাটিরাঙ্গার মানুষকে সুরক্ষিত রাখতে প্রশাসনের বিভিন্ন সেক্টর মাঠে কাজ করছে। তিনি বলেন, সচেতনতাই সবচেয়ে বড় সুরক্ষা।