খাগড়াছড়িসহ তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড় ধসের আশঙ্কা

খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলাতে অতিবৃষ্টি এবং লকডাউনের কারণে দুই বিপদের মুখোমুখি পাহাড়ে বসবাসরত পরিবারগুলো। এসব পরিবারের অনেকের হাতে নেই কোনো কাজ। বাড়িতে নেই খাবার। কোথাও যাবে?-এমন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী তাদের পাশে এসে দাঁড়ালেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছেন অনেক ভুক্তভোগী। থেমে থেমে বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় সাথারন মানুষের আতঙ্ক বাড়ছে। টানা অতি বর্ষণের আভাস, পাহাড় ধসের আশঙ্কা ভারী বৃষ্টি আতঙ্ক হয়ে উঠছে।

তবে সরকারিভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও জেলা প্রশাসন বিছিন্নভাবে ত্রাণ সরবরাহ করছে। কিন্তু যেভাবে পরিস্থিতি এগুচ্ছে তাতে সব মানুষের পাশে দাঁড়ানো সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে আশংকার কথা জানিয়েছেন অনেকে।

করোনার বর্তমান ঢেউ মোকাবিলায় টানা লকডাউন চলছে দেশে। গণপরিবহণ বন্ধ থাকায় বিপাকে পড়েছেন খাগড়াছড়ির পরিবহণ শ্রমিক ও দিনমজুররা। আয় না থাকায় দুর্বিষহ দিন পার করছেন জেলার প্রায় ৫হাজার শ্রমিক। গণপরিবহণ চালু হবে তাও জানেন না তারা। এ অবস্থায় অনিশ্চিত দিন কাটছে তাদের।

পরিবহণ শ্রমিক মোহাম্মদ হাসান আলী। তিনি খাগড়াছড়ির বিভিন্ন সড়কে ভাড়ায় বাইক চালিয়ে সংসার চালান। নিজের বাইক চালিয়ে যা আয় হয় তা দিয়ে কোনোরকম সংসার চলে। তিনি জানান, ‘ভাড়ার জন্য সকাল থেকে বসে আছি। যাত্রীর দেখা নেই। এক বেলা খাইলে অন্য বেলা উপোস থাকতে হয়। একই অবস্থা পরিবহণ শ্রমিক আব্দুল জলিলের। তিনি বলেন, ‘আমাদের জন্য সরকারকে কিছু করতে বলিয়েন।’
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় প্রায় এক হাজার ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল রয়েছে। যারা মোটরবাইকে যাত্রী পরিবহণ করে জীবন ও জীবিকা চালান। লকডাউনে বিপর্যস্ত তাদের জীবন।

একই অবস্থা সিএনজি অটোরিকশা চালকদের। জেলায় তাদের সংখ্যা প্রায় ৮শ। সিএনজি চালক মোহাম্মদ সুমন, হেলাল ও জমির জানান, ‘আমরা মূলত খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা সড়ক, খাগড়াছড়ি-সাজেক পর্যটন কেন্দ্রে ভাড়ায় সিএনজি চালাই। লকডাউনের আগে পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ করায় আমাদের আয় অর্ধেক হয়ে গেছে।

খাগড়াছড়ি সিএনজি মালিক সমিতির সভাপতি জিতেন বড়ুয়া বলেন, ‘জেলায় প্রায় ৮শ সিএনজি শ্রমিক রয়েছেন। আমাদের সমিতির অন্তর্ভুক্ত ৩শ। লকডাউনে চালকদের পাশাপাশি মালিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত। সিএনজিগুলোও বসে আছে। অনেক সিএনজির মালিক গাড়ির আয়ের ওপর নির্ভরশীল। ডকডাউনের কারণে তাও বন্ধ। চালকদের পাশাপাশি মালিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত। এভাবে দীর্ঘদিন চললে অনেকে পথে বসবে।’
খাগড়াছড়িতে প্রায় ২৯বছর ধরে চান্দের গাড়ি(জিপ) চালিয়ে সংসার চালান সুনীল দেবনাথ। নিজের গাড়িতে মালামাল ও যাত্রী পরিবহণ করে যা আয় হয় তা দিয়েই চলে সংসারে চাকা। গাড়ি বন্ধ থাকায় অলস সময় কাটছে তার। ধারদেনা করে দিন পার করছেন তিনি।

ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে প্রাপ্ত অনুদানের বড় একটি অংশ পরিবহণ শ্রমিকদের বিতরণ করেছে জেলা প্রশাসক। খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা বাস মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়ন, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা বাস মিনিবাস পরিবহণ শ্রমিক ইউনিয়ন, পার্বত্য যানবাহন মালিক কল্যাণ সমিতি, খাগড়াছড়ি সড়ক পরিবহণ জিপ মালিক সমিতি ও খাগড়াছড়ি হালকা মোটরযান মাইক্রো চালক সমিতিকে ছয় লাখ ৪৫হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে।

অতি ভারি বর্ষণের আভাস, পাহাড়ে বৃষ্টি আতঙ্ক:

খাগড়াছড়ি জেলা সদরের দয়ানগর এলাকার বাসিন্দা পলি আক্তার। স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে রাতে ঘুমাচ্ছিলেন। হঠাৎ আনুমানিক ২টার দিকে ঘরের পেছনে পাহাড় ধসে ঘর ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে। এসময় তারা দ্রæত ঘর থেকে বেরিয়ে রক্ষা পান। টানা বৃষ্টিতে একই এলাকার নুরুল ইসলাম, এডিসি হিল এলাকার আব্দুল মজিদসহ স্থানীয় অনেকের বসতঘর পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্ত।

গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে খাগড়াছড়ির নদ-নদীর পানি যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে পাহাড় ধসের আশঙ্কা। জেলা সদরের অনেক গ্রামীণ সড়কে পাহাড় ধসে পড়েছে। এতে আতঙ্কিত স্থানীয়রা। পাহাড়জুড়ে এমন শত শত পরিবার পাহাড় ধসের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন বছরের পর বছর। বিগত বছরগুলোতে পাহাড় ধসে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।

জেলা সদরের সবুজবাগ, শালবন, মোহাম্মদপুর, এডিসি হিল, কুমিল্লাটিলাসহ কয়েকটি এলাকা এবং জেলার মানিকছড়ি, দীঘিনালা, রামগড়, মহালছড়ি, ল²ীছড়ি উপজেলায় অনেকগুলো পাহাড়ি ও বাঙালি পরিবার পাহাড়ের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাস করছেন। বিশেষত জেলা সদরের শালবন, সবুজবাগ, কলাবাগান এলাকায় পাহাড়ের চূড়ায় বা পাদদেশে ঘরবাড়ি করে রয়েছেন ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে।

কিছু ভূমিহীন পরিবার বাধ্য হয়ে বসবাস করলেও অধিকাংশ পরিবার পাহাড় কেটে বসতি গড়ে তুলছেন। তারা বর্ষার শুরুতে পাহাড়ের ঢালুতে মাটি কেটে রাখেন। পরবর্তীসময়ে বৃষ্টি হলে পাহাড় ধসে পড়ে। এরপর সেখানে বসতি সম্প্রসারণ করেন। শহরের সবুজবাগ এলাকা পাহাড়বেষ্টিত হলেও বর্তমানে সেখানে পাহাড় কেটে কেটে বসতি নির্মাণ করা হয়েছে। অনেকে প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই পাহাড় কেটে ইট কংক্রিটের ঘর তুলছেন।

এদিকে জেলা শহরের শালবনে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের অধিকাংশই নিরীহ ও ভূমিহীন। যাদের অনেকে সরকার পুনর্বাসিত করলেও তারা নিজেদের ভূমি থেকে ১৯৮৬সালে বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে উচ্ছেদ হয়েছিলেন। ওসব পরিবারগুলোকে তৎকালীন প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে পুনর্বাসিত জমি থেকে তুলে এনে শালবনসহ বিভিন্ন উপজেলা সদরের আশপাশে বসানো হয়।
মধ্য শালবনের বাসিন্দা আব্দুল সালাম ক্ষোভের সঙ্গে জানান, পুনর্বাসন সূত্রে পাওয়া ৫একর ভূমি থেকে তুলে এনে এখানে(শালবন) বসানো হয়েছে। পাহাড় কেটে বসতি করা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। বাধ্য হয়েই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাসে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি।

খাগড়াছড়ি পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ আবু দাউদ জানান, একতো বালু পাহাড়, বৃষ্টি হলেই ধসে পড়ার ঝুঁকি থাকে। তাছাড়া কেউ জায়গা না থাকায় বাধ্য হয়ে পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণ করছে। এছাড়াও খাগড়াছড়ি জেলায় প্রভাবশালী ও ভূমিখেকোরাও অনেক পাহাড় দখল ও কাটায় জড়িত। খোদ জেলা শহরের সবুজবাগ, মোহাম্মদপুরসহ কয়েকটি এলাকায় বড় বড় পাহাড় কেটে বসতি গড়ে তুলেছেন। এক্ষত্রে প্রশাসনকে কঠোর ভূমিকা নিতে হবে।

প্রশাসনের তথ্যমতে, বর্তমানে জেলায় ৮৯৭টি পরিবার পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে খাগড়াছড়ি পৌর শহরের এই সংখ্যা প্রায় ২শ। ইতোমধ্যে স্থানীয় জেলা প্রশাসক, পুলিশ প্রশাসন ও পৌর প্রশাসন মিলে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা পরিদর্শন করেছেন। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় জেলায় পাঁচটি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুুত রাখা হয়েছে।

খাগড়াছড়ি পৌরসভার মেয়র নির্মলেন্দু চৌধুরী জানান, শহরে পাহাড়ের উপর বসবাস করে এমন ৯০টি পরিবারকে আমরা ঝুকিঁপূর্ণ বসতি হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছি। একই সঙ্গে ওই পাহাড়ের নিচে বসবাসরত পরিবারগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি হিসেবে গণ্য করছি। ইতোমধ্যে ৫টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুুত রাখা হয়েছে। ঝুঁকিতে থাকা পরিবারগুলোকে কিভাবে স্থায়ীভাবে অন্যত্র পুনর্বাসন করা যায় তা আমরা ভাবছি।

২০১১সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির(বেলা) করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে পরের বছর হাইকোর্ট খাগড়াছড়িসহ তিন পার্বত্য জেলা, চট্টগ্রাম মহানগর ও কক্সবাজার এলাকায় পাহাড় কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হলেও তা এত বছরেও কার্যকর করা হয়নি।

মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে দেশে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে। সেইসঙ্গে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলাসহ চট্টগ্রামে দেখা দিয়েছে পাহাড় ধসের আশঙ্কা। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার(১লা জুলাই) চট্টগ্রাম বিভাগে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে। শুক্রবারও(২রা জুলাই) হতে ভারি বর্ষণ হতে পারে।

আবহাওয়াবিদ এ কে এম রুহুল কুদ্দুছ জানান, সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে শুক্রবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও ভারি(৪৪-৮৮ মিলিমিটার) থেকে অতি ভারি(৮৯ মিলিমিটারের বেশি) বর্ষণ হতে পারে। ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণের প্রভাবে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসের আশঙ্কা রয়েছে।

এদিকে রামগড় পৌরসভার বৈদ্যটিলা এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনায় ৪-৫টি বসতবাড়ি কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই এলাকায় মারাত্মক ঝুঁকিরমুখে থাকা সাতটি পরিবারকে নিরাপদ স্থানে সরানোর কোন পদক্ষেপ নেয়নি প্রশাসন। প্রবল টানা বর্ষণে বৃহস্পতিবার(১লা জুলাই) গভীর রাতে পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের বৈদ্যটিলা এলাকায় বসতবাড়িতে এ পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এতে বসতঘরের ক্ষয়ক্ষতি হলেও কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রবল অবিরাম বর্ষণে বৃহস্পতিবার রাত দেড়টার দিকে বৈদ্যটিলায় হঠাৎ পাহাড়ের একাংশ ধসে পড়লে পাদদেশে থাকা মো: হানিফ নামে এক ব্যক্তির বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টিনের তৈরি ঘরের একাংশ মাটিতে চাপা পড়ে। এ সময় ঘরের লোকজন সজাগ থাকায় তাদের কোন ক্ষতি হয়নি। একই সময় হানিফের পার্শ্ববর্তী বানু বেগম, বেলাল, আলা উদ্দিন, সখিনা বেগমের ঘরসহ ৬-৭টি কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

রামগড় পৌরসভার ৪-৫-৬নং সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলর কনিকা বড়ুয়া জানান, ওই সাতটি পরিবারের বসতবাড়ি এখন মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে আছে। পুনারায় ভারী বৃষ্টিপাত হলে পাহাড়টির একটি বড় অংশ ধসে পড়তে পারে যে কোন মূহুর্তে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশংকা রয়েছে।

কাউন্সিলর আরও বলেন, তিনি শুক্রুুবার বিকেলে ক্ষতিগ্রস্ত বসতবাড়ি সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। তিনি জানান, ঝুঁকিতে থাকা পরিবারগুলোকে নিরাপদ স্থানে সরানোর ব্যাপারে কেউ পদক্ষেপ নেয়নি। তবে তিনি ওই পরিবারগুলোকে অন্যত্র সরে যেতে পরামর্শ দিয়েছেন। বিষয়টি তিনি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে(পিআইও) জানিয়েছেন বলেও জানান।