গাছের পরিত্যক্ত শুকনো শিকড়-বাকড়ে অপরূপ শিল্পকর্ম চাঁদপুরের সমীরনের

চাঁদপুরের শাহরাস্তির ঘুঘুশাল গ্রামেই ‘মনবাগান’। এখানেই কারুশিল্পী সমীরন দত্ত গাছের পরিত্যক্ত শুকনো শিকড় বাকড়ে কারুকার্যের মাধ্যমে উপহার দিয়ে চলেছেন দারুণ দারুণ শিল্পকর্ম। তার এ শিল্পচর্চায় মুগ্ধ এখানের মানুষ।

সমীরন দত্ত ঘুঘুশালের মনবাগানে ২০১৮ সাল থেকে একটি বনজ নার্সারি ভাড়া নিয়ে নিজ খরচে তিনি এই শিল্পচর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন। সাধারণ মানুষের কাছে যা ফেলনা, সমিরন দত্তের কাছে তা শিল্পকর্মের উপকরণ।

ব্যাতিক্রমী ও বিরল শিল্পকর্ম দেখতে হরহামেশাই চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সৌখিন জনতা মনবাগানে ছুটে আসেন। স্বপ্নচারী সমিরন দত্তের এই প্রদশর্নীর কোনো সময়সীমা বা নির্দিষ্ট দিন নেই। তাই যে কেউ সামান্য টাকার টিকিট কেটেই সকাল-বিকাল এই শিল্পকর্ম দেখতে মনবাগানে ভিড় জমাচ্ছেন।

শনিবার (৮ মে) সরজমিনে গেলে দেখা যায়, মনবাগানে আলাদা আলাদা স্থানে গাছের পরিত্যক্ত শেকড় বাকড় ও কাঠের টুকরো এবং গুঁড়ি দিয়ে তৈরিকৃত সমিরন দত্তের কারুকার্যময় এই শৈল্পিক আসবাবপত্র সাজানো রয়েছে। এরমধ্যে কোনগুলো দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দৈনন্দিন ব্যবহার্য্য আসবাবপত্র। আবার কোনগুলো দিয়ে তৈরি করা হয়েছে পাখপাখালী ও জীবজন্তুর প্রতিচ্ছবি।

মনবাগানের ভিতরে রয়েছে ‘প্রিয় ভাষিনী আর্ট গ্যালারি মনবাগান আর্ট পার্ক’। ওই গ্যালারিতে প্রদর্শনী হিসেবে ব্যবহারিক আসবাবপত্র রাখা হয়েছে। সেখানে বড় সোফা, গাছের গুঁড়ি দিয়ে ব্যাতিক্রমী খাট, শোপিস স্ট্যান্ড, চেয়ার ও পুডিংসহ অন্যান্য ২শ শিল্পকর্ম রয়েছে। আর দামী আসবাবপত্রের মধ্যে প্রজাপতি, ঘোড়া, পাখি, টি-টেবিল আলাদা করে রাখা হয়েছে।

এ ব্যাপারে আলাপকালে শিল্পী সমিরন দত্ত বলেন, শিকড়-বাকড় দিয়ে ছোট যে ছাউনি তলে আমি কাজ করছি, ওই স্থানের নাম ‘আদি’। আর গাছপালাসহ পুরো সীমানাটার নাম হচ্ছে ‘মনবাগান’। সামনের একটু জলাশয়ের জায়গাসহ পুরো জায়গাটায় ৪৭ শতাংশ জমি রয়েছে।

আলাপচারিতায় কিছু প্রশ্নের উত্তরে-

কবে থেকে এই শিল্পচর্চা শুরু করেছেন?

সমিরন দত্ত বলেন, আমি এই পেশায় ১৯৯৯ সাল থেকে এসেছি। তবে কেন এসেছি! কিভাবে এসেছি! কি পেলাম এগুলো আমি নিজেও জানিনা। এই শিল্পচর্চার ওপর আমার কোন ডিগ্রি, এমনকি প্রশিক্ষণও নেই। ১৯৯৯ সালে এক বন্ধুর সাথে চট্টগ্রামে অক্সিজেন এলাকার রৌফাবাদে ঘুরতে গিয়েছিলাম। সেখানে একটি পরিত্যাক্ত গাছের শিকড় আমার নজর কাড়ে। তা আমি তুলে এনে ছল বাকল উঠিয়ে এর একটা অবয়ব তৈরি করেছি। এরপর সেটা নিয়ে যাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক মনসুরুল করিম স্যারের কাছে। যা দেখে স্যার বললেন ‘সমীরণ তুমি শেষ’। এই শিল্পকর্মে যে একবার ঢোকে সে আর বেরিয়ে আসতে পারে না, তুমিও পারবে না। আর শেষ পর্যন্ত তাই হলো। এখন প্রকৃতির গাছের শেকড় বাকড় যেটাই দেখি। সেটাতেই কিছু না কিছু অবয়ব খুঁজতে থাকি। আর এভাবেই এটিকে পেশাগত কাজ ধরে জীবিকা চালিয়ে যাচ্ছি।

এই শেকড় সংগ্রহ করার মাধ্যম কি?

সমিরন দত্ত বলেন, বন্ধু-শুভাকাঙ্খীরা সুন্দর শিকড় দেখে আমাকে খবর দেয়। আমি দেখতে যাই, কিনে আনি। কোনটা কাজে না আসলে ফেলে আসি।

সবচেয়ে বেশি দামে আপনার বানানো আসবাবপত্র কি ছিলো?

সমিরন দত্ত বলেন, এখন পর্যন্ত সাড়ে ৪ লাখ টাকা দামে একটি টি-টেবিল বিক্রি করেছি। যা লিচু কাঠ দিয়ে বানানো হয়েছিলো। এর সঙ্গে মেহগনির শিকড় দিয়ে বানানো ৮টি চেয়ার ছিলো। যা বানাতে প্রায় ১৪ মাস সময় লেগেছে। আমাকে অজয় সূত্রধর নামে এক সহকর্মী পেশাগত এই কাজে এগুলো বানাতে সহযোগিতা করে থাকে।

শিকড়ের বানানো এই শিল্পকর্ম নিয়ে কোন মেলা বা প্রদশর্নী করেছেন?

সমিরন দত্ত বলেন, চীন মৈত্রী অর্থাৎ ঢাকা বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে ৩টি মেলায় অংশ নেই। এছাড়াও চট্টগ্রাম, ঢাকা ও সিলেটে ৭টি একক প্রদর্শনীসহ মোট ১০ বার এখন পর্যন্ত এগুলোর প্রদর্শনী করেছি। মূলত সৌখিন প্রকৃতির মানুষই এগুলো ক্রয় করেন।

ঘুঘুশালে আসার পূর্বে এই শিল্পচর্চা কোথায় কোথায় করেছেন?

সমিরন দত্ত বলেন, ২০০৪ সালের দিকে ঢাকার গাজীপুরে একটি পোড়াবাড়িতে এই শিল্পচর্চা শুরু করি। তবে শহর কেন্দ্রিক হওয়ায় পর্যাপ্ত জায়গা ওখানে না থাকায় অন্য স্থানে যাই। পরে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়েও কিছুদিন এ কাজ করলেও বড় জায়গা এবং আর্থিক সংকটে ওখানেও বেশিদিন টিকতে পারিনি। পরে সব নিয়ে শিল্পচর্চার অস্তিত্বের প্রশ্নে আপোষহীনভাবে নিজ গ্রামে এসেই এ কাজ পুরোদমে শুরু করেছি। ২০০৬ সালে ঢাকার গ্যালারি চিত্রে আমার এই শিকড় বাকড়ের প্রদর্শনী ১ম হয়েছিলো।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন কোথায়?

সমিরন দত্ত বলেন, ফেনী দাগন ভূঁইয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ৯ম শ্রেণি থেকেই ব্যবসায় শাখায় পড়ালেখা করি। ওখান থেকে এসএসসি দেই। উর্ত্তীর্ণ হয়ে পরে কমার্স কলেজ থেকে এইচএসসি এবং তারপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একাউন্টিংয়ে ১৯৮৬/৮৭ ব্যাচে অনার্সে ভর্তি হয়েছি। পরে ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই মাস্টার্স শেষ করেছি।

এ পেশায় পারিবারিক সাপোর্ট আছে কিনা?

সমিরন দত্ত বলেন, বিয়ের আগে পড়াশুনা শেষে বেসরকারি একটি কোম্পানিতে চাকরি নেই। বছর দেড়েক পরে স্বেচ্ছায় তা ছেড়ে দিয়েছি।পরিবার কখনোই আমার এ পেশা খারাপ চোখে দেখেনি। বিয়ের পর সন্তানদের বাবা হলাম। তখনও এগুলো নিয়ে পারিবারিক কলহ হয়নি। এখন এই শিল্পকর্মগুলো সংরক্ষণ করে ভালো অবস্থায় দেখতে পাওয়াটাই হচ্ছে আমার পরিকল্পনা।

এ শিল্পীর শিল্পকর্মের ব্যাপারে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, আমাদের এ ব্যাপারে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। তিনি (শিল্পী সমিরন দত্ত) যদি কিছু কাঠের তৈরি শিল্পকর্ম আমাদের দেখানোর ব্যবস্থা করেন, তাহলে আমরা এটি সরকারের কাছে তুলে ধরে আর্থিক অনুদানসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা ওনাকে পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবো।